শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

মাশরাফি বলেই সম্ভব

আসিফ ইকবাল

মাশরাফি বলেই সম্ভব

এশিয়া কাপের ফাইনাল নিশ্চিত হয়ে গেল। বুধবার পাকিস্তানের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ের পর টাইগাররা মাঠে এভাবেই উল্লাসে মেতে ওঠে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

মিরপুর স্টেডিয়ামে ভারত-সংযুক্ত আরব আমিরাতের খেলা চলছে। গুরুত্ব নেই বলে প্রেস বক্সে বসে থাকা ক্রীড়া সাংবাদিকদের তেমন কোনো আগ্রহও নেই। খোশগল্পে মেতে আছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে।        ফাইনাল নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সাংবাদিকরা নিজ নিজ পক্ষে অবস্থান নিলেও একটি বিষয়ে তর্কাতীতভাবে একাট্টা। মাশরাফি বিন মর্তুজাকে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার বলতে দ্বিমত নেই কারও।

ছয় ছয়টি অস্ত্রোপচারের পরও একজন ক্রিকেটার খেলছেন মাঠ দাপিয়ে। ক্রিকেট ইতিহাসে মাশরাফির মতো এমন নজির নেই কারও। মাশরাফি এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। খেলছেন, খেলাচ্ছেন এবং দেশকে উপহার দিচ্ছেন একের পর এক সাফল্য। একজন ক্রিকেটারের এসব দেওয়াই দায়িত্ব। কিন্তু ভিন্ন ধাতুতে গড়া মাশরাফি দিচ্ছেন আরও কিছু। গোটা দেশকে তিনি নিয়ে এসেছেন ক্রিকেটের সুশীতল ছায়ায়। বেঁধেছেন এক সুতোয়। গোটা জাতিকে বিভেদ ভুলে দাঁড় করিয়েছেন এক জায়গায়। নেতৃত্বে মাশারাফি বলেই তা সম্ভব হচ্ছে।

স্কিল ও কিংবা পারফরমান্সে ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, কপিল দেব, অর্জুনা রানাতুঙ্গাদের কাতারে নন। পরিসংখ্যানও বলছে ব্যবধান যোজন যোজন। কিন্তু জনপ্রিয়তা কিংবা নেতা হিসেবে এদের সবার চেয়ে এগিয়ে। একজন ক্রিকেটার মাশরাফি, একজন অধিনায়ক মাশরাফি আমুল পাল্টে দিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। পাল্টে দিয়েছেন অপরাপর দেশগুলোর চিন্তা-চেতনাকে। সবাই এখন আলাদা করে ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে। গোটা দেশকে ক্রিকেটের ছায়ায় এনে ‘অবিসংবাদিত ক্রিকেট নেতায় পরিণত মাশরাফি কিন্তু রয়ে গেছেন আগের মতোই। এখনো রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। রিকশায় চড়ে অনুশীলনে আসেন। বাড়ির সামনে বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারম খেলায় ব্যস্ত থাকেন। জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘এটা জীবন’।

 

 

মাশরাফি বলেই এমনটি সম্ভব। বুধবার রাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে পারফরম্যান্স আহামরি ছিল না। বল হাতে ৪ ওভারের স্পেলে রান দিয়েছেন ২৯ এবং ব্যাটিংয়ে ৭ বলে ১২ রানের অপরাজিত ইনিংস। সাদা চোখে কিংবা আতশি কাচের নিচে ফেলে কাটাছেঁড়া করার পরও সবাই বলবে, পারফরম্যান্স একেবারে মামুলি! সত্যিই তো। কিন্তু আসলেই কি তাই? বোলিং মেনে নিলেও ব্যাটিংকে সাধারণ মানের বলা যাবে না কোনোভাবেই। এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলতে বাংলাদেশের দরকার ১৮ বলে ২৬ রান। উইকেটে তখন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও সাকিব আল হাসান। অনেক শলা পরামর্শ করে  করে পাকিস্তানের অধিনায়ক বোলিংয়ে আনেন বিপজ্জনক আমিরকে। আমিরের প্রথম বলটি স্কুপ করতে গিয়ে বোল্ড সাকিব। সাকিবের বোল্ড নিস্তব্ধতা নেমে আসে স্টেডিয়ামে। মাঠে নামেন মাশরাফি। যিনি বল হাতে অগুনতি জয় উপহার দিয়েছেন দেশকে। সেই মাশরাফি নেমেই বাজিমাত করেন। আমিরের প্রথম বলকে বোলার্স ব্যাক ড্রাইভে বাউন্ডারি এবং পরের বলেও বাউন্ডারি হাঁকান হুক করে। দুই বলে দুই চারে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন পাকিস্তানকে এবং ফাইনালে টেনে তুলেন প্রিয় বাংলাদেশকে। একেবারে ‘ক্যাপ্টেন্স নক’ যাকে বলে। অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েও নিশ্চুপ। কোনো ভনিতা নেই, ‘ফাইনালে উঠতে পেরে অনেক অনেক ভালো লাগছে। এখনই শেষ হয়ে যায়নি সবকিছু। এখনো ফাইনাল বাকি। উৎসব করার এখনো বাকি।’ দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে হারানোর পর যেখানে আনন্দে গড়াগড়ি করার কথা, সেখানে তিনি স্বাভাবিক। মাটিতেই হাঁটছেন। এটা শুধু মাশরাফি বলেই সম্ভব। সে জন্যই তিনি এখন ক্রিকেটার নেতা, অভিভাবক, বন্ধু, স্বজন এবং বাংলাদেশের ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর স্বপ্ন পুরুষ।

২০০১ সালে অভিষেক। ১৫ বছরের পথচলায় বহু ম্যাচ খেলেছেন। জিতিয়েছেন বহু ম্যাচ। কিন্তু অধিনায়ক মাশরাফি এখন ভালোবাসার সর্বোচ্চ আসনে।

২০০৯ সালে অধিনায়ক হলেও ছিটকে পড়েন ইনজুরিতে। এরপর ফিরেছেন এবং নেতৃত্বও দিয়েছেন দেশকে। কিন্তু ফের ছিটকে পড়েছেন ইনজুরির ধাক্কায়। তবে ছিটকে পড়ার আগে বুঝিয়েছিলেন নেতা মাশরাফিকে কতটা প্রয়োজন দেশের। বিসিবিও বুঝল। ২০১৪ সালে দল যখন হারতে হারতে খাদের কিনারায়, তখনই মাশরাফির হাতে তুলে দেয় দল। এরপর তো সবই ইতিহাস। সোনালি খাতায় সোনালি হরফে লেখা শুধুই সাফল্য। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে টেনে তোলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর ঘরের মাঠে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়। আগে যেসব ছিল স্বপ্ন, এখন মাশরাফির হাতের পরশে সবই সত্যি। ২৮ ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে উপহার দিয়েছেন ২১ জয়। শতাংশের হিসাবে ৮১। টি-২০ ক্রিকেটে ১৫ ম্যাচে জয়ের হার ৪১ শতাংশ, ৭টি।

মাশরাফির সোনালি পরশে খোলনলচে পাল্টে গেছে বাংলাদেশের। মহাতারকা হয়ে একটুও বদলাননি মাশরাফি। রয়ে গেছেন এক যুগ আগের সেই তরুণ মাশরাফি।

সর্বশেষ খবর