শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

পঞ্চাশের আগেই নোবেলজয়ী সাহিত্যিক

পঞ্চাশের আগেই নোবেলজয়ী সাহিত্যিক

নোবেল পদকের সর্বশেষ বিভাগ লিটেরেচার বা সাহিত্য। আর একজন লেখক কিংবা সাহিত্যিকের কাছে নোবেল পদক জয় সারা জীবনের তপস্যার বিষয়। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জোটে। তবে এমন কয়েকজন সাহিত্যিকও রয়েছেন, যাঁরা অন্যদের তুলনায় অনেক আগে নোবেল জয় করেছেন।

 

রুডইয়ার্ড কিপলিং [৪২ বছর]

উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একজন ইংরেজ লেখক, সাংবাদিক ও কবি জোসেফ রুডইয়ার্ড কিপলিং। ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান প্রবর্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। এই কথা সাহিত্যিকের জন্ম ১৮৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার বোম্বে শহরে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে কিপলিং নিজ দেশ ব্রিটেনে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮২ সালে আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। কিপলিং স্থানীয় পত্রিকা ‘সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটে’ চাকরি পান। ১৮৮৭ সালে তিনি সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন এলাহাবাদের পত্রিকা ‘দ্য পাইওনিয়ারে’। লিখেছেন ভ্রমণ ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও। কিপলিং তৎকালীন ভারতে ইংরেজ সৈনিকদের নিয়ে প্রচুর কল্পকাহিনি ও কবিতা লিখেছেন। অন্যদিকে ছোটদের জন্যও লিখেছেন অনেক গল্প। তাঁর সৃষ্ট শিশুসাহিত্য পেয়েছে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা। তাঁর লেখা বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম- জঙ্গল বুক, কিম, দ্য ম্যান হু উড বি কিং, ইফ ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো মান্দালয় ও গঙ্গা দিন। ৪২ বছর বয়সে ১৯০৭ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। কিপলিং ইংরেজি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রথম লেখক।

 

আলব্যের কামু [৪৪ বছর]

ফরাসি লেখক আলব্যের কামু। একজন কালজয়ী ঔপন্যাসিক। বিগত শতাব্দীতে শিল্প-সাহিত্যে দুনিয়াব্যাপী প্রভাবশালী লেখকদের একজন। জন্ম ৭ নভেম্বর ১৯১৩ আলজেরিয়ায়। পড়াশোনা করেন আলজেরিয়া ইউনিভার্সিটিতে এবং ভার্সিটি লাইফে ফুটবল দলের দক্ষ গোলকিপার হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি একাধারে সাংবাদিক, লেখক এবং দার্শনিক ছিলেন। এথিক্স, পলিটিক্স, লাভ এবং জাস্টিস ইত্যাদি তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল। দ্য স্ট্রেঞ্জার, দ্য প্লেগ, দ্য ফল-এর মতো কালজয়ী উপন্যাসের রচয়িতা কামু অসংখ্য ছোটগল্পও লেখেন। তাঁর সৃষ্টিবিশ্ব আরও যেসব রত্ন দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস ‘এ হ্যাপি ডেথ’ ও ‘দ্য ফার্স্ট ম্যান’। নাটক ‘ক্যালিগুলা’, ‘দ্য মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং’, ‘দ্য স্টে অব সিজ’, ‘দ্য জাস্ট অ্যাসাসিন্স’, ‘রিক্যুয়াম ফর এ নান’ ও ‘দ্য পজেসড’। প্রবন্ধ-নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে, খ্রিস্টিয়ান মেটাফিজিকস অ্যান্ড নিউ ফ্লনিজম, দ্য রং সাইড অ্যান্ড দ্য রাইট সাইড এবং নাপটিয়ালস। এ ছাড়া নন ফিকশন লেখার মধ্যে কামুর দ্য মিথ অব সিসিফাস এবং দ্য রেবেল উল্লেখযোগ্য। কামু তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে অসংখ্য নাটক এবং গবেষণামূলক লেখা লিখেছেন। মৃত্যুর পর তাঁর লেখা প্রকাশিত বইগুলো হলো- অ্যা হ্যাপি ডেথ এবং ১৯৯৫-এ প্রকাশিত হয় তাঁর অসমাপ্ত নভেল দ্য ফার্স্ট ম্যান- এটি কামুর আত্মজৈবনিক- আলজেরিয়ার শৈশব নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস। সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবার জন্য ১৯৫৭ সালে নোবেল পুরস্কার পান ফরাসি বংশো™ূ¢ত আলজেরীয় এই সাহিত্যিক। কিপলিং-এর পর তিনি দ্বিতীয় কম বয়সী লেখক। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক হন আলব্যের কামু।

 

হ্যারি সিনক্লেয়ার লুইস [৪৫ বছর]

হ্যারি সিনক্লেয়ার লুইস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার এবং নাট্য রচয়িতা। তাঁর প্রাকৃতিক লিখনশৈলী ও বিষয় নির্বাচনে স্বচ্ছতা পরবর্তীকালের লেখকদের ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল। তাঁর লেখার ধরন পরবর্তীকালে অনেক লেখককে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর লেখায় তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্দেশ্যহীনতা আর একঘেয়েমি জীবনের যেমন বর্ণনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণিরও সমালোচনা। চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন দক্ষ। তিনি তাঁর লেখায় আমেরিকান সমাজের কর্মজীবী নারীদের শক্ত মানসিকতা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। ১৮৮৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাউক সেন্টার, মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন হ্যারি। সিনক্লেয়ার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে লুইস কিছু পত্রিকার প্রতিবেদক এবং দ্য সেটার ডে ইভিনিং পোস্ট ও কসমোপলিটন পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পেশা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান এই সাহিত্যিক। লুইস-ই প্রথম আমেরিকান ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও ছোটগল্প লেখক- যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার প্রথম বই ‘আওয়ার মিস্টার রেন’ প্রকাশ হওয়ার পর পাঠকের মনোযোগ এবং সমালোচনা- দুটিরই সম্মুখীন হন। তাঁর দ্বিতীয় বই ‘মেইন স্ট্রিট’ আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও পড়ানো হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে- ব্যাবিট, অ্যারোজস্মিথ, ডডসওর্থ অন্যতম। ১৯২৬ সালে অ্যারোজ-স্মিথের জন্য পুলিৎজার পেলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।

 

সিগ্রিদ উন্দসেথ [৪৬ বছর]

সিগ্রিদ উন্দসেথ, একজন নরওয়ান ঔপন্যাসিক। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী প্রথম মহিলা ছিলেন। বিখ্যাত এই সাহিত্যিক ডেনমার্কে জন্মগ্রহণ করলেও মাত্র দুই বছর বয়সে তাঁর পরিবার নরওয়ে চলে আসে এবং ওসলোতে বসবাস শুরু করে। উন্দসেথের বয়স যখন ১১ তখন দীর্ঘ রোগ ভোগের পর তাঁর বাবা মারা গেলে তাঁদের পরিবারে আর্থিক অসচ্ছলতা প্রবল হয়ে ওঠে। এ কারণে উন্দসেথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা ছেড়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই চাকরিজীবনে ঢোকেন। উন্দসেথের লেখার মূল বিষয় ছিল নারী এবং নারীর ভালোবাসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে উন্দসেথ হিটলার আর নাৎসি জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। নরওয়েজিয়ান এই ঔপন্যাসিক সাহিত্যে অসামান্য কৃতিত্ব রাখবার জন্য ১৯২৮ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন মাত্র ৪৬ বছর বয়সে। সিগ্রিদ উন্দসেথের সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস হলো ‘ক্রিস্টিন ল্যাভরানসডেটার’- এটি তিন ভলিউমের একটি ত্রয়ী উপন্যাস। ক্রিস্টিন ল্যাভরানসডেটারের প্রথম পর্ব নিয়ে ১৯৯৫ সালে একটি চলচ্চিত্রও তৈরি হয়। সেখানে উন্দসেথ- স্ক্যান্ডেনেভিয়ার মধ্যবয়স্ক এক মহিলার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত জার্নি তুলে ধরেছেন। উন্দসেথ নোবেল পুরস্কার পান মূলত ক্রিস্টিন ল্যাভরানসডেটার এবং দ্য মাস্টার অব হাস্টভিকেন উপন্যাস দুটির জন্য। উন্দসেথের প্রথম উপন্যাস ছিল গানার্স ডটার। তাঁর তৃতীয় বই প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি চাকরি ছেড়ে লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করেন এবং প্রচুর গল্প ও উপন্যাস লেখেন।

 

পার্ল এস. বাক [৪৬ বছর]

পার্ল এস বাক সেই মহৎ লেখকদেরই একজন যিনি প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে দুটি পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। জন্ম ১৮৯২ সালের ২৬ জুন আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে। বিশ্বসাহিত্যে পার্ল এস বাক এক ভিন্ন ধরনের লেখকের নাম। জীবনের প্রথম দিকের একটি বিশাল সময় চীনে অতিবাহিত করেন পার্ল। তাঁর লেখা উপন্যাস দ্য গুড আর্থ আমেরিকায় বেস্টসেলার হয়। এটিই তাঁর বহুল পঠিত উপন্যাসও। ১৯৩২ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। ১৯৩৫ সালে আমেরিকা ফিরে আসেন এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। শুধু লেখালেখিই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি করে গেছেন, নারী ও শিশু অধিকার আন্দোলন। সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন আশ্রয়হীন শিশুদের আশ্রয়স্থল গড়ার ক্ষেত্রে। পার্ল একজন প্রমিন্যান্ট অ্যাডভোকেট হিসেবেও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। লিখেছেন ‘দ্য গুড আর্থের’ মতো অসাধারণ উপন্যাস। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, তিনি ‘মা’ নামেও একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। কিন্তু ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’য়ের আড়ালে রয়ে গেছে তার সেই বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসটি। ১৯৩৮-এ সাহিত্যে নোবেল জয় করেন এই আমেরিকান লেখক। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৬ বছর।

সর্বশেষ খবর