শিরোনাম
শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
কৃষণ চন্দের গল্প

স্বপ্নদর্শী

ভাষান্তর : শহীদ সাবের তুহিন

স্বপ্নদর্শী

পূর্ব প্রকাশের পর

এ যুগের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এটাই যে প্রতিটি মানুষের একান্ত আপন একটি স্বপ্ন আছে এবং তার একদম কাছের মানুষটির অন্তরের স্বপ্নটার দিকে উঁকি মেরে দেখা বা বোঝার চেষ্টা করা বা সেই মানুষটির স্বপ্নের সঙ্গে নিজের স্বপ্নটাকে একাকার করে নেবার ফুরসত কারও নেই।

মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয় এই জীবন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষ তার নিজের নিজের স্বপ্নের বন্দুক উঁচিয়ে চলেছে কিংবা আপন আপন স্বপ্নের শৃঙ্খল আর হাতকড়া পরে ভাবে কেন সে মুক্ত নয়। সত্যি সত্যিই কি এদের চোখ আছে না কি এরা সর্বত্রই আপন স্বপ্নের প্রতিবিম্ব দেখে? এদের কি কান আছে না কি এরা সব জায়গায় আপন স্বপ্নেরই সংগীত শোনে? এদের কি হাত আছে না কি এরা সব জায়গায় শুধু আপন আপন স্বপ্নেরই জাল বোনে? এদের কি কোনো লক্ষ্য আছে না কি এরা সব জায়গায় আপন আপন স্বপ্নের পায়ে চলে এবং নিজের প্রেমিকের মুখেও নিজেরই স্বপ্নের মুখ খোঁজে? এ কেমনতর স্বার্থ যার জন্য ওরা বাইরের প্রতিটি সত্যকে, চাঁদকে, সূর্যকে, আকাশকে, মাটিকে, ঝরনাকে, ঊষার রক্তিমাকে এবং অন্তরের প্রতিটি সৌন্দর্যকে, মমতাকে, প্রেমকে, ভ্রাতৃত্ববোধকে, ঘনিষ্ঠতার প্রতিটি ক্ষেত্রকে এবং তার ফসলের প্রতিটি শীষকে আপন আপন স্বপ্নের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে আলাদা আলাদা করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে আর সবাই ভেবে অবাক হচ্ছে যে দুনিয়াটা কেন এগিয়ে চলছে না?

রোজকার এই খেঁচাখেঁচিতে তিতি বিরক্ত হয়ে ঠিক করলাম আত্মহত্যা করব। যখন কিছু মাথায় আসে না, সমস্যার কোনো সমাধান মেলে না, বাঁচার আর কোনো পথ পাওয়া যায় না, যখন জীবনটা প্রতি মুহূর্তে একটা ভারস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়, তখন মানুষ উপায়ান্তর না দেখে এমনি করে আত্মহত্যার কথা ভাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সেদিনকার ঝগড়াটাও অত্যন্ত দীর্ঘ এবং প্রচণ্ড তিক্ত হয়েছিল। কাজের ছেলেটি সেদিন একটা চিনেমাটির প্লেট ভেঙে ফেলেছিল আর তা নিয়ে রমা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেছিল আর ছেলেটিকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছিল।

‘চিনেমাটির একটা মামুলি প্লেটের জন্য কেন এত মাথা গরম করছ?’ আমি রমাকে ঠান্ডা করতে চেষ্টা করলাম।

‘তোমার কাছে মামুলি হতে পারে, আমার কাছে এ অনেক। যে সংসারে তিন তিনটে বছর ধরে চিনেমাটির একটাই সেট চলে আসছে। সেখানে একখানা প্লেট ভেঙে যাওয়া সামান্য ক্ষতি নয়।’

‘আর একটা আসবে।’

‘আর একটা আসবে, কিন্তু এ রকমটি তো আসবে না। আমার পুরো সেটটাকে বরবাদ করে দিয়েছে হারামজাদা শুদ্দুরটা।’

‘গালাগালি দিও না।’ আমি ধমক দিয়ে উঠি। ‘শূদ্র হয়েছে তো কি হয়েছে, শূদ্রও তো একটা মানুষ।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি তো ওর হয়ে বলবেই। এক শূদ্র অন্য শূদ্রের হয়ে বলবে না তো কে বলবে?’

আমি থ হয়ে গেলাম। কথাটা সত্য, কিন্তু এই সত্যকে আমি আজ অবধি রমার কাছে গোপন রেখেছি। রমাকে বিয়ে করব বলে, আমার ভালোবাসাকে সার্থক করব বলে আমি রমার কাছে রমার মা বাবার কাছে মিথ্যে বলেছিলাম। প্রেমের জন্য আমি নাম ভাঁড়িয়েছিলাম, জাতপাত, জ্ঞাতিকুটুম্বের খবরাখবর পর্যন্ত গোপন করেছিলাম এবং আজ অবধি আমার ধারণা ছিল রমা এ ব্যাপারে কিছু জানে না।

আমাকে নীরব দেখে রমা উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, ‘কই সাহস থাকে তো কর না দেখি অস্বীকার। একবার মুখ ফুটে না বলো না। তুমি ভেবেছিলে আমি কিছুই জানি না। ভেবেছিলে তোমার আসল পরিচয় আমার জানা নেই। আমাকে ঐ ল্যাংড়া সুরেন্দ্রের মা সব বলে দিয়েছেন। উনি তো তোমাদের বাপদাদা চৌদ্দপুরুষের খবর জানেন। উনি আমাকে বলেছেন তোমরা বাঁকেপুরের লোক নও, খেসলা গাঁয়ের তাঁতি তোমরা, তোমার বাপ ছিল তাঁতি, মাও ছিল তাঁতির মেয়ে, তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিলে শহরে আর কোনো মতে লেখাপড়া শিখে কৃষ্ণকান্ত শর্মা হয়ে গেছ, আর এ পোড়াকপালীকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফাঁসিয়ে নিয়েছ।’

‘ফাঁসিয়ে নিয়েছি না?’ আমি গরম হয়ে বললাম।

‘ফাঁসিয়ে নাওনি তো আর কি? আমি যদি ঘুণাক্ষরে একবার টের পেতাম যে তুমি জাতে ধুনুরি তাঁতি, নীচু জাত এবং তোমার চৌদ্দপুরুষের শিরায় কোনো ভদ্র বামুনের রক্ত নেই, তাহলে এক ক্ষত্রিয়ের মেয়ে হয়ে আমি কি তোমাকে আশকারা দিতাম? তোমাকে ভালোবাসতাম? তাহলে তোমার মুখে থুতু দিতাম না?’

শুনে রাগে আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। তড়াক করে উঠে হাঁ

করে বললাম, ‘বেশ তো দাও না থুতু আমার গায়ে। থুতু দাও আমার মুখের উপর, থুতু দাও তোমার প্রেম ভালোবাসার উপর, যে ভালোবাসা মানুষ দেখে না, দেখে তার জাতের লেবেলকে। যে তার চাকরি আর তার অসহায় অবস্থাটা দেখে না, শুধু নিজের কামনা বাসনার বিউগল বাজিয়ে সব সময় বাঁকা হাসি হাসার জন্য মুখিয়ে থাকে। ছ্যা, ছ্যা, এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো।’

বলেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে এলাম। রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছিল। ঠিক করে ফেলেছি আত্মহত্যা করব। আর বেঁচে থাকা বৃথা।

তারকানাথ রোড ধরে গিয়ে আমি কাটমারা মোড়ের দিকে ঘুরলাম, সেখান থেকে বাস টার্মিনাল পেরিয়ে গিয়ে সমুদ্রের ধারে এসে পড়লাম।

বাইরের মুক্ত বাতাসে এসে ঘরের গুমোট আর অন্ধকার থেকে দূরে সমুদ্রের তীর আমার চোখে বড় উজ্জ্বল আর ঝলমলে মনে হলো। সূর্য এখনো ডোবেনি, সাগর জলের সোনারঙ ঢেউয়ে কত কত মানুষ স্নান করছিল, খুশিতে হৈ চৈ করছিল।

মেয়েরা সুন্দর সুন্দর সাজ পোশাক পরে বেড়াতে এসেছিল। কেউ কেউ ছেলে কোলে করে কিংবা আপন আপন প্রেমিকের হাত ধরাধরি করে প্রেমগরবে গরবিনী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

ভাবলাম কাপড়চোপড় ছেড়েছুড়ে আমি একদম সোজা সমুদ্রে নেমে পড়ব, তারপর চান করতে করতে দূরে আরও দূরে চলে যাব, যেখান থেকে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না, ব্যস, কেউ টেরই পাবে না। একজন পাপীর ভার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে পৃথিবী। ঢেউয়ের উপর যেমন একটি বুদ্বুদ উঠে মিলিয়ে যায়, আমিও তেমনি চলে যাব। মিলিয়ে যাব।

ভেলপুরিওয়ালার দোকানে খদ্দেরদের ভিড়। সোনালি হলুদ নোনতা মুচমুচে চিপস আর সাদা সাদা কুরকুরে মুড়মুড়ে চিড়েভাজা, সবুজ সবুজ কাঁচালংকা আর টকটক ঝালঝাল চাটনি দেখে আমার জিভে জল আসতে শুরু করল।

আগে একটা ভেলপুরি খেয়ে নিই মনে মনে ভাবলাম।

ভেলপুরি খেয়ে আমি সামনে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। বালিতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জামা খুলতে শুরু করলাম। প্রথমে জামা খুলব, তারপর প্যান্ট, তারপর শুধু জাঙ্গিয়া পরে সোজা সমুদ্রে নেমে যাব, ব্যস সব খতম।

ইতিমধ্যে আমার চোখ পড়ল বেনারসি ফুচকাওয়ালার ঠেলাগাড়ির উপর। আলুর টিকিয়া ভাজা হচ্ছিল, তেলে শোঁ শোঁ আওয়াজ করতে করতে ওগুলো বাদামি রঙ ধরছিল। কাচের একটা বড় গোল বয়ম, সোনালি মচমচে ফুচকাতে ভরা, বারো মসলার জলের হাঁড়িটার চারদিকে বেলফুলের মালা জড়ানো আর ধপধপে সাদা দই বড়ার উপরে কাঁচালংকা আর লাল লংকার বাহার।

কটা ফুচকা খেয়ে নিই, আমি ভাবলাম, মরা তো পালিয়ে যাচ্ছে না।

ফুচকা খেয়ে বেশ মজা লাগল, ঠোঁট থেকে, নাক থেকে, চোখ থেকে যেন আগুন বের হচ্ছিল, আর জিভটা বারে বারে টাকরায় শব্দ করছিল। পেট ভরে খেলাম, খেয়ে এবার মরবার জন্য এগিয়ে গেলাম।

এগিয়ে সমুদ্রের একদম কিনারায় গিয়ে আমি আইসক্রিমওয়ালাকে দেখতে পেলাম। এলুমিনিয়ামের চুঙিতে ও কুলপি জমিয়েছে। ক্ষীরের কুলপি, পেস্তার ফুলপি আর বাদামের কুলপি।

জীবনে শেষ বারের মতো কুলপিও খেয়ে নিই, খাঁটি পাঞ্জাবি কুলপি, ভাবলাম আমি। ক্ষতি কি এতে, এর পরে তো মরা আছেই।

কুলপি খেয়ে আমার উৎসাহ দমে গেল। এমন মনে হলো যেন কেউ আমার মন আর মগজের উপর আইসক্রিম চাপিয়ে দিয়ে সমস্ত চেতনাকে এয়ারকন্ডিশনড্ করে দিয়েছে। মৃদু মৃদু বাতাসের খেলায় আমার ঘুম ঘুম ভাব হতে লাগল, ভেবে ভেবে অবাক লাগছিল, আমাকে কি মরতেই হবে? সত্যি সত্যিই মরতে হবে? আজ না মরে কি কাল মরা যায় না?

এমনি করে আমি জীবন আর মরণের দোলায় দুলছিলাম। এমন সময় কে এসে পেছন থেকে খপ করে আমার হাত ধরল। ফিরে তাকিয়ে দেখি রমা।

বাড়ি থেকে মরবে বলে এসেছিলে আর এখানে বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছ?

আরে তুমি? এ খাঁটি পাঞ্জাবি কুলপি...

রমা খিলখিল করে হাসতে লাগল। ও খুব চমৎকার একখানি শাড়ি পরেছে। খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা জড়িয়েছে। ওকে বড় চমৎকার দেখাচ্ছিল। আমি হেসে ওর হাতখানি হাতে নিলাম।

রমা আমার হাতটাকে আস্তে করে ঠেলে দিয়ে বাঁকা চোখে চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান ভরে বলল, একা একা খেয়ে নিলে তো সব আইসক্রিম।

তুমিও খাও না যত খুশি, আমি আমার হৃদয়টাকে চারপাশের বিস্তীর্ণ সমুদ্রের মতো উদার করে দিয়ে বললাম।

উঁহু, এসব বাসিপচা আইসক্রিম আমি খাই না। আমাকে ইরানির দোকানের ফ্রিজের আইসক্রিম খাওয়াও।

ইরানি রেস্তরাঁয় গিয়ে আমি বয়কে বললাম, দুটো আইসক্রিম দাও তো।

সিঙ্গল না ডবল? ও জিজ্ঞেস করল।

ডবল।

স্পেশ্যাল না অর্ডিনারি।

স্পেশ্যাল।

ভ্যানিলা না টুটি-ফুটি?

টুটি-ফুটি।

এখানে খাবেন না বাড়ি নিয়ে যাবেন?

বাড়ি নিয়ে যাব।

বয়টা আইসক্রিম কাউন্টারে গিয়ে বলল, দুটো ডবল প্যাক টুটি-ফুটি।... আজ গিন্নির সঙ্গে দাদার ভাব হয়েছে।

-সমাপ্ত

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর