জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ইলেক্ট্রনিক স্কোর বোর্ডে দেখাচ্ছিল, দিনের খেলা বাকি আরও ছয় ওভার। তবে ফ্লাড লাইট জ্বলে উঠেছে ওভার দুয়েক আগেই। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি দর্শকের মধ্যে। কিন্তু হঠাৎ দিনের খেলা বন্ধ ঘোষণা করে দিলেন মাঠের দুই আম্পায়ার।
জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার আর মাত্র ৩৩ রান। অষ্টম উইকেটে সাব্বিরের সঙ্গে তাইজুলের জুটিটা বেশ জমেও উঠেছে। এমন সময় খেলা বন্ধ হওয়াটা নিশ্চয়ই হতাশার! কেননা পরের দিন আবার নতুন করে উইকেটে সেট হতে হবে। সকালের উইকেটে সেট হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়!
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ সকালের সেশনের ফাঁদে পড়ে মাত্র ২৭ রানেই শেষে পাঁচ ব্যাটসম্যানকে হারিয়েছিল। গতকাল সকালে ইংল্যান্ডও তো শেষ দুই উইকেট হারিয়ে ১২ রানের বেশি করতে পারেনি। মাত্র ৪.২ ওভারেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সফরকারীদের ইনিংস। তাই আজ সকালে বাংলাদেশ কী পারবে দুই উইকেটে ৩৩ রান করতে?গতকাল সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য টাইগার কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহেকে বেশ প্রফুল্লই মনে হলো। কোচের প্রশান্তিতে ভোগারই কথা। কেননা হাতুরাসিংহের বিশ্বাসই ছিল না, এই বোলিং লাইন নিয়ে ইংল্যান্ডের মতো দলের ২০ উইকেট নেওয়া সম্ভব। কিন্তু মুশফিকরা কাল দ্বিতীয় ইনিংসে ইংলিশদের অলআউট করে নিজেদের সামর্থ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন। শিষ্যদের এমন পারফরম্যান্সে ভীষণ খুশি কোচ। এখন তো জয়ের স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে হাতুরাসিংহের চোখে-মুখে, ‘আগামীকাল (আজ) বাংলাদেশ যদি ১০-১৫ ওভার খেলতে পারে, আমার বিশ্বাস লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। তবে আমাদের ব্যাটসম্যানদের প্রথম ১০-১৫ বল দেখে খেলতে হবে। আমাদের হাতে তো ব্যাট করার জন্য ৯০ ওভারই রয়েছে।’
জয়ের পাল্লাটা যেন কিছুটা বেশি ঝুঁকে আছে ইংল্যান্ডের দিকে। তারপরেও নাটকীয় এই চট্টগ্রাম টেস্টে কি হয় বলা তো যায় না। তবে ফুরফুরে মেজাজেই আছে ইংল্যান্ড। ইংলিশ অলরাউন্ডার স্টুয়ার্ট ব্রোডের দাবি, ‘আমাদের দরকার মাত্র দুই উইকেট। দুইটা ভালো বল কিংবা দুইটা ভালো ডেলিভারিই যথেষ্ঠ। তবে এটা সেরা টেস্ট ম্যাচগুলোর মধ্যে একটি। তবে বাংলাদেশ অসাধারণ ক্রিকেট খেলেছে। এমন পারফরম্যান্সের জন্য বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে।’
সাকিব আল হাসানকে আউট করার পরও ইংলিশ ক্রিকেটাররা বেশ উচ্ছ্বসিত ছিল। তাদের ধারণা ছিল, শেষ স্বীকৃত জুটি তারা ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে সাব্বির রহমান এসে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে জুটি বেঁধে ইংলিশ বোলারদের নাস্তানাবুত করে ছেড়েছে। এই জুটিতেই আসে ৮৭ রান। এই জুটি ভাঙার পরই যেন স্বস্তি পায় ইংলিশরা।
মুশফিকে আউট হওয়ার পরও ছন্দপতন ঘটে বাংলাদেশের। দ্রুত উইকেট হারিয়ে ফেলে। তবে একপ্রান্ত আগলে রেখেছেন সাব্বির রহমান। ৯৩ বলে ৫৯ রান করে রয়েছেন অপরাজিত। বাংলাদেশের আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছেন সাব্বির। এই মারকুটে ব্যাটসম্যান উইকেটে আছেন বলেই খানিকটা অস্বস্তি কাজ করছে ইংলিশদের মনে। ব্রড বলেন, ‘ম্যাচের ফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। ব্যাটসম্যানরাও ভালো করতে পারে। আবার বোলারের দুই বলেই শেষ হয়ে যেতে পারে খেলা।’
খুব কাছে থেকে সাব্বিরের ব্যাটিং দেখেছেন ব্রড। হয়তো তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না একজন অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানের পক্ষে কিভাবে এমন পরিপক্ব শট খেলা সম্ভব। সাব্বির গতকাল দুই ইংলিশ স্পিনার আদিল রশিদ ও মঈন আলীকে যেভাবে লং অনে দুটি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন তা ছিল দেখার মতো। সাব্বিরের প্রশংসা করে ব্রড বলেন, ‘সে অসাধারণ খেলেছে। বিশেষ করে মুশফিকের সঙ্গে তার জুটিটা ছিল চমৎকার। সে কী দারুণভাবেই না ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাটিং করেন। অনেক চাপ নিয়ে এমন সুন্দর ব্যাটিং করা মোটেও সহজ নয়।’
কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহেও সাব্বিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, ‘আমি খুবই খুশি দ্বিতীয় ইনিংসে তার লড়াই দেখে। এই উইকেটে এমন সহজভাবে ব্যাটিং করা খুবই কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন কাজটি কী অবলীলায় না করল সাব্বির। তার এই হাফ সেঞ্চুরি মহামূল্যবান।’ প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে থাকার পরও লোয়ার অর্ডারের ব্যর্থতায় বড় স্কোর করতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় ইনিংসে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের লড়াই করতে দেখেই কোচ খুশি।
বাংলাদেশের ব্যাটিং দেখে আনন্দ পেয়েছেন দর্শকরাও। আট উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও সাব্বির সন্ধ্যায় তাইজুলের সঙ্গে যেভাবে জুটি গড়েছিলেন তা ছিল আশা জাগানিয়া। তাই স্কোরবোর্ডে দিনের খেলা ছয় ওভার বাকি দেখানোর পরও হঠাৎ দুই আম্পায়ার মাঠ ছাড়ায় হয়তো দর্শকরা হতাশই হয়েছেন।
আবার অন্য চিন্তা করলে দেখা যাবে, দর্শকের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এটা তো সত্য যে, ইলেক্ট্রনিক স্কোর বোর্ডে দেখানো আরও ছয় ওভার খেলা হলে গতকালই নিশ্চিত হতে পারতো বাংলাদেশের হার। যদি আজ বাংলাদেশ হেরেও যায়, তাতেও একটু সান্ত্বনা তো পাওয়া যাবে যে টেস্টটা পাঁচ দিনে গড়িয়েছে। আর পাঁচ দিনই সমান তালে লড়াই করেছে বাংলাদেশ। আজ জিতলে তো কথাই নেই! সেটা হতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা!