শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের কথা

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের কথা

কবি-সাহিত্যিকরা কলমের আঁচড়ে পুষ্টি জুগিয়েছেন পাঠকের মনে। হৃদয় করেছেন পরিতৃপ্ত। যা পরবর্তীকালে বাংলা ভাষাভাষীর মনে আনে মানবপ্রেম, ন্যায়নীতি, উত্তম আদর্শ ও শিষ্টাচার। বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত মুসলিম কবির সংখ্যা কম নয়। আজ উল্লেখযোগ্য কয়েকজনকে নিয়ে এই আয়োজন-

 

শাহ মোহাম্মদ সগীর

কাব্যগাঁথা ইউসুফ-জোলেখা গ্রন্থের নাম শোনেননি, এমন সাহিত্যপ্রেমী বোধ হয় কমই আছেন। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, এর রচয়িতা কে? তিনি প্রাচীনতম মুসলিম কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর। আনুমানিক ১৩-১৪ শতকের সময় বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি ছিলেন তিনি। ধারণা করা হয়, গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১১ খ্রিস্টাব্দ) তিনি কাব্যগাঁথা ‘ইউসুফ-জুলেখা’ রচনা করেন। কবি ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজকর্মচারী। এই সময় তিনি বন্দনাগীতি কবিতাও রচনা করেন। যেখানে বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ফুটে ওঠে। তুলে ধরেন শাসকের স্তুতিও। কাব্যরস পরিবেশন অপেক্ষা ধর্মীয় প্রেরণা সৃষ্টির প্রতিই শাহ মোহাম্মদ সগীরের অধিক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।

সেই যুগে বাংলা ভাষাভাষীদের রম্যরসে ভরা ধর্ম কাহিনি রচনা করার মধ্যে কবির সৎসাহসের পরিচয় মেলে। বাইবেল-কোরআন কিংবা ফেরদৌসী-জামির অনুসরণে কাহিনি-কাব্যটি কল্পিত হলেও বাংলাদেশ ও বাঙালি-জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। ধারণা করা হয়, কাব্যটি আনুমানিক পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দশকে রচনা করা হয়। ড. এনামুল হকের মতে, কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর ইউসুফ-জুলেখার মূল কাহিনি সংগ্রহ করেন ‘কিতাবুল কোরআন’ থেকে। কিন্তু কাব্যটি ধর্মীয় উপাখ্যান নয়, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান যা মানবজীবন রসে সিক্ত। শাহ মোহাম্মদ সগীর মূলত কোরআনে বর্ণিত ইউসুফ-জুলেখাকে নতুন আকৃতিতে মোহনীয় মূর্তি গড়ে তুলেছিলেন।

 

শেখ ফয়জুল্লাহ

মধ্যযুগের মুসলিম কবি শেখ ফয়জুল্লাহ। বাংলার বুকে অসাম্প্রদায়িক কবি হিসেবে তিনি পরিচিত। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। নানা তথ্যমতে, কবি শেখ ফয়জুল্লাহর জন্মস্থান (আনুমানিক ১৫৭৫-৭৬ সালে) হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত, দক্ষিণ রাঢ় এবং কুমিল্লার নাম উল্লেখ আছে। তবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ডক্টর আহমদ শরীফ তাঁর জীবনকাল ১৫৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দ বলে নির্ধারণ করেছেন। অর্থাৎ যে সময়টায় বাংলায় কররানি বংশের (১৫৫৯ থেকে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনের অবসান ঘটেছে। কররানি বংশের শাসক ছিলেন সোলায়মান এবং দাউদ কররানি। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আরম্ভ হয় মুঘল আমল। এমন সময়েও তিনি বেঁচে ছিলেন। শেখ ফয়জুল্লাহর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের পাচনা গ্রামে। এই মতটি ডক্টর সুকুমার সেনের। শেখ ফয়জুল্লাহর মোট পাঁচটি কাব্যের সন্ধান মেলে। সেগুলো হলো- ‘গোরক্ষবিজয়’, ‘গাজীবিজয়’, ‘সত্যপীর (১৫৭৫)’, ‘জয়নবের চৌতিশা’ এবং ‘রাগনামা’। রংপুরের খোঁট দুয়ায়ের পীর ইসমাইল গাজীর জীবন নিয়ে রচিত গাজীবিজয়। কবি আধ্যাত্মিক সাধনা অবলম্বনে গড়ে উঠেছে সত্যপীর কাব্যটি। জয়নবের চৌতিশার বিষয়বস্তু মহররমের মর্মান্তিক ঘটনা। রাগনামাকে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম সংগীতবিষয়ক কাব্য মনে করা হয়। দেখা যায়, শেখ ফয়জুল্লাহর অধিকাংশ কাব্যের বিষয়ই পীর-দরবেশ এবং কারবালার মতো মুসলিম ঐতিহ্য। শেখ ফয়জুল্লাহ বাংলা সমাজের চিরায়ত দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।

 

দৌলত উজির বাহরাম খান

১৬ শতকের রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান রচয়িতাদের আরেকজন প্রভাবশালী কবির নাম পাওয়া যায়, তিনি হলেন- দৌলত উজির বাহরাম খান। মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি। তার প্রকৃত নাম ছিল আসাউদ্দীন। তিনি পারস্যে লোক কাহিনি ‘লাইলি মজনু’ শীর্ষক বেদনাবিধুর প্রেম-কাহিনিমূলক কাব্য রচনা করে মুসলিম সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। কবি চট্টগ্রামের অধিপতি নেজাম শাহ শুরের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্যটি রচনা করেছিলেন। এ কাব্য শিল্প-মহিমা বা সাহিত্য-সম্পদে অতুলনীয় এবং কবিত্বে পরিপক্ব। সে যুগে রোমান্স সৃষ্টির প্রয়োজনে অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার সমাবেশ যেখানে অপরিহার্য ছিল, এ কাব্যের মধ্যে সে রকম অতিপ্রাকৃত ঘটনার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ১৫৬০ থেকে ১৫৭৫ সালের মধ্যে কবি লাইলী-মজনু কাব্য রচনা করেছিলেন। কবি দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত লাইলী-মজনু কাব্য ফারসি কবি জামিরের লাইলী-মজনু নামক কাব্যের ভাবানুবাদ। লাইলী-মজনু প্রেমকাহিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এই কাহিনির মূল উৎস আরবি লোকগাথা। গুণী এই কবি বাহরাম খান চট্টগ্রাম জেলার ফতেয়াবাদ অথবা জাফরাবাদে জন্ম। বাবা মোবারক খান ছিলেন চট্টলাধিপতির উজির (মন্ত্রী)। অল্প বয়সে বাবাকে হারালে চট্টগ্রামের অধিপতি নেজাম শুর বাবার উজির পদে তাকে অভিষিক্ত করেন। রাজকাজের পাশাপাশি তিনি সাহিত্যাঙ্গনে রেখেছেন দৃপ্ত পদচারণা। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তবে তিনি স্বশিক্ষিত ছিলেন। কবি আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। আর তারই প্রমাণ মিলেছে দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো থেকে। বাহরাম খানের অপর আখ্যানকাব্য ইমাম-বিজয়। ইমাম-বিজয়ের বিষয়বস্তু কারবালার বিষাদময় যুদ্ধকাহিনি। সাহিত্যে দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত প্রথম কাব্যের নাম জঙ্গনামা বা মক্তুল হোসেনও সমান জনপ্রিয়। লাইলী-মজনু তাঁর দ্বিতীয় কাব্য।

সর্বশেষ খবর