শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

যুদ্ধের সেরা বইগুলো

আবদুল কাদের

যুদ্ধের সেরা বইগুলো

জর্জ অরওয়েল থেকে জন রিড; খ্যাতিমান সাংবাদিকদের লেখা প্রতিবেদন এবং বইগুলোয় এমন ঘটনা তুলে ধরেছেন, যা মানব সংঘাতের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির সাক্ষী হয়ে আছে...

 

দ্য হিস্টোরিজ, হেরোডোটাস

দ্য হিস্টোরিজ-এর লেখক হেরোডোটাস। যিনি প্রথম ইতিহাস ও অনুসন্ধান- এ দুটি ধারণাকে সংযুক্ত করেন। ফলে ইতিহাস পরিপূর্ণভাবে হয়ে ওঠে তথ্যনির্ভর ও গবেষণার বিষয়। তেমনি একটি বই; দ্য হিস্টোরিজ। বইতে গ্রিক-পার্সিয়ান যুদ্ধের যে বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, তা কখনোই ভোলার মতো নয়। আড়াই হাজার বছর আগে তাঁর রচিত ‘দ্য হিস্টোরিজ’ প্রথম ইতিহাসগ্রন্থ বলে স্বীকৃত। বইয়ের পৃষ্ঠাজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন সমাজের বৈচিত্র্য, রীতিনীতি, সংস্কার, ভূগোল, ধর্মবোধ, যুদ্ধ এবং মিসরের রাজাদের সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনি। ‘দ্য হিস্টোরিজ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডের পুরোটাই যেন প্রাগৌতিহাসিক মিসরের বর্ণনা। লেখক মিসরের বর্ণনায় কেবল ভূগোল ও ইতিহাস বলে থেমে যাননি; এনেছেন রীতিনীতি, দেবদেবী, জীবনাচার, চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনকি নীল নদের নৌকার বিবরণ।

 

দ্য ফেস অব ওয়ার, মার্থা গেলহর্ন

অনেকের কাছে মার্থা গেলহর্ন উদার বা দয়ালু প্রতিবেদক নন। কিন্তু তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ও লেখা প্রতিবেদনগুলো ছিল চমৎকার। তিনি একজন যুদ্ধকালীন সংবাদদাতা। এই লেখক যুদ্ধের সময় সাধারণ লোকদের খুঁজে বের করতেন। কথা বলতেন তাদের সঙ্গে। তুলে ধরতেন তাদের জীবনধারা, জয়-পরাজয়ের কথা। প্রায় সাতটি যুদ্ধক্ষেত্রে এই নারী সাংবাদিক সরাসরি সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। ‘দ্য ফেস অব ওয়ার’ বইতে তিনি রণাঙ্গনে যা দেখেছেন তার ছোট একটি অংশ কেবল তুলে ধরেন। বইতে লেখিকা স্পেন, ফিনল্যান্ড, চীন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ, জাভা, ভিয়েতনাম, ইসরায়েল এবং মধ্য আমেরিকার কথা তুলে ধরেন। লেখিকা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করতেন না। কিন্তু তারা একসঙ্গে বেশ কিছু স্মরণীয় কাজ করেছিলেন।

 

টেন ডেইজ দ্যাট শক দ্য ওয়ার্ল্ড, জন রিড

জন রিড; একজন মার্কিন সাংবাদিক। রুশ বিপ্লবের সময় তিনি রাশিয়াতে বসবাস করতেন। সোভিয়েত আমলের বলশেভিক নেতাদের সঙ্গে তার সখ্য ছিল অতুলনীয়। দ্য ম্যাসেস থেকে প্রকাশিত তাঁর লেখা বই ‘টেন ডেইজ দ্যাট শক দ্য ওয়াল্ড’। যেখানে আনা হয়েছে- রুশ বিপ্লবের কথা, বলশেভিকদের কথা, লেনিন নামের সেই মানুষটির গল্প। এই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল জার শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, রাশিয়া-জাপান যুদ্ধে পরাজয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যর্থতার মাধ্যমে। লেনিন চেয়েছিলেন রুশ বিপ্লবের আদ্যোপান্ত নিয়ে লেখা বইটি কোটি কোটি সংখ্যায় ছাপা হোক, দুনিয়ার সব ভাষায় অনূদিত হোক। কিন্তু বইটি বেরোনোর মাত্র এক বছরের মধ্যেই জন রিড যান। মৃত্যুর পর তিনি পেয়েছিলেন বীরের মর্যাদা। তিনি ক্রেমলিনে সমাহিত একমাত্র মার্কিন নাগরিক।

 

দ্য থিংস দে ক্যারিড, টিম ওব্রায়েন

এটি এক উপন্যাস। তবে এটি প্রতিবেদন বইয়ের তালিকায় রাখা যায়। বইতে উল্লেখ করা হয়েছে ভিয়েতনামে অংশ নেওয়া মার্কিন বাহিনীর ২৩তম পদাতিক ডিভিশনের একটি প্লাটুন সম্পর্কে, এটি যুদ্ধকালীন সময় লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা। ‘দ্য থিংস দে ক্যারিড’ যুদ্ধ, বিভীষিকাময় স্মৃতি, কল্পনা এবং গল্প লেখনীর এক যুগান্তকারী উদাহরণ। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে আলফা কোম্পানির জিমি ক্রস, হেনরি ডবিন্স, র‌্যাট কিলি, মিচেল স্যান্ডার্স, নরম্যান বোকার, কিওয়া এবং টিম ও’ব্রায়েন-এর গল্প। তেতাল্লিশ বছর বয়সে টিম ও’ব্রায়ান লেখক ও বাবা হওয়ার উদ্দেশ্যে যুদ্ধের সময় ভিয়েতনাম সফর করে বেঁচে ফেরেন। তার দৃষ্টিতে এই যুদ্ধ ছিল ব্যাপক ধ্বংসাত্মক। বইটি ফ্রান্সের্র মর্যাদাপূর্ণ ‘প্রিক্স ডু মেইলিউর লিভর এট্রাঞ্জার’ এবং শিকাগো ট্রিবিউনের ‘হার্টল্যান্ড’ পুরস্কার জেতে।

 

হোমেজ টু কাতালোনিয়া, জর্জ অরওয়েল

১৯৩৬ সাল, স্বাধীনতা চেয়ে স্পেনের বার্সেলোনা ফের উতপ্ত হয়েছিল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে। বার্সেলোনার রাস্তায় বিকাল তিনটার পর গুলির লড়াই শুরু হয়ে গেল। শহরটাকে কয়েক দিন আগেও বিপ্লবের দিশারি মনে হচ্ছিল। ধোপদুরস্ত পোশাক কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না, শ্রমিকদের মোটা কাপড়ই সর্বেসর্বা। সবাই সবাইকে ‘কমরেড’ সম্বোধন করে। এই রকম সংঘাত দেখেই ব্রিটিশ লেখক ৮৭ বছর আগে লিখেছিলেন ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’। এখানে লেখক সর্বদা সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। শুধু কি তাই! লেখক নিজেও স্পেনের তৎকালীন ফ্যাসিস্ট শাসক ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। বইতে রচিত হয়েছে রণাঙ্গনের স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা, অকেজো অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদিসহ লেখকের নিজের অভিজ্ঞতা। যা রোমাঞ্চকর সর্বোত্তম সাহিত্যের উদাহারণ।

 

ব্ল্যাক ল্যাম্ব অ্যান্ড গ্রে ফ্যালকন, রেবেকা ওয়েস্ট

বইটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে লেখা। ১৯৩৭ সালে, নারীবাদী প্রবন্ধ লেখিকা রেবেকা ওয়েস্ট ‘যুগোস্লাভিয়ায়’ যাত্রা করেন। কিন্তু ইউরোপের এই দেশে তিনি নিজেকে প্রায়শই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। এই বইয়ে লেখিকা যুগোস্লাভিয়া ভাগ হয়ে যাওয়ার আগের দৃশ্যপট তুলে ধরার চেষ্টা করেন। মূলত যুদ্ধকালীন যুগোস্লাভিয়ার ইতিহাস, মানুষ এবং রাজনীতি তুলে ধরা হয়েছে ‘ব্ল্যাক ল্যাম্ব অ্যান্ড গ্রে ফ্যালকন’ বইতে। বিখ্যাত বইটিতে ভ্রমণ প্রবন্ধ, সাংস্কৃতিক ভাষ্য এবং ঐতিহাসিক অন্তর্দৃষ্টির এক দুর্দান্ত মিশ্রণ রয়েছে। যেখানে রয়েছে বলকানদের অস্থির ইতিহাস এবং এর জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্কের অনুসন্ধানমূলক নানা তথ্য। বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে পশ্চিমা দেশটির ইতিহাসের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণ করে এমন নানা সত্য তথ্য-উপাত্ত।

 

হিরোশিমা, জন হার্সি

৬ আগস্ট ১৯৪৫, জাপানের ‘হিরোশিমা’ পরিণত হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে। সেদিন সকালে এই শহরে ফেলা হয়েছিল নিউক্লিয়ার বোমা ‘লিটল বয়’। যা ছিল মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক, আফসোসযোগ্য ঘটনা। যে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বর্বরতা ও ভয়াবহতার। বইতে তুলে ধরা হয়েছে- বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতায় ছয় ব্যক্তির বেঁচে থাকার গল্প। বইটির লেখক- জন রিচার্ড হার্সি। এই লেখক ও সাংবাদিক বিস্ফোরণে বেঁচে যাওয়া অফিসকর্মী, ডাক্তার, অল্প বয়স্ক সার্জন, তিন সন্তানের জননী বিধবা নারী এবং দুই ধর্মজাজককে নিয়ে তদন্ত এবং সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য হিরোশিমায় গিয়েছিলেন। সেখানে পাওয়া তথ্যচিত্র নিয়ে ‘হিরোশিমা’ বইটি রচনা করেন। যার প্রকাশনা মানবজাতিকে হতবাক করেছিল। বইটি প্রায় সব কটি ভাষায় অনুবাদ এবং প্রকাশ করা হয়েছিল।

 

দ্য হিডেন ওয়ার, আর্টিওম বোরোভিক

১৯৯০-এর দশকের শুরুতে আর্টিওম বোরোভিক ছিলেন ‘রাশিয়ার সেরা সাংবাদিক। ২০০০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে রাশিয়ার বিশিষ্ট সাংবাদিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। এবারের বইটি তাঁর লেখা ‘দ্য হিডেন ওয়ার’। এই বইয়ের মাধ্যমে লেখক বিশ্বকে সোভিয়েত সামরিক বাহিনীর অস্ত্র সম্পর্কে প্রথম আভাস দিয়েছিলেন। বোরোভিক একজন সুন্দর, কাব্যিক লেখক; যিনি যুদ্ধের চূড়ান্ত অসহায়ত্বের গল্পগুলোকে তুলে ধরেন। লেখক তাঁর লেখায় অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে ভিনদেশি ভূমিতে যুদ্ধে সৈন্যদের হতাশার কথা লেখেন। বোরোভিক জানতেন, লিখেছেন অনেক কিছু। বইতে সোভিয়েত সামরিক শক্তির দুর্বলতা উন্মোচিত হয়েছিল, যা রাশিয়ায় তো বটেই, গোটা বিশ্বেও বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। রাশিয়ায় এক বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর