শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কবিদের কথা

কবি-সাহিত্যিকরা কলমের আঁচড়ে পুষ্টি জুগিয়েছেন পাঠকের মনে। হৃদয় করেছেন পরিতৃপ্ত। যা পরবর্তীকালে বাংলা ভাষাভাষীর মনে আনে মানবপ্রেম, ন্যায়নীতি, উত্তম আদর্শ ও শিষ্টাচার। বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত মুসলিম কবির সংখ্যা কম নয়। আজ উল্লেখযোগ্য কয়েকজনকে নিয়ে এ আয়োজন-

 

শাহ মোহাম্মদ সগীর

কাব্যগাথা ইউসুফ-জুলেখা গ্রন্থের নাম শোনেননি এমন সাহিত্যপ্রেমী বোধ হয় কমই আছে। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না, এর রচয়িতা কে? তিনি প্রাচীনতম মুসলিম কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর।

আনুমানিক ১৩-১৪ শতকের সময় বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি ছিলেন তিনি। ধারণা করা হয়, গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহর রাজত্বকালে (১৩৮৯-১৪১১ খ্রিস্টাব্দ) তিনি কাব্যগাথা ‘ইউসুফ-জুলেখা’ রচনা করেন। কবি ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজকর্মচারী। এ সময় তিনি বন্দনা গীতি কবিতাও রচনা করেন। যেখানে বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ফুটে ওঠে। তুলে ধরেন শাসকের স্তুতিও। কাব্যরস পরিবেশন অপেক্ষা ধর্মীয় প্রেরণা সৃষ্টির প্রতিই শাহ মোহাম্মদ সগীরের অধিক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। সে যুগে বাংলা ভাষাভাষীদের রম্যরসে ভরা ধর্মকাহিনি রচনা করার মধ্যে কবির সৎসাহসের পরিচয় মেলে। বাইবেল-কোরআন কিংবা ফেরদৌসী-জামির অনুসরণে কাহিনি-কাব্যটি কল্পিত হলেও বাংলাদেশ ও বাঙালি-জীবনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে।

ধারণা করা হয়, কাব্যটি আনুমানিক পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দশকে রচনা করা হয়। ড. এনামুল হকের মতে, কবি শাহ মোহাম্মদ সগীর ইউসুফ-জুলেখার মূল কাহিনি সংগ্রহ করেন ‘কিতাবুল কোরআন’ থেকে। কিন্তু কাব্যটি ধর্মীয় উপাখ্যান নয়, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান যা মানবজীবন রসে সিক্ত। শাহ মোহাম্মদ সগীর মূলত কোরআনে বর্ণিত ইউসুফ-জুলেখাকে নতুন আকৃতিতে মোহনীয় মূর্তি গড়ে তুলেছিলেন।

 

সৈয়দ আলাওল

সৈয়দ আলাওল ছিলেন সপ্তদশ শতকের কবি। কারও মতে, তিনি ফরিদপুরের বাসিন্দা আবার কারও মতে চট্টগ্রামের। কবি আলাওল আরাকান রাজসভার অন্যতম কবি হিসাবে আবির্ভূত হলেও মধ্যযুগের সমগ্র বাঙালি কবির মধ্যে শিরোমণি ছিলেন তিনি। আরবি ফারসি হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি সুপন্ডিত ছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। পাশাপাশি যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, আধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র-ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তবে কবির জীবনে ছিল সুখ-দুঃখের টানাপোড়েন। কবি আলাওলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ পদ্মাবতী। রোসাঙ্গ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয়ে ও অনুপ্রেরণায় আলাওল পদ্মাবতী রচনা করেন। যা ছিল কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর হিন্দি কাব্য পদুমাবৎ-এর অনুবাদ। সৈয়দ মুসার উৎসাহে সয়ফল মুলুক ও বদিউজ্জামাল নামক পারস্য গ্রন্থ অনুবাদ করেন। মধ্যযুগের আরেক কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য শেষ করেন আলাওল, এর নাম সতীময়না। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে তোহ্ফা, দারাসেকেন্দারনামা প্রভৃতি।

 

দোনাগাজী চৌধুরী

মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যকে যে কয়েকজন সাহিত্যিক সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল করেছেন তাদের মধ্যে কবি দোনাগাজী চৌধুরী অন্যতম। তিনি বাংলায় ‘আলিফ লায়লা’ অবলম্বনে প্রথম রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ রচনা করেন। তাঁর পরে মহাকবি আলাওল (১৫৯৭-১৯৭৩) ও মালে মুহম্মদ (ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ) একই কাহিনি অবলম্বনে কাব্য রচনা করেন। গবেষকরা মনে করেন, দোনাগাজী আনুমানিক ১৬ শতকের মধ্যভাগ থেকে ১৭ শতকের প্রথমভাগের কবি। নিজের লেখা কাব্যে, পুথিতে বা অন্য কেউ তাঁর জন্মসাল উল্লেখ করেননি। ড. এনামুল হক মনে করেন, ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে দোনাগাজীর আবির্ভাব। দোনাগাজীর জন্মস্থান নিয়েও কয়েকটি তথ্য প্রচলিত রয়েছে। কাব্যে তিনি জানিয়েছেন, ‘দোল্লাই’ দেশে তার নিবাস। দোল্লাই পরগনা বর্তমান কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত। দোনাগাজীর ‘চৌধুরী’ উপাধি এবং কাব্যে ক্ষুরধার প্রতিভা দেখে আহমদ শরীফ অনুমান করেছেন, ‘তিনি ধনী-মানি বংশের       সন্তান। দেশ প্রচলিত বিদ্যা ও সংস্কৃতিতে তিনি অভিজ্ঞ ছিলেন।’ দোনাগাজী রচিত ‘সয়ফুল মুলুক-বদিউজ্জামাল’ কাব্যের শুরুতে কেবল স্তুতিপর্বে আল্লাহ-রসুল-পীরের বন্দনা রয়েছে। কোনো রাজা, আমলা বা অন্য কারও প্রশংসা করা হয়নি। অর্থাৎ কোনো পৃষ্ঠপোষকতা কবি নেননি। হয়তো নিজে বিত্তবান হওয়ায় পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি। এ থেকে অনুমান করা যায়, তার কাব্য রচনার পেছনে আত্মোৎসাহ কাজ করেছে।

সর্বশেষ খবর