শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাতাবাহার

ইমদাদুল হক মিলন

পাতাবাহার

পর্ব - ১

মিজান সাহেব কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। দুপুরের দিকে হঠাৎই জ্বর এসেছে। কোনো রকমে চারটি মুখে দিয়ে দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছেন। গ্যাসট্রিক রোগটি প্রবলভাবে আছে। খাওয়ার আগে গ্যাসট্রিকের ওষুধ খেয়েছেন। কিছু দিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডায়াবেটিস আর প্রেশার বাঁধালেন রিয়াদে থাকা অবস্থায়। সেখানে একটা ব্রিটিশ কোম্পানিতে ওয়েল্ডারের কাজ করতেন। বেশ টেনশনের কাজ ছিল। চাকরির টেনশনের ফলে ডায়াবেটিস ঢুকে গেল শরীরে। সঙ্গে যমজ ভাইয়ের মতো এলো প্রেশার। ওসব নিয়েই সাতটা বছর পার করলেন রিয়াদে। এসব অসুখ-বিসুখের ফাঁকে আর একটা অসুখ গোপনে বাস করত মনের ভিতরে। সেই অসুখের নাম ‘পাতাবাহার’। তাঁর মেয়ে। তখন মেয়েটির এগারো বছর বয়স। বয়সের তুলনায় অনেকটাই বড় দেখায়। শরীর স্বাস্থ্য ভালো আর বেদম শক্তি গায়ে। মুখটা পানপাতার মতো দেখাতো বলে মিজান সাহেব আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘পাতাবাহার’। এই নাম নিয়ে লোকের কত হাসাহাসি! পাতাবাহার কোনো মেয়ের নাম হতে পারে? ছেলেটি বড়। তার নাম জাকারিয়া। ওই নাম নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। স্বাভাবিক নাম। জাকারিয়া নামে কত মানুষ আছে দেশে!

রিয়াদে থাকা অবস্থায় পাতাবাহার ছিল মিজান সাহেবের গোপন অসুখ। সারাক্ষণের টেনশন। মেয়েটি স্বাভাবিক না। ভালো রকম মানসিক সমস্যা আছে। জন্মেছিল স্বাভাবিকভাবেই। বড় হচ্ছিল কিন্তু কথা বলছিল না। এক দুই তিন করে সাত বছর বয়স হলো। না কথা বলে না। চুপচাপ হাঁটাচলা করে, মা গোসল করিয়ে দেয়, বাবা মা ভাই খাইয়ে দেয়। একা একা ঘুরে বেড়ায়। পাড়ার ছেলেমেয়েরা হৈ চৈ খেলাধুলা করে, সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কারও সঙ্গে মেশে না। মুখে শব্দ তো নেই-ই। সবাই ভাবলো পাতাবাহার বোবা।

সাত বছর বয়সের সময় প্রবল জ্বর হলো। কাপাসিয়া থেকে ঢাকা কাছে। মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসা চলল দিনের পর দিন। অবাক ব্যাপার, জ্বর সারেই না। কিছুটা কমে, আবার আসে। তিন মাস একটানা ভুগল মেয়েটি। তারপর সেরে উঠল। ততদিনে তার শরীর বিছানায় মিশে গেছে। সত্যিকার অর্থেই কঙ্কাল হয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে পারে না। কোলে কাঁখে করে তার কাজগুলো করাতে হয়। খাওয়া-দাওয়া গোসল ইত্যাদি, সবকিছু।

মিজান সাহেবের স্ত্রী আনু এটু রাগী স্বভাবের। একটু অস্থিরও। মেয়ের দেখাশোনা করতে গিয়ে বিরক্ত হন। ওই রোগা মেয়েটিকে চড়চাপড়ও মেরে বসেন। কাপাসিয়া বাজারে মিজান সাহেবের ওয়েলডিংয়ের দোকান। আয় রোজগার মন্দ না। জাকারিয়া ঢাকায় থেকে তিতুমীর কলেজে বিএ পড়ে। ছেলেটা খুবই হিসেবি। বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নেয় না। টিউশনি করে চলে। থাকে মিজান সাহেবের বড়ভাইয়ের বাড়িতে। সে হয়েছে বাবার মতো শান্ত আর অপরিসীম ধৈর্যশীল।

মেয়ের চিকিৎসায় শেষ হয়ে গিয়েছিলেন মিজান সাহেব। যে ডাক্তার যা বলেছেন তাই করেছেন। ঢাকার প্রায় সব বড় হাসপাতালের, সব বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন। শুধু বিদেশে নিয়ে চিকিৎসাটা করাতে পারেননি। ততদিনে ওয়েলডিংয়ের দোকান বিক্রি করে দিতে হয়েছে। চাষের জমি ছিল কিছু। সেসবেরও খানিকটা বিক্রি করলেন। পাতাবাহার তখন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। কিন্তু মায়ের কাছে সে যায়ই না। সারাক্ষণ বাবার সঙ্গে। বাড়ি থেকে বাজার বেশি দূরে নয়। যখন তখন দৌড়ে চলে যায় দোকানে। বাবাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। ভাই বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ ভাইয়ের সঙ্গে। বাবার মতো ভাইকেও সে খুব পছন্দ করে।

অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর একদিন এক অলৌকিক ঘটনা ঘটল। হঠাৎই কথা বলতে শুরু করল পাতাবাহার। জাকারিয়ার কলেজ বন্ধ। বাড়িতেই ছিল। বিকেলবেলা গিয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে দেখে উঠোন ভর্তি পাড়ার লোক। তারা সবাই স্তব্ধ হয়ে আছে কথা বলছে শুধু পাতাবাহার। কথা মানে কী! কথার ফুলঝুড়ি। মিজান সাহেব মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন আর সে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। ‘ও বাবা, আমি এতদিন কথা বলিনি কেন? কী হয়েছিল আমার? মনে তো কত কথা আসত! বলতাম না কেন? তুমি আমাকে কথা বলতে বলোনি কেন? ভাইও বলেনি। তোমাকে আর ভাইকে আমি খুব ভালোবাসি। মাকে একদম ভালোবাসি না। মা আমাকে কত মারে...’!

আনুও বসে আছেন পাশে। তিনি কোনো কথা বলছেন না। মাঝে মাঝে চোখ মুচছেন।

জাকারিয়া বাড়ি ফেরার পর দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল পাতাবাহার। ‘ভাই, ও ভাই দেখো আমি কথা বলছি। আমি সব কথা বলতে পারি। আমি বোবা না...’।

জাকারিয়া গভীর আবেগে বোনকে জড়িয়ে ধরেছে। তার চোখেও পানি।

পরদিন ঘটল আরেক ঘটনা। মিজান সাহেব আর জাকারিয়া দুপুরবেলা গোসল করতে যায় বাড়ির কাছে যমুনার মরা শাখায়। নদীটা এখন ছোট খাল। তবে পানিটা স্বচ্ছ। পাতাবাহার বায়না ধরল সেও যাবে। নদীতে গোসল করবে। আনু তাকে বাড়িতে গোসল করিয়ে দেন। তিনি নানাভাবে বোঝালেন। কাজ হলো না। পাতাবাহার যাবেই। কী আর করা! তাকে সঙ্গে নিতে হলো। নদীতে নেমে লাফঝাঁপ শুরু করল সে। ওই করতে করতে এক সময় অথৈ পানিতে চলে গেল। মিজান সাহেব আর জাকারিয়া ভয়ে আতঙ্কে সাঁতরে গেল তাকে উদ্ধার করতে। তখন দেখা গেল পাতাবাহার হি হি করে হাসছে আর সাঁতার জানা মানুষের মতো পানিতে ভেসে আছে। পাড়ার লোকজন অনেকে ছিল নদীতে। গোসল করতে এসেছে। মিজান সাহেব আর জাকারিয়ার মতো তারাও অবাক। তারপর দিব্যি সাঁতার কেটে বাবা আর ভাইয়ের কাছে ফিরে এলো পাতাবাহার। ‘ও বাবা, তুমি ভয় পেয়েছিলে? ভাই, তুমি ভেবেছ আমি ডুবে মরে যাবো? না, আমি ডুববো না তো! আমি তো সাঁতার জানি! আজ এই কিছুক্ষণ আগেই শিখে ফেললাম। অথৈ পানিতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছিলাম, তখনই শিখলাম...।’

এ দুই ঘটনার পর গ্রামে রটে গেল পাতাবাহারের সঙ্গে জিনের আছর আছে। এই মেয়ের দিকে তাকানো যাবে না, তাকে ঘাটানো যাবে না। সবাই তাকে ভয় পেতে শুরু করল। এমনিতেই সে কারও সঙ্গে মিশত না, তার সঙ্গেও কেউ মিশত না। সে আগে যেমন ছিল তেমনই নিজেকে নিয়ে থাকে। শুধু একজন মানুষকেই সে ভয় পায়। সে হচ্ছে আনু। মা যা বলেন তা সে শোনে।

একটা সময়ে পাতাবাহারকে পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করলেন মিজান সাহেব। স্কুলে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। স্কুলে পাতাবাহার গেলই না। বইখাতা ছিঁড়ে কুটি কুটি করল। জাকারিয়াও নানাভাবে চেষ্টা করল। কাজ হলো না। পাতাবাহার নিজের মনে থাকে আর বাপের সঙ্গে অনর্গল কথা বলে। ভাই বাড়ি এলে তার সঙ্গে বলে। মা ধমক না দেওয়া পর্যন্ত থামে না। তবে বাড়ির এই তিনজন মানুষ ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কথা সে বলে না।

দিনে দিনে দিন কাটতে লাগল। পাতাবাহার আগে যেমন ছিল তেমনই নিজেকে নিয়ে থাকে। 

ততদিনে পাতাবাহারের স্বাস্থ্যও ভালো হতে শুরু করেছে। বাপঅন্তপ্রাণ মেয়েটিকে ফেলে এ সময় মিজান সাহেবকে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাতে হলো রোজগারের আশায়। তবে সেই দেশে দিনগুলো তাঁর অতিকষ্টে কেটেছে। প্রতি রাতে মেয়ের জন্য কাঁদতেন। ফোন করে মেয়ের খবর নিতেন এক দুদিন পর পর। মেয়ে ফোন ধরলে আর থামতো না। কথা বলেই যেত, বলেই যেত। আনু জোর করে ফোন থেকে তাকে সরাতো। ঘুরে ফিরে কথা একটাই ছিল পাতাবাহারের। ‘তুমি কোথায় চলে গেছ বাবা? তোমাকে তো আমি কোথাও খুঁজে পাই না। বাড়িতে পাই না, বাজারে পাই না, মাঠে পাই না। তুমি কোথায় বাবা? আমি তোমাকে কতদিন দেখি না। কত কাঁদি তোমার জন্য। তুমি আসো না কেন, বাবা?’

মিজান সাহেব কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দিতেন।

সাত বছর পর এসে দেখেন তাঁর সেই ছোট্ট মেয়েটি আর নেই। সে লম্বা হয়েছে পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির মতো। বেশ শক্তপোক্ত শরীর। তবে মুখটা শিশুর মতো নির্মল। চোখ দুটো মায়াবী। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে আর অনর্গল কথা বলছে। একা একাই বলছে।

একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল জাকারিয়া। ব্যাগ সুটকেস বেশ কয়েকটা। আশ্চর্য ব্যাপার, মিজান সাহেবকে দেখে তাঁকে জড়িয়ে ধরা, কান্নাকাটি করা, সাধারণত যা হয় এরকম পরিস্থিতিতে তার কিছুই পাতাবাহার করল না। বাবার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ও বাবা, তুমি কি মরে গিয়েছিলে? নয়তো এতদিন বাড়ি ফেরোনি কেন?’

মেয়ের কথায় মিজান সাহেবের বুকে বড় রকমের একটা ধাক্কা লাগল। আহা, মেয়েটি বড় হয়েছে ঠিকই কিন্তু স্বাভাবিক হয়নি। মানসিক সমস্যাটা তার রয়েই গেছে। এই মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে? সে তো পাগল! স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলেন, ছেলের সঙ্গে করলেন। কেউ কোনো জবাব দিতে পারল না। আনু হাহাকারের গলায় বললেন, ‘আমার কপালের দোষ। নয়তো ভালো মেয়েটি জন্মাল, সে কেন এমন হয়ে যাবে?’

জাকারিয়া কোনো কথাই বলল না।

সাত বছরে টাকা-পয়সা ভালোই রোজগার করেছিলেন মিজান সাহেব। বাড়িতে একতলা দালান করেছেন, কিছু জমি কিনেছেন। বাজারে দুটো দোকান কিনে ভাড়া দিয়েছেন। জাকারিয়াও পড়াশোনা শেষ করে একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। সবদিক দিয়েই উন্নতি হয়েছে সংসারে। শুধু ওই পাতাবাহার! মেয়েটির কী হবে? এই মেয়ের বিয়ে দেওয়া সম্ভব না। কে বিয়ে করবে পাগল মেয়েটিকে?

গত সাত বছরে বোনের নানা রকম চিকিৎসা করিয়েছে জাকারিয়া। ঢাকায় নিয়ে বড় বড় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছে, বহু টাকা খরচ করেছে। ওষুধ বিষুধ চলেছে মাসের পর মাস। কাজ হয়নি। পাড়ার লোকজন বেদম ভয় পায় তাকে। যদিও সে কাউকে মারধর করে না, গালাগাল বিরক্ত করে না। তবু ভয় পায়। এই মেয়েকে নিয়ে সারাক্ষণই দুশ্চিন্তায় থাকেন মিজান সাহেব। তবে বাপ মেয়ে দুজনই দুজনার জন্য পাগল। মেয়ে বাবার হাত ছাড়া খাবে না, বাবা ঘুম পাড়িয়ে না দিলে ঘুমাবে না। বাবা ডেকে না তুললে ঘুম থেকে উঠবে না। বাবা না বললে গোসল করতে যাবে না। সব কিছুই বাবার বলে দিতে হবে। বাড়ি এলে ভাইয়ের কথা সে শোনে। বাবা এবং ভাই জগৎ সংসারে এ দুজনই যেন তার নিজের মানুষ। আর যেন কেউ নেই। যে মা তাকে জন্ম দিয়েছেন সেই মাকে সে যমের মতো ভয় পায়। কেন কে জানে!

আজ দুপুরে যমুনার মরা শাখায় মায়ের সঙ্গে গিয়ে গোসল সেরে এসেছে পাতাবাহার। এসে বাবাকে আর খুঁজে পায় না। ‘বাবা বাবা’ বলে বার কয়েক চিৎকার করে ঢুকেছে তার ঘরে। দেখে বাবা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। হ্যাঁচকা টানে কাঁথা সরিয়েছে। ‘আমি যে ডাকছি শুনতে পাও না তুমি? তুমি কি মরে গেছ? ওঠ, আমাকে ভাত খাইয়ে দাও। আমার খুব খিদা পেয়েছে।’

মিজান সাহেব মুমূর্ষু গলায় বললেন, ‘আমার জ্বর এসেছে মা। আজ তুমি নিজ হাতে খাও। আমি উঠে বসতে পারছি না।’

সঙ্গে সঙ্গে রেগে গেল পাতাবাহার। ‘কেন জ্বর এসেছে তোমার? কেন উঠে বসতে পারছ না?’

মিজান সাহেব আগের মতোই মুমূর্ষু গলায় বললেন, ‘জ্বর কেন এসেছে আমি তা জানি না মা।’

‘কেন জানো না?’

মিজান সাহেব চুপ করে রইলেন।

পাতাবাহার রাগী গলায় বলল, ‘বললে না, কেন জানো না?’

তার পর দুহাতে বাবার একটা হাত ধরে টানতে লাগল। ‘জ্বর এলে কিচ্ছু হয় না। ওঠো তুমি, ওঠো। বললাম যে আমার খিদা পেয়েছে। তাড়াতাড়ি ভাত খাইয়ে দাও আমাকে। ওঠো বলছি, ওঠো।’

মিজান সাহেবকে টেনে তুলে ফেলল পাতাবাহার। মিজান সাহেব টের পেলেন তাঁর মাথা খুবই ব্যথা করছে। জ্বর বেড়ে যাচ্ছে। শরীর কাঁপছে। বসে থাকতে তিনি পারছেন না। কাতর গলায় বললেন, ‘মাগো, আমার মাথাটা খুবই ব্যথা করছে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আমি বসে থাকতে পারছি না। তুমি বড়ো হয়েছ মা। হাত দিয়ে খেতেও পারো। আজ নিজ হাতে খাও মা। আর নয়তো আমি তোমার মাকে বলে দিচ্ছি সে তোমাকে খাইয়ে দেবে।’

‘মা’র হাতে আমি খাব না। তুমিই খাইয়ে দেবে। আমি ভাত আনতে গেলাম।’

রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল পাতাবাহার।

আনু রান্নাঘরে বসেছিলেন। গোসল করতে যাওয়ার আগে দেখে গেছেন মিজান সাহেব শুয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এ সময় শুয়ে আছ কেন?’

মিজান সাহেব বলেছিলেন, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না। বোধহয় জ্বর আসবে। মাথাটা খুব ব্যথা করছে।’

‘তা হলে গ্যাসট্রিকের ওষুধ খাও। তার পর ভাত খেয়ে প্যারাসিটামল খাও।’

মিজান সাহেব তাই করেছেন। আজকাল শরীরটা তাঁর ঠিকই থাকছে না। কখনো কখনো প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। সুগার ঠিক থাকছে না। ডান পা ঠিকমতো ফেলতে পারছেন না কিছুদিন ধরে। নার্ভের সমস্যা হয়েছে। ফলে হাঁটাচলাও করতে পারেন না আগের মতো। তিপ্পান্ন চুয়ান্ন বছর বয়সে বিছানায় পড়ে গেছেন। 

জাকারিয়া খুবই দায়িত্বশীল ছেলে। বাবাকে সে ঢাকায় নিয়ে বড় ডাক্তার দেখিয়েছে। কিন্তু মিজান সাহেবের একটা স্বভাব হলো তিনি ডাক্তারদের কথা শুনতেই চান না। চলেন নিজের ইচ্ছেমতো। আর কী রকম একটা অলসতাও ধরেছে তাঁকে। কিছুই করতে চান না। হাঁটাচলা একান্ত প্রয়োজন না হলে করেন-ই না। শুয়ে বসে থাকতেই পছন্দ করেন। পাতাবাহার ছাড়া কারও কথাই বলতে গেলে শোনেন না। এজন্য আনু এবং জাকারিয়া দুজনেই তাঁর ওপর বিরক্ত। জাকারিয়া নিজের বিরক্তি বাবাকে বুঝতে দেয় না। আনু প্রায়ই বিরক্তিটা প্রকাশ করেন। প্রথম প্রথম স্বামীর শরীর খারাপের কথা শুনলে চিন্তিত হতেন। তাঁর সেবাযতেœ মন দিতেন। যখন দেখলেন যে দুয়েক দিন পর পরই, আজ এটা কাল ওটা হচ্ছে, এ অবস্থায় যা হয় আর কী, মিজান সাহেবের শরীর খারাপের গুরুত্বটা কমে গেল তাঁর কাছে। আজ মেয়ে নিয়ে গোসল সেরে এসে স্বামীর শরীরের খবর তিনি আর নেননি। তাঁর আর মেয়ের ভাত বেড়েছেন। তিনি রান্নাঘরে বসেই খাওয়া সারছিলেন। মেয়ের ভাত বেড়ে রেখেছেন থালায়। সিলভার কাপ মাছের একটা টুকরা, সঙ্গে অনেকটা ঝোল আর পটোল ভাজি সাজিয়ে দিয়েছেন প্লেটে। মিজান সাহেবের শরীর এতক্ষণে নিশ্চয় স্বাভাবিক হয়েছে। মেয়েকে তিনিই খাইয়ে দেবেন।

বাড়ি এসেই পাতাবাহার ছুটে গেছে বাবার কাছে। কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে এসে খাবারের প্লেট নিয়ে গেছে। ঘটনা ঘটল তার পর। রান্নাঘরে বসে, ভাত খেতে খেতে আনু শুনতে পেলেন পাতাবাহার চিৎকার করে বলছে, ‘আমি আজ ভাতই খাবো না। তুমি মরো, মরো।’ তার পর খাবারের প্লেট ছুড়ে ফেলার শব্দ। 

নিজের খাবার ফেলে শোবার ঘরে ছুটে গেছেন আনু। গিয়ে দেখেন পাতাবাহারের ভাতের প্লেট মেঝেতে পড়ে আছে। ভাত তরকারি ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। মিজান সাহেব বিছানায় বসে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছেন সেই দিকে আর পাতাবাহার ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে।

ঘটনা বুঝলেন আনু। বুঝে তাঁর আর মাথা ঠিক থাকল না। মেয়ের পিঠে গুম গুম করে কয়েকটা কিল মারলেন। তার পর মেয়ের চুলের মুঠি ধরে বললেন, ‘এই ভাত তরকারি এখন তুই প্লেটে তুলবি। তার পর এটাই তোকে আমি খাওয়াবো, নচ্ছার মেয়ে। তোল, ভাত তোল।’

মিজান সাহেবের শক্তি নেই বিছানা থেকে নেমে স্ত্রীর হাত থেকে মেয়েকে রক্ষা করার।

[চলবে]

সর্বশেষ খবর