শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

এলইডির শহর

মাহতাব হোসেন

এলইডির শহর
এক হাতে সিগারেট, আরেক হাতে ফোন। অচেনা নম্বরে ডায়াল করলাম। রিং বেজে গেল, কেউ ধরল না। ফোনটা ট্রাউজারের পকেটে রাখতে রাখতেই ফোন এলো। রিসিভ করে কানে লাগাতেই একটা সুরেলা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো...

বাসায় ফিরে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম অচেনা একটা নম্বর থেকে তিনটা মিসডকল। ফোন রেখে আগে ভাত বসিয়ে দিলাম চুলায়। যে বাসাটায় থাকি এটা অনেকটাই ফাঁকা এলাকায়। কিছু বিল্ডিং ওঠা শুরু করেছে মাত্র। এমনই এক অর্ধ ওঠা ভবনের চার তলার দুই কামরা নিয়ে আমার একাকী জীবন। একাকী বলতে এখনো দুজনা হয়ে ওঠা হয়নি কিংবা সময়ও চলে যায়নি। এদিকে রান্নার লোক পাওয়াই মুশকিল। ভবনের অন্যান্য ফ্ল্যাটে কিছু কিছু পরিবার উঠেছে। দু-একটি বুয়াদের যাতায়াতও আছে কিন্তু দারোয়ানকে বলেও আমার বাসার জন্য কোনো লোক জোগাড় করতে পারিনি। ভাতের চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে আরেকটা চুলায় ডিম ভাজতে শুরু করলাম। ফ্রিজে গতকালের রান্না করা পেঁপের ভাজি ও ডাল আছে। আজ রাত সুন্দরভাবে চলে যাবে।

আমি যে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করি সেখানে এখন বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। একজন কপিরাইটার অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। তার জায়গায় একজন লোক নেওয়া হবে। কিন্তু এই লোক নেওয়ার আগে পুরো কাজ আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। নাকমুখ গুঁজে কাজ করতে হচ্ছে। ফোনটোন, সোশ্যাল মিডিয় কোনোকিছুই ঠিকঠাক চালাতে পারছি না। ফিরতে রাত হয়ে যাচ্ছে। গত পরশু তো রাত দেড়টায় দারোয়ানকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তারপর বাসায় ঢুকেছি।

ভাত নামিয়ে গোসলে ঢুকে গেলাম। গোসল শেষ করে খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে সোয়া ১টা বেজে গেল। ফোন হাতে নিলাম। সেই তিনটা মিসডকল। এখন কলব্যাক করা কি শোভনীয় হবে? নিজেই নিজে প্রশ্ন করলাম। বারান্দায় চলে এলাম। রাতে খাওয়ার পর সিগারেট না হলে চলে না। আমি ঘরের ভিতর সিগারেট খাই না। কেন যেন অস্বস্তি লাগে। গুমোট গন্ধ হয়ে থাকে। এক হাতে সিগারেট, আরেক হাতে ফোন। অচেনা নম্বরে ডায়াল করলাম। রিং বেজে গেল, কেউ ধরল না। ফোনটা ট্রাউজারের পকেটে রাখতে রাখতেই ফোন এলো। রিসিভ করে কানে লাগাতেই একটা সুরেলা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো।

: আপনি কি অয়ন?

: জি, অয়ন। আপনি?

: আমাকে ঠিক চিনবেন না।

: না চিনি; কিন্তু নাম জানার অধিকারবোধ তো রয়েছে আমার। যেহেতু আপনি ফোন করেছেন আমাকে।

যদিও কণ্ঠটা আমার পরিচিত পরিচিত ঠেকছে কিন্তু কোনোভাবেই অনুমান করতে পারছি না। সিগারেটের আগুন ফিল্টারের কাছাকাছি চলে এসেছে। সেটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলাম।

: আমি রিশা... আমি...

আর কোনো শব্দ আমার মাথায় ঢুকল না। কিছু কিছু নাম, কিছু ঘ্রাণ, কিছু গান মুহূর্তেই সময় পরিভ্রমণ করে কিছু নির্দিষ্ট অতীতে গিয়ে পৌঁছে। সেই সময়টা চোখের সামনে টিভি পর্দার মতো ভেসে ওঠে। সব পরিষ্কার চিত্র, চলচ্চিত্র।

আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, হুট করে নাকে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ ধাক্কা দিল। মুহূর্তেই আপনি চলে যাবেন আপনার শৈশবে। হয়তো আপনি খুব সকালে প্রাইভেট পড়তে যেতেন। তখন হয়তো রাস্তায় শিউলি গাছ থাকলে তার নিচে ছড়ানো ছিটানো শিউলি আপনি তুলে নিতেন, নাকের কাছে ধরে ঘ্রাণ নিয়ে পকেটে কিংবা ব্যাগে রেখে দিতেন। যেন সেই সময়টায় আপনি পরিভ্রমণ করলেন। আবার আপনি হয়তো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন- আপনার কানে এসে ধাক্কা দিল ‘আশিক বানায়া, আশিক বানায়া...।’ আপনি যদি গানটা বহুবার শুনে থাকেন তাহলে বহুবার শোনার সালটায় বা যে সময় যে কারণে গানটা বারবার শুনতেন সেই সময়টায় চলে যাবেন। ঠিক একইভাবে অতীতে কোনো নামের সঙ্গে যদি আপনার তীব্র পরিচয় ঘটে থাকে, যে নামটা কানের আশপাশে বহুবার চলাফেরা করে থাকে তাহলে বহুবহু বছর পরে সেই নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে অতীতের সেই সময়টায় মুহূর্তেই পৌঁছে যাবেন এবং রিশা আমার জীবনে এমনই একটা নাম।

আমি ১৩ বছর পেছনে চলে গেলাম। তখন সদ্য ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছি। মফস্বল শহরের কলেজ। কলেজে উঠেছি মানে অবাধ স্বাধীনতা। এমনটাই স্কুলে শুনে এসেছি। খুব অল্প সময়েই আমাদের একটা সার্কেল তৈরি হয়ে গেল। সেই সার্কেলে কিছু যোগ হলো, কিছু বিয়োগ হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের আটজনের সার্কেল স্থায়ী হয়ে গেল। চারজন ছেলে, চারজন মেয়ে। আমি, তুষার, মাহিন, সুখন, মিতু, প্রিয়া, দিলু আর রিশা। আমরা এই আটজনই একসঙ্গে ইংরেজি স্যারের কাছে ব্যাচ করে পড়ি। ফিজিক্স, কেমিস্ট্রিতেও আমাদের একই ব্যাচ। এই প্রাইভেট, ক্লাস আর লাইব্রেরি মিলে আমাদের তুমুল সুখের দিন কাটতে লাগল। বিশেষ করে প্রাইভেট পড়তে গিয়েই ধীরে ধীরে তুষারের সঙ্গে প্রিয়ার, মাহিনের সঙ্গে মিতুর, সুখনের সঙ্গের দিলুর প্রেম হয়ে গেল। কিন্তু আমার আর রিশার কারও সঙ্গে প্রেম হলো না। স্বাভাবিকভাবেই আমার সঙ্গে রিশার প্রেম হয়ে যাবে এটা ধরেই নিয়েছিল। কিন্তু হলো না।

একদিন লাইব্রেরিতে প্রিয়া আর দিলু রিশাকে বোঝাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে পরে মিতুও যোগ দিল। ওকে বলছে, তুই অয়নকে বল, বললেই তো তোদের সম্পর্ক হয়ে যাবে। রিশা কোনোভাবেই তাদের কথার উত্তর দিল না। আমি হাজারির কেমিস্ট্রি বইয়ে পড়ার ভান করে ওদের কথা শুনছিলাম। কিন্তু রিশার চেহারা দেখে বুঝলাম সে আমাকে পছন্দ করে না। আমাকেও তুষার, সুখনরা একদিন বোঝাল। আমিও ওদের কিছু বললাম না। আমার যে আগ্রহ ছিল না তা নয়। কিন্তু রিশার চেহারায় একটা ইতিবাচক রেখাও আমি দেখিনি যে তাকে গিয়ে বলব, রিশা এসো প্রেম করি।

একদিন কেমিস্ট্রি স্যারের প্রাইভেটে আগে ভাগে চলে এসেছি। গিয়ে দেখি রিশা আমার আগে চলে এসেছে। আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার তোমার বান্ধবীরা আসেনি এখনো?’ ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। তারপর কিছু না বলেই বই খুলে পড়ায় মন দিল।

এরপর রিশার সঙ্গে কথা বলার কোনো মানেই হয় না। আমরা যখন আটজন থাকি বেশ হই-হুল্লোড় হয় আনন্দ হয়। কিন্তু কোথাও যদি রিশা ও আমি দুজন আলাদা হয়ে যাই তখন আমাদের কথা হয় না।

একবার আমরা রংপুর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গেলাম। পার্বতীপুর থেকে ট্রেনে করে রংপুর গেলাম। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পর বিপত্তি তৈরি হলো। সবাই দুজন দুজন করে রিকশায় উঠল। শেষে আমি আর রিশা থেকে গেলাম। পরে বাধ্য হয়েই রিশা আমার সঙ্গে রিকশায় ওঠার পর কিছুটা ফাঁকা রেখে একদিকে চেপে বসে থাকল। চিড়িয়াখানায় সবাই মিলে হই-হুল্লোড় করতে করতে ঘুরছি। একটু ভিতরের দিকে সবুজ গাছপালা বেশি। বলা যায় ঘন অরণ্য? সেখানে ধীরে ধীরে সম্মিলিত আড্ডা ভেঙে ভেঙে দুজন দুজন করে গাছের আড়ালে চলে গেল। চুমু খাচ্ছে। আড়াল হলেও বোঝা যাচ্ছে। আমি আর রিশা চুপচাপ বসে থাকলাম। কেউ একটা কথাও মনে হয় বলিনি।

ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর সবাই আকস্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। একেকজন একেকদিকে কোচিং করতে চলে গেল। শুনলাম রিশা রাজশাহীতে কোচিং করছে। এরপর ইউনিভার্সিটি লাইফে কে কোথায় চলে গেল, ঠিক জানলাম না। পরে বাকিদের সঙ্গে টুকটাক যোগাযোগ থাকলেও অনেকের সঙ্গেই ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন অনেকেই ভার্চুয়াল যোগাযোগে রয়েছে। কিন্তু রিশা ছিল না। ওর কথা মাঝে মধ্যে যে মাথায় আসত না তা নয়। হৃদয় খুঁড়ে কে বেদনা জাগাতে চায়?

১৩ বছর পূর্ব থেকে বর্তমানে ফিরেই বললাম-

: কেমন আছ রিশা?

: চিনতে পেরেছ তাহলে।

: কেন চিনব না বলো?

: না, অনেক দিন, অনেক বছর যোগাযোগ নেই। তাই ভাবলাম হয়তো নাও চিনতে পারো।

: আমার স্মরণশক্তি বেশ ভালো।

রাতভর কথা হলো রিশার সঙ্গে। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে পড়েছে। আমার নম্বর নিয়েছে আমাদের অফিস থেকেই। আমার ফেসবুক থেকে আমার বিজ্ঞাপনী সংস্থার নাম দেখে সে অ্যাডমিন থেকে নম্বর নিয়েছে। কয়েক জায়গায় চাকরি করে এখন একটি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট হিসেবে আছে। ভোরের দিকে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ঠিক করলাম পরেরদিন আমরা একটা কফিশপে দেখা করব।

ঘুম থেকে দেরি করে উঠেই অফিস চলে গেলাম। কাজের মধ্যে ডুবে ছিলাম। একটা বিজ্ঞাপনের স্টোরি কিছুতেই চূড়ান্ত হচ্ছিল না। সেটা শেষ করে একটা জিঙ্গেল লিখতে হলো। সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। আজ এলইডির দখলে চলে যাওয়া ঢাকাকে অনেক বেশিই ভালো লাগছে, চারদিকে এক ধরনের আনন্দ ঘুরপাক খাচ্ছে।

কফিশপে ঢুকে আমি মোটেও বিস্মিত হলাম না। রিশা আমাকে দেখে হাসল। খেয়াল করলাম সামান্য স্বাস্থ্য বেড়েছে, মুখে কমনীয়তা ভর করেছে। চুলে একটু কালার শেড ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নেই। কফির পেয়ালা নিয়ে আমরা মুখোমুখি বসে রইলাম দীর্ঘকাল। এক ধরনের চাপা শিউলি ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছি, রিশার বাসার কাছে একটা গাছ ছিল নিশ্চয়ই।

রিশার সঙ্গে দেখা হওয়ার ঠিক ৪৭ দিন পর আমরা বিয়ে করলাম। আমাদের প্রেম হয়নি কোনো মফস্বল শহরে। হয়তো প্রেমটা জমে ছিল তার পাশে ছিল দেয়াল। সেই দেয়াল ভেঙে দিল এলইডির শহর। আমাদের দুজনের মধ্যে এখন প্রচুর আলো। বিয়ের পর আমাদের দুজনের একটা ছবি আপলোড করলাম। সেই ছবিতে খুব সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করলাম, ৬টা ‘অবাক’ রিয়েকশন। তুষার, মাহিন, সুখন, মিতু, প্রিয়া, দিলু আর রিশার রিয়েকশন। রিশাকে দেখালাম। রিশা হেসে বলল, খুব স্বাভাবিক না? ওরা সম্পর্কে ছিল, সবার সম্পর্কই ভেঙে গেছে, সবাই আলাদা আলাদা সংসারে ব্যস্ত। আর আমাদের? মানে তোমার আমার যেখানে কোনো সম্ভাবনাই ওরা দেখেনি, ওদের কাছে এই ছবি বিস্ময়কর নয়? আমি বললাম, হুম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর