শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বের সবচেয়ে দামি বই

বিশ্বের সবচেয়ে দামি বই

বিশ্বে রয়েছে বহু দামি বই। মূলত হাতে আঁকা কিংবা ঐতিহাসিক মূল্যের কারণে এ বইগুলো এত মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এ ধরনের কিছু বইয়ের খোঁজ রয়েছে আজকের লেখায়...

কোডেক্স লিসেস্টার

এখন পর্যন্ত বিক্রি হওয়া সবচেয়ে দামি বই কোডেক্স লিসেস্টার। ৩ কোটি ৮ লাখ ডলার মূল্যের এ বই বিশ্বের অন্যতম দামি বই। ১৯৯৪ সালে দ্য ভিঞ্চির নিজ হাতে লেখা বইটি কিনে নেন মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। সর্বশেষ ২০২১ সালের হিসাব অনুসারে বইটির মূল্য দাঁড়ায় ৫ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।

থমাস কোকের নাম জড়িয়ে গেছে ওই পান্ডুলিপির সঙ্গে। তিনি ভিঞ্চির পান্ডুলিপিটি কিনেছিলেন ১৭১৯ সালে। থমাস ছিলেন আর্ল অব লেস্টার। ২৬৩ বছর থাকার পর ১৯৮০ সালে শিল্পপতি আর্মান্ড হ্যামার নিলাম থেকে এটি কিনে নিয়েছিলেন।  তাই একে কোডেক্স হ্যামারও বলা হয়। হ্যামার পন্ডিত কার্লো পেদরেত্তিকে নিয়োগ দেন বইটির হারানো পাতা খুঁজে বের করে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে। সাত বছর লেগে যায় কার্লোর, কাজটি তিনি সফলভাবেই শেষ করেন। তারপর নিউইয়র্কে ক্রিস্টির নিলাম থেকে নোটবুকটি কিনে নেন বিল গেটস।

 

দ্য ক্যান্টারবারি টেলস

দ্য ক্যান্টারবারি টেলস হলো- চব্বিশটি গল্পের একটি সংকলন। ১৪৭৮ সালে এটি প্রথম ছাপা হয়। বইটির লেখক ইংরেজি সাহিত্যিক জিওফ্রে চসার। ১৭ হাজার লাইনের মধ্যে তিনি বইটির সংকলন করেছিলেন, যা লেখকের একটি বিরাট সাহিত্যকর্ম। এর গল্পগুলোর বেশির ভাগই পদ্য আকারে লেখা, তবে এর মধ্যেও বেশ কিছু গল্পও রয়েছে। বইটির বড় অবদান হলো- ফরাসি, ইতালীয়, ল্যাটিন ভাষা সাহিত্যের বিপরীতে ইংরেজি সাহিত্যকে ভাষার জনপ্রিয়তা অর্জন। দ্য ক্যান্টারবারি টেলস বইটির মূল্য ৭৫ লাখ ডলার। এটি কেবল বিশ্বের অন্যতম দামি বই-ই নয়, এটি অন্যতম বিখ্যাত বইও বটে। ১৯৯৮ সালে ধনকুবের জন পল এ বইটির প্রথম প্রকাশের কপি ৭৫ লাখ ডলারে কিনে নেন।

 

হিস্টোরিস অ্যান্ড ট্র্যাজেডিস

হিস্টোরিস অ্যান্ড ট্র্যাজেডিস উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটকের একটি সংকলন, যাকে সাধারণত আধুনিক পন্ডিতরা ফোলিও হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৬২৩-এর সংকলিত শেকসপিয়রের প্রথম লেখা ফোলিও, যা দীর্ঘদিন ধরেই সংগ্রাহক এবং শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আসছে। জানা গেছে, শেকসপিয়রের মৃত্যুর প্রায় সাত বছর পর ১৬২৩ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এটি এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবচেয়ে প্রভাবশালী বইগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। এতে রয়েছে শেকসপিয়রের সাহিত্য। যা ফোলিও আকারে মুদ্রিত এবং এতে ৩৬টি নাটক রয়েছে।  এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দ্য টেম্পেস্ট, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, ম্যাকবেথ ও হ্যামলেটের মতো বিখ্যাত সাহিত্য। হিস্টোরিস অ্যান্ড ট্র্যাজেডিস বইটি শেকসপিয়রের সহকর্মী জন হেমিঞ্জেস ও হেনরি কনডেলকে সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছিল। বইটি ৬১ লাখ ডলার মূল্যে বিক্রি হয়।

 

সেন্ট কাথবার্ট গসপেল

সেন্ট কাথবার্ট গসপেল বইটি ইউরোপের প্রাচীনতম সংরক্ষিত একটি বই, যা ২০১২ সালে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি ১ কোটি ৪৩ লাখ ডলারে কিনে নেয়। ধারণা করা হয়, ৬৮৭ সালে বইটির লেখক সেন্ট কাথবার্টের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে সমাহিত করা হয়েছিল। ১১০৪ সালে যখন সেন্ট কাথবার্টের দেহাবশেষ একটি কবর থেকে একটি মন্দিরে স্থানান্তরিত করা হয় তখন বইটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয়েছিল। কাথবার্ট গসপেল বইটি বেলজিয়ামের একটি জেসুইট সম্প্রদায়কে দান করার আগ পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী ধরে এটি স্থানীয় এক ব্যক্তির মালিকানাধীন হিসেবে সংরক্ষিত ছিল। ধারণা করা হয়, সেখানে বইটি ২৫০ বছর ধরে ছিল। ১ কোটি ৪৩ লাখ ডলার মূল্যের পকেট গসপেল বইটি বিশ্বের টিকে থাকা প্রাচীন বইয়ের মধ্যে অন্যতম।  বইটি ব্রিটিশ লাইব্রেরির অনলাইন ডিজিটালাইজড পা-ুলিপি ডাটাবেসে পাওয়া যায়।

 

বে স্যালম বুক

‘দ্য হোল বুক অব স্যালমস ফেইথফুল’ বইকে মূলত ‘বে স্যালম বুক’ বলা হয়। এটি একটি মেট্রিকাল স্যাটলার; যা ১৬৪০ সালে ক্যামব্রিজ, ম্যাসাচুসেটসে প্রথম মুদ্রিত হয়েছিল। এটি হলো- উত্তর আমেরিকায় মুদ্রিত প্রথম বই। ১৬৪০ সালে অর্থাৎ প্লাইমাউথ রকের প্রথম তীর্থযাত্রীরা আসার ২০ বছর পর বইটি প্রকাশিত হয়েছিল। ১ কোটি ৪২ লাখ ডলার মূল্যের এ বই বিশ্বের অন্যতম দামি বই।  বে স্যালম বুকের গীতগুলো ইংরেজি সাহিত্যে অনুবাদকৃত। বিখ্যাত বইটি বেশ কয়েকটি সংস্করণের মধ্য দিয়ে গেছে এবং এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে এ বইটির মাত্র ১১টি কপি টিকে আছে, যার একটি বিক্রি হয় এ দামে। ডেভিড রুবেনস্টাইন ২০১৩ সালে বইটি কিনেছিলেন। তিনি প্রায়শই এটি লাইব্রেরিতে প্রদান করে থাকেন।

 

রথচাইল্ড প্রেয়ারবুক

রথচাইল্ড প্রেয়ারবুক ১৬ শতকের ফ্লেমিশ পা-ুলিপি; যা স্বর্ণ দ্বারা আবৃত। বইটিতে রেনেসাঁ শিল্পীদের আঁকা চিত্র দিয়ে ভরপুর। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ধনাঢ্য রথচাইল্ড পরিবারের নামকরণে; যা ১৮৬৮ সালের পর পরিবারটি গ্রহণ করেছিল। বইটি ৩৫০ বছর আগে কোথায় ছিল, তা সবার কাছেই অজানা। ১৯৩৮ সালে নাৎসিরা বইটি চুরি করেছিল। ১৯৪২ সালে হিটলার ভিয়েনার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বইটি তুলে দেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ বইটি রথচাইল্ডদের কাছে ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে ১৯৯৯ সালে এটি তার মূল মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান ধনকুবের কেরি স্টোকস ১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার মূল্যে বইটি কিনে নেন। তবে তার আগে অস্ট্রিয়ার জাতীয় লাইব্রেরিতে বইটি প্রদর্শিত ছিল।

 

ম্যাগনা কার্টা

ম্যাগনা কার্টা বইটি মূলত ১২১৫ সালে জারিকৃত ইংল্যান্ডের রাজা জনের স্বাক্ষরিত একটি রাজকীয় সনদ। বিশ্বের বুকে এটি প্রথম দলিল বা সনদ; যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট আকারে ঘোষণা করা হয় যে, রাজা এবং তার সরকার আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজতন্ত্রকে তাদের ক্ষমতার শোষণ থেকে বিরত রাখা এবং রাজকীয় কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা স্থাপন করা। ১২৯৭ সালে ঐতিহাসিক নথির মূল সংস্করণটি যুক্তরাষ্ট্রে থাকবে বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্লাইল গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড রুবেনস্টাইন ২ কোটি ১৩ লাখ ডলার প্রদান করেছিলেন।  যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সরকার বইয়ে বর্ণিত নীতিগুলোর ওপর ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিল। ২ কোটি ১৩ লাখ ডলারে বিক্রীত বইটি বিশ্বের অন্যতম দামি বই। ২০০৭ সালে লন্ডনে এ বই বিশ্বের দ্বিতীয় মূল্যবান বই হিসেবে বিক্রি হয়। বর্তমান বিশ্বে এ বইয়ের ১৭টি কপি আছে।

 

গসপেলস অব হেনরি দ্য লায়ন

১৯৯৪ সালে বিল গেটস কোডেক্স লিসেস্টার কেনার আগ পর্যন্ত দ্য গসপেলস হেনরি দ্য লায়ন ছিল নিলামে বিক্রীত বিশ্বের সবচেয়ে দামি বই। যার বাজার মূল্য প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ ডলার। গসপেলস বইটি ডিউক অব স্যাক্সনি ব্রান্সউইক ক্যাথেড্রালের ভার্জিন মেরির বেদির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন। বইটি ব্রান্সউইক ক্যাথেড্রাল নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এর তারিখ হিসেবে ব্রান্সউইকের গির্জাটি ১১৭৩ সালে নির্মিত। গসপেলস ১২ শতকের রোমানেস্ক বইয়ের আলোকসজ্জার মাস্টারপিস হিসেবে বিবেচিত। ধারণা করা হয়, বইটি ১১৮৮ সালের দিকে লেখা। জার্মান সরকার ১৯৮৩ সালে লন্ডন থেকে বইটি কিনে নেয়।  গসপেলস বইটি অন্যান্য দাতাদের অন্তর্ভুক্ত একদল নিলামকারীর মাঝেও বিক্রি করা হয়েছিল।

 

দ্য বার্ডস অব আমেরিকা

অডবন উনিশ শতকের আমেরিকান প্রকৃতিপ্রেমী এবং চিত্রশিল্পী। তিনি জীবনের বিশাল অংশ ব্যয় করেছেন পাখির ছবি এঁকে। ৫০০-এর বেশি প্রজাতির পাখির ছবি এঁকেছেন তিনি। অডবনের অসীম ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের ফসল ‘দ্য বার্ডস অব আমেরিকা’। যার একেকটি চিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আঁকতে ৬০ ঘণ্টাও লেগে গেছে। বইয়ে আঁকা অনেক পাখিই এখন বিলুপ্ত। বইয়ের ছবি আর কয়েকটি জাদুঘরে কৃত্রিমভাবে সংরক্ষিত মরদেহ এখন ওই পাখিগুলো সম্পর্কে গবেষকদের তথ্যের প্রধান উৎস। ২০১০ সালে নিলামে বইটির একটি কপির দাম উঠেছিল সাড়ে ১১ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বইটির ১১টি কপি সংরক্ষিত আছে। যার বেশির ভাগই লাইব্রেরি এবং জাদুঘরের মালিকানাধীন। ২০১০, ২০০০ ও ২০১২ সালে বইটির তিনটি কপি সপ্তম, অষ্টম ও নবম দামি বইয়ের স্বীকৃতি পায়, যার মূল্য ১ কোটি ১৫ লাখ ডলার, ৮৮ লাখ ডলার ও ৭৯ লাখ ডলার।

 

দ্য বুক অব মরমন

‘দ্য বুক অব মরমন’ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বইয়ের মধ্যে অন্যতম, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২২০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ থেকে ৪২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বসবাসকারী নবী-রসুলদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বইতে ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামরিক ঘটনাবলি বর্ণনা করা হয়েছে। পবিত্র গ্রন্থটি ১৮৩০ সালের মার্চ মাসে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রকাশক ছিলেন জোসেফ স্মিথ জুনিয়র যিনি মরমন মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। যিনি বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য বুক অব মরমন’। এই গ্রন্থের সিংহভাগই রচনা করেছেন ধর্মপ্রচারক জোসেফ স্মিথ। বইটি ১ হাজার ৫০০ লাখের বেশি কপি মুদ্রিত হয়েছে। বিশ্বের ১১২টি দেশের ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে বইটি। বিখ্যাত এই বইটি সমকালীন সময়ে বেশি বিক্রি হওয়া সবচেয়ে মূল্যবান বইয়ের রেকর্ড অর্জন করেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর