শিরোনাম
শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
পর্ব-১

মুখোশ পরা মানুষ

ইমদাদুল হক মিলন

মুখোশ পরা মানুষ

রিসেপসান থেকে ফোন এল। ‘‘স্যার, এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’’

চায়ে চুমুক দিতে দিতে আসিফ সেদিনকার খবরের কাগজ দেখছিল। এখন খবরের কাগজ আর পড়া হয় না। শুধু চোখ বোলানো। হেডলাইনগুলো দেখা। ওসব হেডলাইন দেখতে দেখতে বলল, ‘‘কী নাম?’’

‘‘নাম বলেননি।’’

আসিফ তেমন অবাক হল না। সে যেখানেই যায় এ রকম অনেক মহিলাই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। নানা রকম সমস্যার কথা বলেন। সমাধানের পরামর্শ চান। মফসস্লে এলে ব্যাপারটা বেশি ঘটে। তা ঘটবার কথা। আসিফের এনজিও সমস্যা জর্জরিত নারীদের নিয়ে কাজ করে, সুবিধা বঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করে। কয়েকটি দেশ থেকে ফান্ড আসে। বনানীতে সুন্দর অফিস তাঁর। কর্মীদের বেশির ভাগই মেয়ে। আসিফের চেহারাও ইদানীং মানুষের কাছে পরিচিত। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নারীদের নানা রকম সমস্যা নিয়ে টকশো করে। এসব বিষয় নিয়ে দেশের জেলা উপজেলা পর্যায়ে সেমিনার করে। নিজের সম্পর্কে নারীদের সচেতন করা, তাদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে সেমিনার।

আসিফের বয়স একান্ন। সে একাকী জীবন কাটায়। সংসার ছিল। ভেঙে গেছে। প্রেম করে বিয়ে করেছিল সাদিয়াকে। বিয়ের দুই বছর পর মেয়ে হলো। সাদিয়া কাজ করত আমেরিকান একটা কোম্পানিতে। আসিফ তখন এনজিও নিয়ে নেমেছে। অন্য নারীদের সমস্যা দেখতে শুরু করেছে। নিজের নারীটির দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিল না। উলটো মেজাজ দেখাত। খারাপ ব্যবহার করত। সাদিয়া প্রথম প্রথম কিছু বলেনি। পরে এই নিয়ে শুরু হল বিরোধ। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স। মেয়েকে নিয়ে সাদিয়া চলে গেল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আসিফের। এখন সেই যোগাযোগও ক্ষিণ।

‘‘কী বলব, স্যার?’’

‘‘ও, বলুন আজ দেখা হবে না। আমার একটা সেমিনার আছে। খুবই ব্যস্ত থাকব। কাল আসতে বলুন।’’

‘‘জি স্যার।’’

খানিক পর আবার ফোন এল। ‘‘সরি, স্যার। উনি টেলিফোনে একটু কথা বলতে চান।’’

আসিফ বিরক্ত হলো। ‘‘ঠিক আছে। দিন।’’

ভদ্রমহিলা ফোন ধরেই বললেন, ‘‘আমি কোনো সাহায্য সহযোগিতা বা পরামর্শ চাইতে আসিনি। আপনাকে অন্য কিছু কথা বলব। আপনার অতীত জীবন নিয়ে।’’

কণ্ঠস্বর পরিচিত মনে হলো। কোথায় যেন শুনেছে আসিফ। একটু হাসকি ভয়েস। বেশ আকর্ষণ আছে কণ্ঠে।

আসিফ থতমত খেয়েছিল। নিজেকে সামলে বলল, ‘‘আমার অতীত নিয়ে কথা বলবেন? কে আপনি? কী নাম?’’

‘‘আমার নাম শ্রাবণি। ঠিক আছে, আপনি যখন ব্যস্ত, আমি কাল আসবো। কখন এলে ভালো হয় বলুন তো!’’

‘‘এ সময় এলেই হবে। কাল আমার তেমন কোনও কাজ নেই। লাঞ্চের পর ঢাকায় রওনা দেব।’’

‘‘ঠিক আছে।’’

কাজের ফাঁকে ফাঁকে সারাটা দিনই শ্রাবণির কথাগুলো কানে বেঁজেছে আসিফের। রাতেরবেলা বিছানায় শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভেবেছে। শ্রাবণি কে? তার অতীত জীবন নিয়ে কী বলতে চান? কণ্ঠস্বর পরিচিত মনে হল! যেন এই কণ্ঠ আগে শুনেছে। কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না আসিফ।

সকালবেলা ঠিক সময়েই শ্রাবণি এলেন। রিসেপসান থেকে ফোন আসতেই আসিফ ধরল।

‘‘স্যার, শ্রাবণি ম্যাডাম এসেছেন।’’

‘‘ফোনটা তাঁকে দিন।’’

শ্রাবণি ফোন ধরলেন। ‘‘জি, বলুন।’’

‘‘আমার রুমে আসতে অসুবিধা নেই তো? চা খেতে খেতে আপনার কথা শুনলাম।’’

‘‘কোনও আপত্তি নেই।’’

খানিক পর রিসেপসানের একটি মেয়ে শ্রাবণিকে আসিফের রুমে পৌঁছে দিয়ে গেল।

কালো বোরখায় নিজেকে সম্পূর্ণ আবৃত করে রেখেছেন শ্রাবণি। শুধু তাঁর চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। টানা টানা চোখ। এই চোখও আসিফের পরিচিত মনে হল।

‘‘বসুন, প্লিজ।’’

‘‘ধন্যবাদ।’’

শ্রাবণি মুখোমুখি সোফায় বসলেন।

‘‘চা চলবে তো?’’

‘‘না, আমি চা খেয়ে বেরিয়েছি। আপনি খান। আপনার তো ঘন ঘন চায়ের অভ্যাস।’’

‘‘জানলেন কী করে?’’

‘‘আমি আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। তবে সে সব বলতে আসিনি। একটা ঘটনা বলতে এসেছি।’’

‘‘আপনার কণ্ঠ পরিচিত মনে হচ্ছে। চোখ দুটোও যেন আগে দেখেছি।’’

‘‘এ রকম চোখ অনেক মহিলারই আছে। আমার মতো কণ্ঠও আছে কারও কারও।’’

আসিফ বুঝল শ্রাবণি তার কথা এড়িয়ে গেলেন। সে চায়ে চুমুক দিল।

‘‘একটা অনুরোধ করতে পারি?’’

‘‘জানি কী অনুরোধ। সেটা না করাই ভালো। আমার মুখ আপনাকে আমি দেখাব না।’’

‘‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। তা হলে ঘটনাটা বলুন। কাল অবশ্য বলেছিলেন আমার অতীত জীবন নিয়ে কথা বলবেন।’’

‘‘ওসব না বললে আপনি হয়তো আমার সঙ্গে দেখাই করতেন না।’’

‘‘এই ধারণাটা ঠিক না। দেখা আমি করতাম। আপনার কথাও শুনতাম। ওসবই আমার কাজ।’’

‘‘এবার তা হলে আসল কথায় যাই?’’

‘‘প্লিজ।’’

‘‘মেয়েটার নাম ছিল কলি। বাংলাদেশের গ্রামে এখনও গর্ভবতী নারীকে বাপের বাড়িতে রাখার নিয়ম। কলির মা গর্ভবতী হওয়ার পর তাকেও বাবার বাড়িতে রাখা হল। মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে মা গেল অসুস্থ হয়ে। মেয়ের কিছুই হল না, চার মাস পর মা মারা গেল। অসুস্থ স্ত্রীকে আর মেয়েকে কলির বাবা দেখতেও আসত না। দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করল। কলিকে কোলে তুলে নিল তার মামি। মামা গরিব কৃষক। সামান্য জমি আছে। ওই চাষ করে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে অতিকষ্টে চলেন। কলি হয়ে গেল মামা মামির চতুর্থ সন্তান। নিজের ছেলেমেয়েদের তেমন লেখাপড়া করালেন না মামা কিন্তু কলিকে স্কুলে পাঠালেন। কারণ পড়াশোনায় ব্যাপক আগ্রহ মেয়েটির। অন্যদিকে কলি দেখতে সুন্দর। লম্বা, স্লিম। গায়ের রং ফর্সা, মাথাভর্তি চুল, টানা টানা চোখ। মুখটা মিষ্টি, মায়াবী। লেখাপড়ায় ভালো বলে স্কুলে বেতন দিতে হয় না। বইপত্রও কিনতে হয় না। টিচাররা কিনে দেন। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করল সে। উপজেলার কলেজে ভর্তিও হয়ে গেল।

‘‘এ সময় মাস্তান লাগল কলির পেছনে।’’

শ্রাবণি অবাক হলেন না। ‘‘এটা অবশ্য অনুমান করে বলা যায়। এ রকমই হয়। কলির পেছনে লাগল এলাকার এক টাকাওয়ালা লোকের বখাটে ছেলে।’’

‘‘আমি কি সিগারেট ধরাতে পারি?’’

‘‘আমার অবশ্য সিগ্রেটের গন্ধ একদমই পছন্দ হয় না। তবু আপনি খান।’’

আসিফ সিগ্রেট ধরাল। ‘‘তার পর? বলুন।’’

‘‘অবস্থা এমন দাঁড়াল, কলি না কলেজে যেতে পারে, না বাড়িতে থাকতে পারে। গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বার বা প্রভাবশালী লোকদের ধরেও কাজ হল না। ছেলেটির নাম মিজান। কলিকে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে এসে হানা দিতে লাগল। ধরে নিয়ে যাবে কলিকে। জোর করে বিয়ে করবে। মামা মামি খুবই বিপদে পড়েছেন মেয়েটিকে নিয়ে। শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করবার জন্য, মামার পরিবারটিকে শান্তিতে রাখবার জন্য রাতের অন্ধকারে কলি পালালো। ঢাকায় তার এক দূর সম্পর্কের বিধবা, নিঃসন্তান খালা থাকে। তার কাছে এসে উঠল।’’

সিগ্রেটে টান দিতে গিয়ে থামল আসিফ। শ্রাবণির দিকে চোখ ফেরাল। ‘‘ঘটনাটা আমার কেমন শোনা শোনা মনে হচ্ছে।’’

‘‘পুরোটা আগে শুনুন।’’

‘‘বলুন, বলুন।’’

‘‘কলির সেই খালা এক সাহেবের ফ্ল্যাটে কাজ করে। উত্তরায় তার ফ্ল্যাট। ভদ্রলোক একাই থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে। একমাত্র মেয়েটিকে নিয়ে স্ত্রী চলে গেছেন আমেরিকায়...।’’

আসিফ এবার আপাদমস্তক কেঁপে উঠল। ‘‘এ তো, এ তো আমার জীবনের ঘটনা!’’

শ্রাবণি হাসলেন। ‘‘ঘটনার মাঝের অংশটাও আপনার জানা। তার পরও আমার মুখ থেকে শুনুন।’’

আসিফ তোতলাতে শুরু করল। ‘‘তুমি, তুমি কে?’’

‘‘তুমি করে বলছেন কেন?’’

‘‘সরি, সরি। আমি একটু দিশাহারা হয়েছি। সরি। বলুন, বাকিটা বলুন।’’

‘‘সাহেবের বিয়ের আগে থেকেই কলির খালা তাঁর ফ্ল্যাটে কাজ করে। চোখের সামনে দেখল সাহেব বিয়ে করলেন, বাবা হলেন। তার পর তাঁদের আলাদা হতেও দেখলেন। তবে ভদ্রলোক কলির খালাকে ছাড়লেন না। খালাই তাঁকে রান্নাবান্না করে খাওয়ায়, তার সংসার সামলায়। বিশ্বস্ত লোক। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকতে থাকতে ওই সংসারের সদস্য হয়ে গেছে। এক বিকালে কলি এসে উঠল তার কাছে। মেয়েটির বিপদের কথা শুনে খালা বুঝে উঠতে পারল না কী করবে এখন! সাহেবকে কেমন করে বলবে, বা মেয়েটিকে কেমন করে রাখবে তার কাছে! তার পরও তিন দিন ফ্ল্যাটে লুকিয়ে রাখল। চতুর্থ রাতে, গভীর রাতে কলি হঠাৎ শোনে সাহেবের রুম থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। সে ভয় পেয়ে খালাকে ডেকে তুলল। খালা উঠে সাহেবের দরজায় নক করল। ও রকম গোঙানি বা করুণ আর্তনাদ চলছে। খালা চাবি এনে দরজা খুলতে গিয়ে দেখে দরজা খোলাই। লক করা হয়নি। কলিকে নিয়ে রুমে ঢুকল খালা। সাহেব কুকরেমুকরে শুয়ে আছেন। করুণ স্বরে গোঙাচ্ছেন। কলি কিছু না ভেবে তাঁর কপালে হাত দিল। দিয়ে চমকে উঠল। ভীষণ জ্বর। এক শ চার ডিগ্রির কম হবে না। খালার কাছে জ্বর সর্দি কাশির ট্যাবলেট ছিল। কোনও রকমে সাহেবকে দুটো খাওয়ানো হল। জ্বরের ঘোরে তিনি অচেতন। তার পর কলি শুরু করেছিল তাঁর সেবা। নিজের কথা ভুলে প্রায় সারারাত সাহেবের মাথায় পানি দিল। ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিল। এক সময় চোখ মেলে সাহেব তাকে দেখে অবাক। ‘‘তুমি কে? আমি কি জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি!’’

কলির কথা খুলে বলল খালা। কিন্তু ওই যে চোখ মেলে সাহেব অপলক চোখে কলির দিকে তাকালেন, সেই চোখে যে কী ছিল কে জানে, মেয়েটি মুহূর্তে কেমন বদলে গেল! তার মনে হল, এই মানুষটি যেন তার চেয়েও অসহায়। এই মানুষটির পাশে তাকে থাকতে হবে। সে থাকল। খালা প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ডাক্তার এল, কলি সাহেবের একান্ত আপনজনের মতো ওষুধ পথ্য সব জেনে বুঝে নিল। তার পরও সাহেব সাত দিনের মতো ভুগলেন। শরীর খুবই দুর্বল। দিনরাত কলি তাঁর সেবা করছে। সারারাত সাহেবের পাশে বসে থাকে, কখনও কখনও তাঁর পাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে। ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। খালা নানা রকমভাবে বোঝালো। ‘তুই একটা যুবতী মেয়ে। সাহেবের বয়সও তেমন কিছু হয়নি। এভাবে চলা ঠিক না। অঘটন ঘটবে। সাহেব কি তোকে বিয়ে করবেন?’ কলি অতদূর ভাবেইনি। তার মন জুড়ে শুধু ওই মানুষটা। চোখ জুড়ে শুধু ওই মানুষটির মুখ। তাঁকে ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। কিছুই ভাবে না। খালার কথায় কোনও কাজ হল না। সাহেবও কলিকে ছাড়া কিছুই তখন বোঝেন না। কলির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছেন। সাহেবের একটাই বোন ঢাকায়। ভাই অসুস্থ শুনে একদিন দেখতে এলেন। কলি লুকিয়ে রইল। এইভাবে ফ্ল্যাটে কেউ এলেই সে লুকিয়ে থাকে। তবে সাহেবের ফ্ল্যাটে তেমন কেউ আসত না। বলতে গেলে তিনি একা একাই থাকেন। কয়েকদিনের মধ্যে এমন হল, সাহেবের জন্য যেন সব করতে পারে কলি। নিজের কথা তার মনেই থাকে না। সাহেবও উতলা হয়েছেন তার জন্য। দেখতে দেখতে অলিখিত স্বামী স্ত্রী হয়ে গেল তারা। নির্দ্বিধায় কলি তার সবকিছু তুলে দিল সাহেবের হাতে।’’

আসিফের চোখে তখন পলক পড়ছে না। মুখে ফুটেছে ভারি করুণ বিষণ্নতা। কোনও রকমে বলল, ‘‘তার নাম তো কলি ছিল না। তার নাম ছিল ঝুমকো।’’

‘‘আপনি তাকে ডাকতেন ‘ঝুমকোলতা’ বলে। লতার মতোই সে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ভালোবেসেছিল তার সর্বস্ব দিয়ে। তখন তার কোনও অতীত ছিল না, ভবিষ্যৎ ছিল না। সে ছিল বর্তমান নিয়ে।

[ চলবে ]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর