শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাজবাড়ীর রাজার পূজা

নেহাল আহমেদ

রাজবাড়ীর রাজার পূজা

নির্মাণকাল : ১৭৯০ সাল। স্থান : লক্ষ্মীকোল, রাজবাড়ী। বিস্তৃতি : ৬০ একর। সম্পূর্ণ ধ্বংস : ১৯৮০ সাল

‘আমার স্মৃতিকথা’য় ত্রৈলোক্যনাথ লিখেছেন,

কাশিমনগর পরগনার পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চল, (পদ্মা তখন লক্ষ্মীকোল থেকে ৬ মাইল/প্রায় ১০ কিমি উত্তর দিয়ে প্রবহমান ছিল), সূর্যনগর, দিনাজপুর, ভুবনেশ্বর, কলিকাতা, কাবিলপুর পরগনায় সূর্যকূমারের জমিদারি প্রতিষ্ঠা পায়। রাজপ্রাসাদ ও রাজার বাড়ির নাম ছিল দেশখ্যাত। প্রায় ৬০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাসাদ, অতিথিশালা, পোস্ট অফিস, আঙিনা, বাগানবাড়ি, শান বাঁধানো পুকুরঘাট, টোল, বৈঠকখানা, অফিস কর্মচারী, পাইক পেয়াদা, গোশালা, আস্তাবল নিয়ে রাজার বাড়ি ছিল জমজমাট। এসব জমিদারি থেকে লক্ষ্মীকোল এস্টেটের বার্ষিক আয় তখনকার দিনে ছিল প্রায় দেড় লাখ টাকা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দোতলা বিশাল এই জমিদারবাড়িতে অনেক কক্ষ ছিল যার প্রায় সবকটিই পাবেন কারুকার্যের ছোঁয়া। এই জমিদারবাড়িতে ছিল কাছারিঘর, অতিথিশালা, নাচঘর, পূজামণ্ডপ, বৈঠকখানা, ভাঁড়ারসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা অংশ। হাতিশালে হাতি থাকত ঘোড়াশালে ঘোড়া। ১৯৫৪ সালের রাজবাড়িতে রাজার দুর্গাপূজার তথ্যকথা জানা গেলেও তার আগ থেকেই এই প্রাসাদে পূজা হতো আর এটিই সম্ভবত রাজবাড়ীর প্রাচীনতম দুর্গোৎসব।

রানিমাতা শরৎসুন্দরী শুদ্ধাচারে রাজবাড়ির দুর্গাপূজা তদারকি করতেন। তিনি অতিথিদের চিত্তবিনোদনের দেশি প্রজাদের বিনোদনের জন্য পূজা উপলক্ষে যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। রাজার বাড়ির শেষ দিনগুলোর পূজা উদযাপনের প্রত্যক্ষদর্শী দুলাল দত্ত জানান, তখন পূজায় ১০৮টি খাসি কাটা হতো; তৈরি হতো নানান মিটান্ন দ্রব্য এবং পুরোহিত ছিলেন তারাশঙ্কর চক্রবর্তী। বাড়ির পূজায় বাসভবনে রানি মা এসব নিজেই তদারকি করতেন। দুর্গাপূজার আয়োজন ছিল অনেক বড়। কলকাতা থেকে নামকরা শিল্পীরা আসতেন। নানান বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল, পুতুলনাচ হতো, ছিল যাত্রাপালা। সারা রাত আমরা যাত্রা দেখতাম। আমরা তখন শরৎসুন্দরী স্কুলে পড়তাম। এখন যেটা লক্ষ্মীকোল সরকারি স্কুল সেটাই ছিল শরৎসুন্দরী স্কুল।

সচরাচর রাজা বাদশাহদের যে রকমভাবে অত্যাচারী হিসেবে বইতে উপস্থাপন করা হয় তার বিপরীতে সূর্যকুমার একজন তেজস্বী অথচ কোমল হৃদয়ের মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত। প্রতাপশালী ব্রিটিশ রাজার কাছে তিনি মাথা নোয়াবার পাত্র ছিলেন না। স্বদেশি ও স্বরাজ আন্দোলনে পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। জাতীয় চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। একবার বড়লাট বলছিলেন- ‘তিনি একজন রাজা বটে? অনেকে মনে করেন সেই ঘটনা থেকে রাজা বলে পরিচিত কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। সূর্যকূমারের ব্যক্তিত্ব, জনহিতকর কাজ, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ এবং প্রজা প্রেমের জন্য ১৮৮০-এর দশকে করোনেশনের মাধ্যমে তাকে ‘রাজা’ উপাধি দেওয়া হয়। দিনাক সোহানী কবিরের লেখা ‘পূর্ববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯২৭ সালের ১ অক্টোবর গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি তৃতীয় শ্রেণির ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। পূজা উপলক্ষে ছিল এই বিশেষ ব্যবস্থা। গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত ১২৮ মাইল দূরত্বের জন্য নামমাত্র ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। মাথাপিছু ৪ টাকা মাত্র। এই বিশেষ ট্রেনটি চারটি স্টেশনে থামার ব্যবস্থা রাখা হয়। এ ছাড়া কলকাতা পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া, প্রধান দর্শনীয় স্থানের জন্য গেটের ভাড়া, কালীঘাটের জন্য পূজার ফি, রেলওয়ে নির্মিত নিজস্ব সিনেমার একটি টিকিট ছাড়াও তিন বেলা ফ্রি খাওয়ার ব্যবস্থা করে। উল্লেখ্য, ওই ট্রেনে যে ৬৩৯ জন যাত্রী ভ্রমণ করে, তন্মধ্যে ৬১৯ জন ইতিপূর্বে কখনো কলকাতায় যায়নি এবং ১৩০ জনের সেটাই ছিল প্রথম রেলযাত্রা। ১৯২৭ সালের পর থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে পূজা উপলক্ষে এই ট্রেনের যাত্রা অব্যাহত থাকে। ইত্যবসরে ব্রিটিশ আমল পার হয়ে পাকিস্তান আমল কেটেছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর সেই তৃতীয় শ্রেণির ট্রেন, সিনেমার টিকিট আর তিন বেলা ফ্রি খাওয়া এখন শুধুই স্মৃতি।

রাজবাড়ী জেলায় এখন অনেক জায়গায় দুর্গাপূজা হয়। রাজার বাড়ির পূজা এখন শুধুই ইতিহাস অথবা অধরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর