শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

সুফি কবিতা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

সুফি কবিতা

সুফি কবিতার বিস্ময়কর গভীরতা ও বৈচিত্র্য মানুষের চিত্তের খোরাক। সুফি কবিতা মানুষকে তার স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত করার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে, হতাশার মাঝে আশার সৃষ্টি করে এবং সৃষ্টিজগতের সেবায় আত্মনিয়োগে অনুপ্রেরণা জোগায়। এখানে সেরা কিছু সুফি কবির কবিতা উপস্থাপন করছি পাঠকের আধ্যাত্মিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টির জন্য, যাতে তারা আধ্যাত্মিকতার আলোতে নিজেদের আলোকিত করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন।

যে সব সুফি কবির কবিতা পাঠকের খেদমতে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করতে চাই, তাদের মধ্যে রয়েছেন : জালালুদ্দীন রুমি, ফরিদ-উদ-দীন আত্তার, হাফিজ শিরাজি, জামি, শেখ সা’দী, সানাই, ইউনুস এমরে, শাবিস্তানি, আনসারী, রাবিয়া বসরী, আবিল খাইর, সুলতান বাহু, ইবন আরাবি, বাবা কুহি, মনসুর আল-হাল্লাজ, আমির খুসরো, মঈনুদ্দীন হাসান চিশতি ও হযরত-ই-উফতাদে। এ তালিকায় আরও নাম যোগ হতে পারে।

এখানে জালালুদ্দীন রুমি, ফরিদ-উদ-দীন আত্তার, হাফিজ শিরাজি ও জামি’র কয়েকটি করে কবিতা ও কবিতাংশ এখানে উদ্ধৃত করছি। যাদের ভালো লাগবে তারা পড়তে পারেন, যারা এগুলো কাজে লাগাতে চান, তারা স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারেন।

মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি (১২০৭-১২৭৩) : সুফিবাদের সেরা কবি। রুমির প্রভাব জাতিগত পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিগত সাত শতক ধরে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার সমাদৃত। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতার অনুবাদ হয়েছে এবং বিভিন্ন ধারায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। রুমিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ‘সর্বাধিক বিক্রীত কবি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রুমির ‘মসনবী’কে ফারসি ভাষায় রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়।

আকাক্সক্ষাই রহস্যের মূল, যা স্বয়ং নিরাময় আনে

পৃথিবীর একমাত্র রীতি হলো যন্ত্রণা উপভোগ করা,

তোমার আকাক্সক্ষা অবশ্যই সুশৃঙ্খল হতে হবে

তুমি যা দেখতে চাও, সে জন্য প্রয়োজন ত্যাগ।

তুমি তোমার এই নতুন প্রেমে মৃত্যুবরণ করো,

তোমার পথ শুরু হয়েছে বিপরীত দিকে,

তুমি নিজেকে আকাশে পরিণত করো,

গাঁইতির আঘাতে কারাপ্রাচীর ভেঙে পালাও,

সহসা রঙিন হয়ে জন্মগ্রহণকারী কারও মতো

এখনই বের হয়ে এসো।

তুমি ঘন মেঘে ঢাকা, একপাশ দিয়ে

বের হয়ে এসো এবং মৃত্যুবরণ করো।

চুপ করে থাকো, চুপ থাকাই নিশ্চিত প্রমাণ

যে তুমি মৃত্যুবরণ করেছো।

তোমার পুরানো জীবন ছিল নীরবতা থেকে

উন্মত্ত এক দৌড়, এখন নীরবতার আকাশে

বাকহীন উজ্জ্বল পূর্ণিমা বের হয়ে আসছে।

ভোরের বাতাস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে,

ভোরের বাতাস ছড়ায় এর নির্মল সুবাস,

এখনই জেগে উঠে নিতে হবে সেই বাতাস,

সেই বাতাসই তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে,

বাতাস চলে যাওয়ার আগেই নিঃশ্বাস নাও।

সবার ওপর চেপে আছে ভাবনার ভারি বোঝা,

সে জন্য তারা এত হৃদযন্ত্রণা ও দুঃখে ভারাক্রান্ত,

অনেক সময় আমি ইচ্ছা করেই ভাবনার জন্য।

নিজেকে ছেড়ে দিই এবং যখন ভাবনা স্থির করি,

তখন ভাবনার আলোড়ন থেকে বের হয়ে আসি।

আমি আকাশের অনেক উঁচুতে ওড়া পাখির মতো,

এবং ভাবনা যেন একটি ডাঁস;

একটি ডাঁস কীভাবে আমাকে পরাজিত করবে?

আমি অবাক হয়ে ভাবি, হাজারটি ‘আমার’ মধ্যে

আসলে ‘আমি’ কোনটি?

আমার চিৎকার শোনো, আমার কণ্ঠ চেপে ধরো না,

তোমার ভাবনায় আমি পুরোপুরি মগ্ন।

আমার পথে ভাঙা কাঁচ বিছিয়ে রেখো না,

আমি কাঁচ গুঁড়িয়ে ধূলিকণায় পরিণত করবো,

আমি তোমার হাতের আয়না ছাড়া আর কিছু নই,

যার মধ্যে প্রতিফলিত তোমার কৃপা, বিষাদ ও ক্রোধ,

তুমি যদি ঘাসের ডগা অথবা ছোট্ট একটি ফুল হতে

আমি তোমার ছায়ায় আমার তাঁবু টানিয়ে নিতাম,

তোমার উপস্থিতি আমার বিশীর্ণ হৃদয়ে জীবন আনে।

তুমি সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করার মোমবাতি

আর আমি তোমার আলোর জন্য শূন্য এক পাত্র।

ফরিদ-উদ-দীন আত্তার (১১৪৫-১২২১) : সুফি কবি নিশাপুরের ফরিদ-উদ-দীন আত্তার ধর্মীয় বিষয়ের ওপর ফারসি সাহিত্যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তাঁর পুরো নাম আবু হামিদ বিন আবু বকর ইব্রাহিম। কিন্তু তিনি ফরিদ-উদ-দীন আত্তার বা নিশাপুরের আত্তার নামেই অধিক খ্যাত। ফারসি কবিতা ও সুফিবাদে তিনি স্থায়ী অবদান রেখে গেছে। ‘মানতিক-উত-তায়ের; (ইংরেজিতে ‘কনফারেন্স অফ দ্য বার্ডস) বা ‘পাখিদের সম্মেলন’ তার সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত, যা আল্লাহর সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য আত্মার অনুসন্ধানের এক দীর্ঘ রূপক কবিতা। এই কবিতার বর্ণনা অনুযায়ী, পৃথিবীর পাখিরা তাদের সার্বভৌম কে হবে তা নির্ধারণ করার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়, কারণ তাদের নেতৃত্ব দানের জন্য কেউ নেই। ‘হুপো’ পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী, সে পরামর্শ দেয় যে তাদের উচিত কিংবদন্তির ‘সিমুরগ’ (ফারসি রূপকথার বিশালাকৃতির পাখি) খুঁজে বের করা। হুপো পাখিদের নেতৃত্ব দেয়, যাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো মানবিক ত্রুটির প্রতিনিধিত্ব করে, যা মানবজাতিকে জ্ঞান আহরণে বাধা দেয়।

যতক্ষণ আমরা নিজেদের কাছে মৃত্যুবরণ না করবো,

এবং যতক্ষণ আমরা কারও বা কোনো কিছুর সাথে শনাক্ত না করবো,

ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মুক্ত হতে পারবো না,

যারা বাহ্যিক জীবনে আটকে থাকে আধ্যাত্মিক পথ তাদের জন্য নয়।

তোমার জীবন নিয়ে নেয়ার আগে জীবনের রহস্য জানতে চেষ্টা করো,

তুমি বেঁচে থাকতে যদি নিজেকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হও,

মরে গেলে কীভাবে তুমি তোমার অস্তিত্বের রহস্য বুঝবে?

গভীর রাতে এক সুফি কাঁদতে লাগলেন,

তিনি বললেন, “পৃথিবী এক আবদ্ধ কফিন, যার মধ্যে

আমরা বন্ধ এবং যেখানে আমাদের অজ্ঞতার মাধ্যমে,

মূর্খতা ও নিরানন্দে আমরা আমাদের জীবনযাপন করি।

মৃত্যু যখন কফিনের ঢাকনা খুলতে আসে,

যাদের ডানা আছে তারা অনন্ত পানে উড়ে যাবে,

আর যাদের ডানা নেই তারা কফিনে আটকে থাকবে।

অতএব বন্ধুরা, কফিনের ঢাকনা খুলে ফেলার আগেই,

আল্লাহর পথের পাখি হতে তোমার যা করার তা করো;

তোমার ডানা ও পালক গজানোর জন্য যা করার তা করো।”

সমগ্র পৃথিবী প্রেমের বড় এক বাজার,

যে কোনো কিছুর জন্য প্রেম দূরের অবশেষ রয়ে যায়,

চিরন্তন জ্ঞান সকল কিছুকে পরিণত করে প্রেমে,

তারা সবাই প্রেমের ওপর নির্ভর করে, প্রেমের দিকে ফিরে।

পৃথিবী, বেহেশত, সূর্য, চাঁদ, তারকারাজি সবাই

প্রেমের সন্ধান পায় তাদের কক্ষপথের কেন্দ্রে।

হাফিজ শিরাজি (১২৩০-১২৯১) : ইরানের শ্রেষ্ঠতম গীতিকবিতা রচয়িতা হাফিজ শিরাজির গযল সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যের উচ্চতায় আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে। তার পুরো নাম খাজে শামস-উদ-দীন মোহাম্মদ হাফিজ শিরাজি। শিরাজির কবিতা এখনো ইরানের সব স্তরের মানুষের মুখে মুখে প্রবাদের মতো উচ্চারিত হয়।

রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার প্রেমের মূল্যে

আমার মহাজাগতিক অস্তিত্বে অনুশোচনা করেছি,

আমাকে বলা হলো, “নিরাশ হয়ো না, তুমি অতি যত্নে

যে প্রেম চর্চা করেছো, তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ো না।

যদি তুমি উজ্জ্বল, ছদ্মবেশহীন ঈসার মতো বেহেশতে চলে যাও,

তোমার আলো থেকে একশটি রশ্মি সূর্যের কাছে পৌঁছবে।

তপস্যা এবং ভণ্ডামি দুটোই আগুনের মতো ধর্মের ফসল পুড়িয়ে দেয়।

হাফিজ, এই শেষ মহাজাগতিক যুক্তি পরিত্যাগ করো এবং বিনা বাধায়

আরোহণ করো তোমার প্রিয়তমের কাছে।

আমি অকপটে কথা বলি এবং তা আমাকে সুখী করে,

আমি প্রেমের দাস, আমি উভয় জগৎ থেকে মুক্ত,

আমি স্বর্গোদ্যানের পাখি, সেই বিচ্ছেদকে কীভাবে বর্ণনা করবো,

আমি দুর্ঘটনার এই সর্বনাশা ফাঁদে পড়েছি।

আমি ফেরেশতা ছিলাম, উচ্চতম বেহেশত ছিল আমার আবাস।

আদম আমাকে নিয়ে এসেছেন বিধ্বস্ত নগরীর এই আশ্রমে।

প্রেমের দীর্ঘ ‘আলিফ’ ছাড়া আমার হৃদয়ে আর কিছু নেই,

আমি কি করতে পারি? প্রভু আমাকে আর কোনো অক্ষর শেখাননি।

আল জামি (১৪১৪-১৪৯২) : পারস্যের শেষ মহান ধ্রুপদী কবি এবং একজন সুফি। তাঁর পুরো নাম ছিল মাওলানা নূর আল-দীন আবদ আল-রহমান অথবা আবদ আল-রাহমান নূর আল-দীন মুহাম্মদ দাশতি। কিন্তু তিনি ‘জামি’ নামেই খ্যাত ছিলেন। তিনি অসংখ্য গীতি কবিতা ও বর্ণনামূলক ছোট কবিতা লিখেছেন। গদ্যেও তার অনেক কাজ রয়েছে। জীবনের একটি পর্যায়ে তিনি কিছু কবিতা লেখেন, যেগুলো ধর্মদ্রোহমূলক ছিল বলে তিনি কঠোর সমালোচিতও হয়েছেন। তিনি বিস্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর কবিতার কথাও মানুষ ভুলে গিয়েছিল। অটোম্যান শাসনের সময় তার সাহিত্যকর্ম পুনরুজ্জীবন লাভ করে।

পৃথিবীতে আসার মুহূর্ত থেকে আমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ,

আমি সব সময় দ্বিধাহীনভাবে অনুসরণ করেছি প্রেমের পথ।

আমার জন্ম মুহূর্তেই মা তাঁর স্তন পুরে দেন আমার ঠোঁটে,

তিনি তাঁর দুধের সাথে আমাকে প্রেম পান করতে শেখান।

এখন আমার চুল মায়ের স্তনের সেই দুধের মতোই সাদা,

এখনও আমি প্রেমের দুধের স্বাদ পুষে রাখি হৃদয়ের গভীরে।

বার্ধক্যে বা যৌবনে প্রেমের সাথে তুলনীয় আর কিছু নেই,

প্রেম প্রতি মুহূর্তে সবিনয়ে বলে, ‘জামি তুমি প্রেমে বুড়ো হয়েছো’,

এখন প্রেমে অধ্যবসায়ী হও এবং শান্তভাবে প্রেমে মৃত্যুবরণ করো।

আমার হৃদয়কে পবিত্র এবং আমার আত্মাকে ত্রুটিমুক্ত করো, অশ্রু এবং দীর্ঘশ্বাসকে আমার প্রতিদিনের ভাগ্যে পরিণত করো, এবং আমাকে আমার সত্তা থেকে তোমার পথে চালিত করো, নিজের কাছে যে পরাজিত, আমি তাকে তোমার কাছে আনতে পারি!

পৃথিবী ও আমার শত্রুতা সৃষ্টি করে পার্থিব সঙ্গ থেকে দূরে রাখো,

অন্যান্য বস্তুর আকর্ষণ থেকে আমার হৃদয়কে ফিরিয়ে দাও,

যাতে তোমার প্রেমে আমার হৃদয় পুরোপুরি নিমগ্ন হতে পারে।

প্রভু, তুমি যদি বিভ্রান্তির জাল থেকে আমাকে মুক্ত করে

সত্যের পথ দেখাতে, তাহলে ব্যাপারটি কেমন হতো?

তুমি অগ্নি-উপাসকদের দলে দলে মুসলমান বানিয়েছো,

তাহলে তুমি আমাকে মুসলমান করোনি কেন?

এ জগৎ এবং পরবর্তী জগতের কামনা আমার নেই,

আমাকে দারিদ্র্যের মুকুট এবং অনুগ্রহ দান করো

তোমার রহস্যের শরীক হতে যে পথ তোমার দিকে

চালিত করবে না, সে পথ থেকে আমার মুখ ফিরিয়ে নাও।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর