শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
পর্ব-৮

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পূর্ব প্রকাশের পর

মাসে একবার, কখনো দুবার বের হয়ে ব্যাংক থেকে পরিমিত পরিমাণ টাকা তোলে। নীলক্ষেতে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে একটি দুটি বই কেনে, কারওয়ানবাজার কাঁচা মার্কেটের পেছনে জটাধারী এক নারীর কাছ থেকে কখনো দুই সপ্তাহ চলার মতো, কখনো মাস চলার মতো গাঁজা কেনে। খুশিমনে বাসায় চলে আসে। আমাকে বলেছে বার্ধক্য নিয়ে তার অনেক দুশ্চিন্তা। যদি কামাই করতে না পারে গাঁজার টাকা আসবে কোত্থেকে? সেজন্য একটা পেনশন স্কিম খুলেছে। প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা জমা দেয়। সঞ্চয়ের টাকা পেনশনের টাকা এসব হচ্ছে বিপদের দিনের বন্ধু।

তুমি কি মন্টু ভাইয়ের কাছে হেরে গেলে?

সময়ই সব বলে দেবে।

 

পাঁচ.

ভোর সাড়ে ৬টার দিকে দরজায় নক। শেহেরজাদ দরজা খুলতেই তাকে ঠেলে টিয়া ঘরে ঢুকে তৃপ্তির হাসি দেয়। তার দুই সন্তান ঘুমোচ্ছে। ইশারায় জানতে চায় শেহেরজাদ সত্যিই কি ঘুমোতে পেরেছে? বাচ্চারা কি তাকে খুব জ্বালিয়েছে? কৃতজ্ঞতার একটি আলিঙ্গন করে ওষুধ কোম্পানির বিনেপয়সায় দেওয়া একটি স্পাইরাল বাঁধাই খাতা শেহেরজাদকে দিয়ে যা বলতে চায় তা হচ্ছে, যে কথাগুলো শেহেরজাদ তার কাছে জানতে চাইতে পারে তাই লিখে এনেছে।

মন্টু নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড ছিল। পরনে বিয়ের পোশাক নিয়ে কাল রাতে যে ঘুমিয়েছিল সে ঘুম এখনো ভাঙেনি, বেশ নাক ডাকছে।

ইঙ্গিতে বলে গেল পিচ্চি দুটো বিশেষ করে ফ্ল্যামিঙ্গো ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে তাকে যেন নক করা হয়। ফ্ল্যামিঙ্গো ঘুম থেকে উঠেই কাঁদতে শুরু করে, এটা তার রুটিন কান্না। ডাহুক নিজের ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে পারে।

টিয়া বেরিয়ে যায়। শেহেরজাদ টিয়ার লেখা খাতাটি নিয়ে আবার শুয়ে পড়ে, এবার সুইচ অনই থাকে। পাতা ওল্টায়।

আমি এখনো তোমার নাম জানি না। কিন্তু তুমি আমার বাচ্চাদের জন্য অনেক করেছ। তোমার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। তোমার মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে যেমন কবে থেকে মোস্তফা হোসেন মন্টুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক, কেমন করে বিয়ে, আমার আগের হাজব্যান্ড কোথায় ইত্যাদি।

আমার লুকোবার তেমন কিছু নেই। আমার এই লেখার কথা তোমার যাকে বলতে ইচ্ছে হয় বলতে পারো, কেউ দেখতে চাইলে দেখাতেও পারো।

কেবল গত সন্ধ্যা থেকে মোস্তফা হোসেন আমার হাজব্যান্ড। তার আগে ছিলেন কাজী মশিউজ্জামান আকন্দ। তিনি শুধু নাটক করতেন। অভিনয় করতেন। আজ সিরাজউদ্দৌলার চরিত্রে, তো কাল তিতুমীরের, পরশু মীর জাফরের। সাধারণ চরিত্র নয় ঐতিহাসিক চরিত্র মানেই কাজী মশিউজ্জামান। এসব চরিত্রে অভিনয় করতে করতে আসল মানুষটা চরিত্রের ভিতর হারিয়ে যান। তিনি আমাদের শহরে রঙ্গ থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য রংতামাশার নাটকের মধ্য দিয়ে সমাজের অসংগতি, নেতাদের মিথ্যাচার ও ভণ্ডামি এসব মানুষের সামনে তুলে ধরা। তিনি নিজে অভিনয় করতেন, লিখতেন, নাটক পরিচালনা করতেন। আমাদের একজন বড় নেতা নদী থেকে বালু তুলে বিক্রি করতেন, বড় প্রজেক্টের প্রায় পুরোটাই খেয়ে ফেলতেন, তার বিরোধিতা যারা করতো তাদের টর্চার সেলে নিয়ে গরম ডিম ঢোকাতেন। সম্ভবত তার কথা মনে রেখেই মশিউজ্জামানের রঙ নাটক ‘গরম ডিম’ ছেলেরা মঞ্চে এনেছিল। নাটকের শেষ দিকে সবাই মিলে সেই নেতাকে ডিমের যন্ত্রণা দেওয়া শুরু করলে তিনি পালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু যেদিন যান দেখা যায় কেউ না কেউ ভীষণ গরম ডিম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনি পালাতে পারছেন না।

এই নাটক দুবার মঞ্চায়িত হওয়ার পর তাকে নেতার লোকজন ধরে নিয়ে গেল। নেতা জিজ্ঞেস করলেন, তুই কারে নিয়া গরম ডিম লিখছিলি? লোকজন বলল তুই নাকি আমাকে গরম ডিম দেওয়ার চেষ্টা করছিস?

মশিউজ্জামান বললেন, লোকজন যদি সত্যিই বুঝে থাকে তাহলে আমার নাটক সার্থক। তবে এটা আপনাকে নিয়ে নয়, আপনার সম্পর্কে আমি কতটাই বা জানি। আপনি নিজে নাটকটা দেখে সিদ্ধান্ত নিন, এই নাটকের জমরুদ খান আপনি না অন্য কেউ? আপনার নামের সঙ্গেও তো মিল নেই।

সে রাতেই নাটক মঞ্চস্থ করার সময় থিয়েটার আক্রান্ত হলো। নেতার লোকজন একটা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। তারা অবশ্যই মানুষ মারার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড ছুড়ে মারেনি। তাহলে থিয়েটারের ভিতর ছুড়তো। দু-এক জন আহত হলেও কেউ মারা যায়নি। নাটক গরম ডিম মঞ্চায়ন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়। পরদিনই নাশকতা সৃষ্টির মামলা হলো, মামলায় এক নম্বর আসামি কাজী মশিউজ্জামান আকন্দ গ্রেফতার হলেন, পরদিন আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন। রিমান্ডে থাকার সময় মশিউজ্জামান নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তার গ্রেনেড মজুদ দেখাতে নিয়ে যায়, সেখানে সন্ত্রাসীরা মশিউজ্জামানকে ছিনতাই করার চেষ্টা করে গুলি ছুড়তে থাকতে। পাল্টা গুলি ছোড়া হয়। এ সময় ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসী-দেশদ্রোহী মশিউজ্জামানের মৃত্যু হয়। আমাকে ডাকা হয় লাশ শনাক্ত করতে। দুধের শিশু কোলে নিয়ে আমি মর্গে যাই, লাশ শনাক্ত করে দিয়ে আসি। সেখানেই প্রথম দেখা মোস্তফা হোসেন মন্টুর সঙ্গে। তিনিও লাশ শনাক্ত করতে এসেছিলেন। রঙ্গ থিয়েটারের সভাপতি নির্বাচনে মন্টু সাহেবও ক্যান্ডিডেট ছিলেন, মাত্র ৭ ভোটে হেরে গেছেন যদিও তিনি বয়সে মশিউজ্জামানের চেয়ে বারো বছরের ছোট।

তিনি বললেন, এটা হত্যাকাণ্ড। মশিভাইকে তারা মেরে ফেলেছে।

তার মৃত্যুর তৃতীয় দিনেই নেতার লোকজন আমাকে মশিউজ্জামানের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে চেষ্টা চালায়। নাটকের লোকজন ছাড়া আমার নালিশ জানানোর আর কেউ ছিল না। মন্টু সাহেবই রঙ্গ থিয়েটারের লোকদের নিয়ে বাড়িতে আসেন, ডিসি সাহেবকে স্মারকপত্র দেন, অজ্ঞাতশত্রুর বিরুদ্ধে মামলাও করেন, আমি শুধু কাগজে সই করি। জেলায় ডিসি সাহেবও নেতার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাকে সরিয়ে দিতে নেতা টাকাপয়সাও খরচ করেন। কাজ হয়নি। ওসি সাহেবের বেলায়ও তাই। তিনি বার্তা দিয়ে দেন যদি মশিউজ্জামানের বাড়ি দখলের জন্য কেউ এগোয় এক নম্বর আসামি করা হবে নেতাকে। তারপর দেখা যাবে কার ক্ষমতা কতটুকু।

তিন মাস আগে রঙ্গ থিয়েটারের নির্বাহী কমিটি তাদের মেয়াদ ফুরোবার সময় পরবর্তী তিন বছরের জন্য নির্বাচন দেয়। সভাপতি পদে তিনজন প্রার্থীর মধ্যে মোস্তফা হোসেন মন্টুও ছিলেন। সাবেক সভাপতির স্ত্রী হিসেবে আমার কোনো বক্তব্য আছে কি না শুনতে অনেকেই এসেছিলেন। একজন উপদেষ্টা ৮০ বছর বয়সী কামরুদ্দিন আহমদ অনানুষ্ঠানিকভাবে বললেন, মা তোমার বয়স কম বিয়ে করে ফেলো নতুবা তোমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তো বিঘ্নিত হতে পারে। তার ওপর তোমার তিনটি মেয়ে বাচ্চা, ছেলে হলেও কথা ছিল।

আমি তার কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি এবং বলি তিন বাচ্চার মাকে এ পৃথিবীতে কেউ বিয়ে করবে না।

উপদেষ্টা বললেন, তা ঠিক, একটা বাচ্চা হলে কথা ছিল।

তখন একজন বলে উঠলেন, না ঠিক নয়। তিনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি বিয়ে করব।

আমি চোখ তুলে তাকাই মানুষটি কে? তিনি কি আমাকে দয়া করতে চাইছেন, নাকি এটা কথার কথা। দেখি সেই মানুষটিই, আমার সঙ্গে তার মর্গে দেখা হয়েছিল। বয়স আমার কাছাকাছি হবে বাইশ-তেইশ কি চব্বিশ। আমি তার কথা বিশ্বাস করিনি।      

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর