গভীর রাত। দেয়ালঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে চলছে। মনে হচ্ছে- হৃদপিণ্ডের শব্দটা প্রতিধ্বনি হয়ে দেয়ালঘড়িতে বাজছে। টিক টিক টিক। কেমন জানি ভয় লাগে। রাত কত হয়েছে? ফরিদ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন- দেড়টা বাজে। ছেলেটার জ্বর। এক শ দুই। ডাক্তার বলেছেন সামান্য ইনফ্লুয়েঞ্জা। এক শ চার ডিগ্রি পর্যন্ত তেমন ভয়ের কিছু নেই। ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কমে যাবে। জ্বর কমছে না। ফরিদ তাঁর ছেলের কপালে হাত রাখলেন। গা দিয়ে রীতিমতো আগুন বের হচ্ছে। গভীর দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকালেন। দেখলেন- ঠোঁট দুটো নীল হয়ে ফুলে উঠেছে। ঘুমের মধ্যে কোঁকাচ্ছে। ভারী ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে। ফরিদের খরাপ লাগাতে শুরু করল। শরীর অস্থির হয়ে উঠলো। আদরমাখা গলায় ছেলেকে ডাকলেন- সোনাবাবা, ও ময়না। ছোটন সাড়া দিলো না। আবার ডাক দিলেন- সোনাবাবা, ও ময়না। লাভ হলো না কোনো! ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। অসুখের সময় ঘুমের প্রয়োজন আছে। শরীর সেরে ওঠে। ফরিদ ধীর পায়ে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালেন। বারান্দা ঘেঁষে ডুমুর গাছ। গাছভর্তি থোকা থোকা ডুমুর ফল ধরেছে। তার পাশে বিশাল এক কদম গাছ। সারা গাছে বলের মতো ফুল ফুটে আছে। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই মন ভালো হয়ে যায়। ফরিদ চেয়ার টেনে বসলেন। সিগারেট ধরালেন। ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। বৃষ্টি নামতে পারে। সিগারেটে একটা টান দিতেই তার স্ত্রীর কথা মনে পড়তে লাগলো। সে বেঁচে থাকলে ছেলেটার এত অযত্ন হতো না। ঠিকমতো যত্ন হতো। জ্বরের সময় কত রকম সেবা করতো। মাথায় পানি ঢালতো। শরীর মুছে দিতো। ওষুধ খাওয়াতো। সারা রাত জেগে জেগে মাথার কাছে বসে থাকতো। রেবেকা!
এ রকম এক সুন্দর রাত্রিতে রেবেকাকে সে বিয়ে করে ঘরে এনেছিল। চেহারাটা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের মধ্যে ভেসে উঠল। ডান গালে ছোট্ট একটা তিল ছিল। যখন হাসতো মনে হতো সমস্ত শরীর দিয়ে হাসছে। শরীর দিয়ে হাসির একটা ঝরনা বয়ে যেত।
দিন কীভাবে কীভাবে চলে যায়। ফরিদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। দেখতে দেখতে তাদের বিয়ের এগারোটা বছর পার হয়ে গেলো। তাঁর মনে হলো- এই তো সেদিন সবকিছু ঘটল। অথচ রেবেকার মৃত্যুর পর্যন্ত সাত বছর হয়ে গেলো। মানুষ মারা যায়, তাঁর স্মৃতি চিরকাল রয়ে যায়। ফুল শয্যার রাতের কথা। স্ত্রীর হাত ধরে বলেছিলো- ভালোবাসি তোমায়। জনম জনম ধরে বাসবো। রেবেকা নিঃশব্দে হাসছিল। চোখের কোণে একটু তার জলও ছিল। সেও মিষ্টি করে বলেছিল- তবে বাঁধিয়া রাখিও আমায়।ডুমুর গাছ থেকে একটা বিশালাকৃতির বাদুড় উড়ে গেল। পাখা ঝাপটার শব্দে ফরিদ চমকে উঠলেন। উঠে দাঁড়ালেন। ঘরের দিকে গেলেন। ছেলেটা ঘুমের মধ্যে এখন আর কোঁকাচ্ছে না। তবে ভারী নিঃশ্বাসটা এখনো ফেলছে। জ্বরের কারণে মুখটা সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ফরিদ ছেলেকে আদরমাখা গলায় ডাক দিলেন- সোনাবাবা, ও ময়না। ময়না।
ছোটন সাড়া দিলো না। ফরিদ ছেলের কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলেন। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। থার্মোমিটারে মাপলেন। এক শ দুইয়ের একটু ওপরে। জ্বর তো কমছে না। আরও বাড়ছে। শরীর মুছে দিতে হবে।
সোনাবাবা, ও ময়না। ময়না।
ছোটন জেগে উঠলো। হুঁ। ফরিদ বললেন, সোনাবাবা খারাপ লাগছে?
হুঁ।
অনেক জ্বর তাই খারাপ লাগছে।
ফরিদ গামছা ভিজিয়ে ছেলের সমস্ত শরীর মুছে দিলেন। তুলে জোর করে স্যুপ খাওয়ালেন। ওষুধ খাওয়ালেন। ওষুধ খাওয়ার সময় ছোটন বমি করতে ধরলো। ফরিদ সঙ্গে সঙ্গে পানির গ্লাস মুখের সামনে এগিয়ে ধরলেন। ছোটন এক চুমুক পানি খেয়ে শুয়ে পড়ল। ফরিদ শরীরে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখলেন। জ্বর একটু কমেছে বোধ হয়। থার্মোমিটার দিয়ে মাপলেন। একটু কমেছে। এক শ দুইয়ের নিচে। ছেলেকে ডাকলেন- সোনাবাবা, ও ময়না। এখন কেমন লাগছে?
একটু ভালো।
ভালো।
জ্বর সেরে গেলে আরও ভালো লাগবে। ঘুমিয়ে পড়ো এখন।
ঘুমাবো না।
ঘুমাবে না?
না। গল্প করবো।
রাত জেগে গল্প করলে শরীর আরও খারাপ করবে। সকালে গল্প করবো। ঘুমাও এখন।
ছোটন চোখ বন্ধ করে থাকল। কিছুক্ষণ পর বাবাকে ডাকল-বাবা।
হুঁ।
আমি মারা যাচ্ছি কখন?
তুমি মারা যাচ্ছ মানে? ফরিদের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। ছোটন বলল, আমি ডাক্তারকে বলতে শুনেছি, আমার জ্বর একশ দুই ডিগ্রি।
এক শ দুই জ্বরে মানুষ মারা যায় না। তুমি খুব বোকার মতো কথা বলছ।
ছোটন কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলল, মা মারা গেল কেন? মার ও তো এক শ দুই জ্বর ছিল।
ফরিদ তাঁর ছেলেকে আর কোনো জবাব দিতে পারলেন না। শুধু বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন। ছোটন বলল, বাবা আমাকে একটা মা এনে দেওয়া যায় না।
মায়ের আদর পেতে ইচ্ছা করছে এখন?
হ্যাঁ, করছে।
কিন্তু মাকে তো এনে দেওয়া যায় না।
কেন যায় না?
মা একজনই হয়। মায়ের কোনো বিকল্প হয় না।
ছোটন চুপ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, বাবা মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়?
ফরিদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জানি না বাবা।
যদি জানতে তাহলে যেয়ে মাকে ধরে নিয়ে আসতাম।
ফরিদ তার ছেলের কথায় কেঁদে ফেলতে ধরলেন। বললেন, বাবা সোনা ঘুমিয়ে যাও তো এখন। অনেক কথা হয়েছে আর না। ফরিদ ছেলের কপালে, শরীরে হাত দিয়ে জ্বর দেখলেন। শরীর তো আবার গরম হয়ে উঠছে। জ্বর তো বাড়ছে। গা কি মুছে দেয়া বারবার ঠিক হবে? ঠান্ডা চাপ দিয়ে বসতে পারে। নিউমোনিয়া হতে পারে। ফরিদের শরীর দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। শরীরের তাপমাত্রা কমেও, কমছে না কেন? কী রকম জ্বর হলো! কাঁপা কাঁপা হাতে থার্মোমিটার নিলেন। জ্বর মাপতে লাগলেন। ছোটন বলল, বাবা তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?
ভয়? না তো।
আমি জানি তুমি কেন ভয় পাচ্ছ। আমি মারা যাব সে জন্য।
ছিঃ! বাজে কথা বলো না তো।
ফরিদ থার্মোমিটারের তাপমাত্রা দেখলেন। জ্বর এক শ দুইয়ের ঘরে। জ্বর তো বাড়ছে। শরীর মুছে দিতে লাগলেন। কপালে জলপট্টি দিলেন। ছোটনের ঘুম পেতে লাগলো। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে তাঁর বাবাকে বললো, বাবা মৃত্যু কি খুব কঠিন?
ফরিদ চমকে উঠলেন। কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, না। আমার মনে হয় খুব সহজ। ছোটন ঘুমিয়ে পড়ল। ফরিদ তাঁর ছেলের মাথার কাছে বসে রইলেন। বাকি রাতটুকু জেগে থাকতে হবে। হঠাৎ জ্বর আরও বাড়তে পারে। খেয়াল রাখতে হবে। জ্বরে কী সব প্রলাপ বকছে। আশ্চর্য! নয় বছর বয়স মাত্র। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। ফরিদ খাটের বাতায় হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসলেন।
বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নটা তার কাছে খুবই বাস্তব মনে হলো। তিনি দেখলেন- ছোটনের বিয়ে। গায়ে হলুদ দেওয়া হচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন সবাই এসেছে। ধুমধাম করছে। সানাই বাজছে। খুব আয়োজন। রেবেকা কি সুন্দর করে সেজেছে। ছেলের পাশে বসে আছে। মিষ্টি মিষ্টি হাসছে। স্বপ্নের ঠিক এই জায়গাতে ফরিদের ঘুম ভেঙে গেল। ঘোর কাটতে একটু সময় লাগলো। ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। কোলাহলে ধরণি জেগে উঠবে। ছোটনের জ্বর কি কমে গেছে? ফরিদ তাঁর ছেলের দিকে তাকালেন। কাঁপা কাঁপা হাতে কপাল স্পর্শ করলেন।