শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব-৪

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পূর্বপ্রকাশের পর

প্রতিযোগিতা ভালোই হয়েছে, ১৭ ভোটের ব্যবধানে মন্টু ভাই জিতে গেছেন। রঙ্গ থিয়েটারের থিম সংটা মন্টু ভাই-ই ঠিক করে দিয়েছেন : কতই বড় দেখি দুনিয়ায়।

মন্টু ভাই যে বিয়ে করছেন আমাদের সামান্যতম ধারণাও ছিল না। আমাদের সম্বিত ফেরে বাসার সামনে ব্যান্ড পার্টির তুমুল বাদনে।

বাবা বলল, ঘটনা কী? মা-ও দোতলার জানালায় এলো, আমি আর শেহেরজাদও। বাদনের আওয়াজ আরও চড়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু ব্যান্ড পার্টি আমাদের বাড়ির গেটে কেন?

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল ও মাই গড! কাকে দেখছি! রঙ্গ থিয়েটারের সভাপতির পরনে নাটকে ব্যবহার করা পাঞ্জাবি এবং মাথায় পাগড়ি, এটা ঠিক বরের পাগড়ি নয়, এটা নাটকের রাজা-বাদশাহদের মাথার পাগড়ি, মন্টু ভাইকে নিয়ে মিছিল এদিকে আসছে। তার ঘাড়ে শোয়ানো একটি শিশু, সম্ভবত ঘুমন্ত। তার আঙুল ধরা আর একটি শিশু, অপেক্ষাকৃত বড়, মন্টু ভাইয়ের ঠিক পেছনে কনের পোশাক পরা এক নারী, সম্ভবত এটা রঙ্গ থিয়েটারের কোনো রাজকন্যার জন্য নির্ধারিত পোশাক। সবচেয়ে ছোট শিশুটি তার কোলে।

বাবা বলল, কী ঘটনা? নাটক নাকি?

আমি বলি, মনে হয় পথনাটক।

মা বলল, আমার ভয় লাগছে।

শেহেরজাদ সময় নষ্ট করার মেয়ে নয়, তবু বলল, আমি নিচে গিয়ে দেখে আসছি।

ব্যান্ড পার্টি সুর তুলেছে :

মালকা বানুর দেশেরে বিয়ার বাদ্য আল্লা বাজেরে

মনু মিয়ার দেশেরে বিয়ার বাদ্য আল্লা বাজেরে

মালকার বিয়া হইব মনু মিয়ার বিয়া হইব

মালকা বানুর সঙ্গে রে।

বাদকরা গেটে ধাক্কা দেয়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আবুল বাশার মিরধা গেটের একাংশ খুলে মাথা বের করে। মন্টু হুকুম দেয় গেট খোলো আবুল বাশার মিরধা।

খুলি ভাইজান, বলে গেটের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে। এটা কি আসলে নাটক না অন্য কিছু। যার সময় এত অমূল্য, পড়াশোনার ক্ষতি হবে এ আশঙ্কায় যে প্রশ্নের জবাবে হাঁ কিংবা না-এর বেশি কিছু বলে না সেই শেহেরজাদ আবুল বাশার মিরধার মতো ক্ষমতাশালী গেটম্যানকে ঠেলে বেরিয়ে গিয়ে মন্টু ভাইকে জড়িয়ে ধরল। মন্টু ভাইয়ের পেছন পেছন আসা রঙ্গ থিয়েটারের সদস্যরা প্রবল করতালি দিল এবং ব্যান্ড পার্টি নতুন উদ্যমে আবার সুর চড়াল :

মালকা বানুর বিয়ারে মনু মিয়ার সঙ্গেরে

মালকা বানুর রূপেরে ঝিলমিল ঝিলমিল আল্লা করেরে।

মন্টু ভাই শেহেরজাদকে কী বলল, দোতলার জানালা থেকে বলা মুশকিল কিন্তু দেখা গেল শেহেরজাদ তাকে ছেড়ে মাথা নুইয়ে কনে সাজের মহিলাটির পা ছুঁয়ে সালাম করল এবং তার কোলের আট-নয় মাসের শিশুটিকে কোলে নিয়ে মিছিলের একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। দুই কদম এগিয়ে গেট খোলার জন্য আবুল বাশারকে হুকুম দিলে হতভম্ব হয়ে দ্রুত গেট খুলে দিল, অমনি গগনবিদারী শব্দ করে বেশ কটি পটকা ফাটল, তাতে মন্টু ভাইয়ের কোলের শিশু এবং শেহেরজাদের কোলের শিশুর ঘুম ভেঙে গেল। গেট এবং আমাদের চারতলা বাড়ির দূরত্ব বড়জোর কুড়ি ফুট। গেটের ভিতর ঢুকল শিশুকোলে শেহেরজাদ আর একটি শিশুকোলে মন্টু ভাই এবং অপেক্ষাকৃত বড় শিশুর আঙুল ধরে সম্ভবত রঙ্গ থিয়েটারের নায়িকা।

আমি জিজ্ঞেস করি, সভাপতি কাকে বিয়ে করেছেন?

জবাব দিল, আমি জানি একজন মহিলাকেই।

আমি বলি, ধ্যাৎ, মহিলাকেই তো বিয়ে করবে।

বালকটি বলল, তাই তো করেছেন।

আমি আবারও বলি, বুঝলাম, কিন্তু মহিলাটি কে?

বালক বলল, দেখেননি? বিয়ের কনের পোশাক পরা!

না জানলে বলো, জানি না।

না জানার কী আছে?

দুজন ধরাধরি করে বড় দুটি পাত্র এনে ঠিক গেট বরাবর রাখল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভিতরে জিলিপি। কেউ একজন হ্যান্ডমাইক উঁচিয়ে বলল, অ্যাটেনশন। এখন মোনাজাত হবে। তারপর লাইন ধরে প্রত্যেকে তবারক গ্রহণ করবেন। সবার জন্য তবারক আনা হয়েছে, কেউ বাদ পড়বেন না, তবে কেউই দুটোর বেশি তবারক নেবেন না।

আমরা ওপর থেকে দেখলাম গেটের ভিতরে ঢোকা তিন শিশুকে নিয়ে বড় তিনজনও দাঁড়িয়ে গেছে। হ্যান্ডমাইকটি নিয়ে একজন মসজিদের পেশ ইমাম সাহেবের সামনে ধরলে তিনি বলতে শুরু করলেন, আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়াদেনা মাওলানা মুহাম্মদ... হে আল্লাহ! কিছুক্ষণ আগে আপনাকে হাজিরনাজির জেনে সাক্ষীদের সামনে ১ লাখ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য করে মোস্তফা হোসেন মন্টু ও নওশেবা ফ্যান্সি খানমের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহ গাফুরুর রহিম আপনি এই বিবাহ কবুল ও মঞ্জুর করুন। মোস্তফা হোসেন মন্টু এবং নওশেবা ফ্যান্সি খানম উভয়েই বালেগ ও বালেগা, উভয়ে স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে এই বিবাহে সম্মতি জ্ঞাপন করেছে।

মোনাজাতের মাঝখানে আমি শুনলাম বাবা অনুনাসিক ঘোৎ ঘোৎ দুটি শব্দ করে বলল, একি! এসব কী পাগলামি চলছে?

আর ওদিকে মা দুই হাত তুলে মোনাজাতে শরিক হয়েছে।

ইমাম সাহেব বলে যাচ্ছেন, হে আল্লাহ! আপনি রহমানুর রহিম, হে আল্লাহ আলেমুল গায়েব। আপনার হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়তে পারে না। হে আল্লাহ! আপনার রহমতে নববিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর নেক সহবাসে সত্যিকার ইমানদার খোদাবন্দ সন্তান পয়দা করার তৌফিক দান করুন।

মোনাজাতের শেষ বাক্যটি শুনে আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। বিশেষ করে নেক সহবাস শব্দ দুটি।

আমরা তখন একটি ঘোরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বাবা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, মোস্তফা হোসেন মন্টুকে এখনই বাড়ি থেকে বের করে দাও। এ বাড়িতে তার মতো কুপুত্রের প্রয়োজন নেই। গঞ্জিকা সেবন করলেও আমার মেহরাব হোসেন মঞ্জু তার চেয়ে হাজার গুণ ভালো।

বাবা গাঁজা খাওয়ার কথাটা বলতে বিব্রতবোধ করেন, বলেন গঞ্জিকা সেবন। অথচ তিন মাস আগেই গভীর রাত পর্যন্ত মন্টু ভাই বাসায় না-ফেরার পরও বাবা বলেছেন, তবু সে মেহরাব হোসেন মঞ্জুর চেয়ে হাজার গুণ ভালো, সে তো আর গঞ্জিকা সেবন করে না।

এমন সময় দরজায় ধাক্কা। আমাদের কলিং বেল অকেজো প্রায় সাড়ে তিন মাস। আমরা ধাক্কায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। আমিই দরজা খুলি। কাঁঠালপাতা দিয়ে বানানো একটি ঠোঙায় কিছু জিলিপি, অল্পবয়সী একটি বালক আমার হাতে দিয়ে বলল, জিলিপি দুটো করে খাবেন। আমাদের সভাপতি, মানে রঙ্গ থিয়েটারের সভাপতি মোস্তফা হোসেন মন্টুর বিয়ের জিলিপি।

আমি জিজ্ঞেস করি, সভাপতি কাকে বিয়ে করেছেন?

জবাব দিল, আমি জানি একজন মহিলাকেই।

আমি বলি, ধ্যাৎ, মহিলাকেই তো বিয়ে করবে।

বালকটি বলল, তাই তো করেছেন।

আমি আবারও বলি, বুঝলাম, কিন্তু মহিলাটি কে?

বালক বলল, দেখেননি? বিয়ের কনের পোশাক পরা!

না জানলে বলো, জানি না।

না জানার কী আছে?

আমি দরজা বন্ধ করে দিই। একটা জিলিপিতে কামড় বসিয়ে ঠোঙাটা মাকে দিই, মন্টু ভাইয়ের বিয়ের মিষ্টি খাও।

মা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

বাবার কাছেও জিলিপির ঠোঙাটা নিয়ে যেতাম, কিন্তু তার মুড খুব সুবিধের নয়। ধমক খেতে পারি। জিলিপির খোলা ঠোঙা টেবিলের ঠিক মাঝখানে রেখে আবার একটা তুলে নিই। মিষ্টি আমার বরাবরই প্রিয়। ঘরে মিষ্টি না থাকলে আমি গুড় বা চিনি যা পাই তাই খাই।

আবারও দরজায় ধাক্কা। তখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। শেহেরজাদ এসেছে কোলে ছোট বাচ্চা মুখে তৃপ্তির হাসি।

আমি ধমক দিই, তোর না এত পড়াশোনা! কথা বলার সময় পাস না। এসব কী চলছে? এর নাম পড়াশোনা?

শেহেরজাদ বলল, আমি তিন দিনের জন্য ডে অফ নিয়েছি।

কীভাবে?

স্বাভাবিকভাবে। নিজেকেই বলেছি, বিশেষ প্রয়োজনে তিন দিন পড়াশোনা থেকে বিরতি নিতে চাই।

আমি বলি, ফাজলেমি শুরু করেছিস?

তিন দিনের মধ্যে মন্টু ভাই একটা ডিসিশন নিয়ে নেবে।

কীসের ডিসিশন?

ভাবি আর বাচ্চাদের নিয়ে এ বাড়িতে থাকবে না একেবারে চলে যাবে।

কথা শুনে মা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, একেবারে চলে যাবে মানে?

তা ছাড়া আর কী? সিদ্ধান্ত এখনো নেয়নি, তিন দিন তোমাদের মানে আমাদের সবার অ্যাটিচিউড পরীক্ষা করবে।

মা জিজ্ঞেস করে, অ্যাটিচিউড আবার কী?

সম্ভবত মা অ্যাটিচিউড মানে জানে না, অথবা এমনিতেই বলার জন্য কথাটা বলেছে। মা হাত তুলে মোনাজাতে শরিক হয়েছে আমি নিজে দেখেছি। তবু বললাম, আমাদের আচার-আচরণ এবং ভাবি ও বাচ্চাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে অ্যাটিচিউড।

মা আবার বলল, মানে?

আমি বললাম, মা আমি তো সহজ বাংলাতেই বলেছি। অ্যাটিচিউড মানে হাবভাব। তার মানে তুমি, বাবা, মঞ্জু ভাইয়া, আমি, শেহেরজাদ ভাবিকে এবং বাচ্চাদের কীভাবে এবং কতটা অ্যাকসেপ্ট করব সেটা বুঝে ডিসিশন নেবে।

মা জিজ্ঞেস করল বাচ্চা মানে? 

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর