শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

দেড় ঘণ্টার ম্যাচে ১ ঘণ্টা দম!

ক্রীড়া প্রতিবেদক

দেড় ঘণ্টার ম্যাচে ১ ঘণ্টা দম!

জর্ডানের বিপক্ষে প্রথমার্ধে কিছুটা ঝলক দেখালেও দ্বিতীয়ার্ধে দম না থাকায় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২৩ দল শোচনীয়ভাবে হেরে মাঠ ছাড়ে। আজ তাজিকিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচ লড়বে অ্যান্ড্রুর শিষ্যরা

ফুটবলে বিদেশি কোচেরা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে একটা কথাই বলেন, ‘খেলোয়াড়দের দমের ঘাটতি।’ ১০ বছর ধরে একই কথা শোনা যাচ্ছে। নতুন কোচ অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ডু ওর্ডও একই কথা বলেছেন। মূলত জাতীয় দলের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি এখন অনূর্ধ্ব-২৩ দলের দায়িত্ব পালন করছেন। তার প্রশিক্ষণেই বাংলাদেশের যুবারা এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিচ্ছে। কয়েক দিন অনুশীলন করার পরই তিনি ফুটবলারদের ফিটনেস ধরে ফেলেন। খেলোয়াড়দের মধ্যে দমের এতটা ঘাটতি যে মাঠে ঠিকমতো দৌড়াতেই পারে না। ঢাকায় সাইফ স্পোর্টিং পেশাদার লিগ চ্যাম্পিয়ন ঢাকা আবাহনী দেশের বাইরে নেপাল ও কাতার অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে। প্রতিটি ম্যাচেই লক্ষ্য করা গেছে দমের ঘাটতি। অ্যান্ডু বলেছেন, ‘৯০ মিনিটের লড়াইয়ে খেলোয়াড়রা ঠিকমতো দৌড়াতে পারে ৬০ বা ৭০ মিনিট। তাও আবার সবাই পারে না।’ তাই তিনি ফিটনেসকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

দেড় ঘণ্টার ম্যাচে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা ১ ঘণ্টা খেলতে পারে। বাকি সময়ে দম না থাকায় খেলোয়াড়রা হাঁপাতে থাকে। এ অবস্থা বলেই তো ফুটবলে বেহাল দশা নেমে এসেছে। দমের খেলা ফুটবলে দম থাকবে না তা কি ভাবা যায়? অথচ অতীতে আমরা কী দেখেছি? সত্তর দশকে লেফট্ আউট গফুরের কথা না বললেই নয়। রহমতগঞ্জ ও আবাহনীর হয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন। জাতীয় দলেও নজরে আসেন। গফুরকে বলা হতো স্কুটার গফুর। কারণ তিনি মাঠে স্কুটারের মতো ছুটতেন। বাধা সত্ত্বেও তিনি বার বার প্রতিপক্ষের বিপজ্জনক এলাকায় ঢুকে পড়তেন। নিজে গোল করেছেন, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন। এক কথায় গফুর ছিলেন অসাধারণ ফুটবলার। শেখ মো. আসলামের পরিশ্রমী খেলা কি ভোলা যায়? যে দম ছিল তার প্রতিপক্ষরা তাকে সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যেতেন। গোলাম সারোয়ার টিপু ও প্রতাপ হাজরার খেলা যারা দেখেছেন তারা বলতে পারবেন গতি কাকে বলে। বেশি দিন খেলতে পারেননি, তার পরও তোতা, জিল্লুর, কোহিনুর ও মনুর গতিময় খেলা ছিল চোখে পড়ার মতো। গাফফারের দম কি কম ছিল? সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, এমনকি মোটা শরীরে হাফিজউদ্দিন, এনায়েত, নওশেরের খেলার মধ্যে কি গতি ছিল না? স্ট্রাইকার হয়েও এনায়েত তো মাঠজুড়ে খেলতেন। মনে পড়ে ওয়াজেদ গাজী, চুন্নু ও সাব্বিরের গতিময় খেলা।

তখন ও এখনকার ফুটবলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কৌশলটাই এখন ফ্যাক্টর। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলে কৌশলটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে অল্পতেই খেলোয়াড়রা ক্লান্ত হয়ে পড়ায়। মঙ্গলবার জর্ডানের কাছে ৭-০ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশের যুবারা। শক্তিশালী দল হওয়ায় জর্ডান যে জিতবে এ নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের এতটা বেহাল দশা ভাবাই যায় না। প্রথমার্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে ছিল অ্যান্ডুর শিষ্যরা। দ্বিতীয়ার্ধে ৫ গোল হজম করে। কারণ দম ফেল করায় ম্যাচে লড়াইয়ের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। এটা এখন স্বাভাবিক দৃশ্যে পরিণত হয়েছে।

১৯৮৭ সালে মোহামেডানের কোচ হওয়ার পর নাসের হেজাজি অবাক হয়ে যান ফুটবলারদের জিম না থাকায়। তিনি বলেছিলেন, ‘খেলোয়াড়দের ফিটনেসই যদি পরীক্ষা না করতে পারি তাহলে দল গড়ব কীভাবে?’ জিম না থাকায় বিকল্প পথ বেছে নেন হেজাজি। খেলোয়াড়দের কাঁধে বালুর বস্তা দিয়ে দৌড়াতে বলতেন। দেখতেন কার কেমন দম। একে অন্যের কাঁধে চড়িয়ে খেলোয়াড়দের দৌড়াতে বলতেন। এভাবেই চলত ফুটবলে দমের পরীক্ষা।

৩০ বছর পরও সেই একই দশা! ফুটবলারদের জন্য কোনো জিমের ব্যবস্থা নেই। ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে অনুশীলনে নামার আগে নিজেদের ফিটনেস যাচাই করে নিচ্ছেন। বিসিবি তাদের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে জিমের ব্যবস্থা করে। একসময় ক্রিকেটেও জিম ছিল না। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তা তৈরি হয়েছে। শুধু অনুশীলন করে এখন মাঠে নামাটা চিন্তাই করা যায় না। দেড় ঘণ্টার ম্যাচে উপযুক্ত নয় বলে ফুটবলারদের নিয়ে তিরস্কার করা হয়। এমনকি টকশোয় ফুটবলারদের নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করছেন অনেকেই। যা সমাজ হেয় করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ফুটবলারদের যা জরুরি একবারও বলা হচ্ছে না।

জর্ডানের বিপক্ষে এমন বিপর্যয়ের কারণ জানতে চাইলে বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য বললেন, ‘আরে ভাই! খেলোয়াড়দের যে দম তাতে ৭ গোল খেয়েছে এটাই ভাগ্য।’ সমালোচনা করছেন অথচ ফুটবলারের ফিটনেস ও স্কিল বাড়াতে যা দরকার তা কি তারা করছেন? নির্বাচন এলেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় জিমের। ব্যস এ পর্যন্তই। ক্রিকেটে না হয় অঢেল টাকা। তাই তাদের আধুনিক জিম আছে। কিন্তু ফুটবলে সামান্য ব্যায়াম যে করবে সেই যন্ত্রপাতি কেনারও কি সামর্থ্য নেই? পেশাদারিত্ব যুগে বাফুফের কোনো জিম নেই দেখে কোচেরা বিস্ময় প্রকাশ করছেন। কিন্তু বাফুফের সেদিকে নজর নেই। শুধু দৌড় দিতে পারলেই যদি ফুটবলার হয়ে যেত তাহলে দেশের ফুটবল সংকটে ভুগত না। গতিময় ফুটবলে ফিটনেস যাচাই করাটা জরুরি তার কোনো গুরুত্ব নেই বাফুফের কাছে। নির্বাচনে জিততে লাখ লাখ টাকা ওড়াচ্ছে ঠিকই অথচ জিম করার পয়সা নেই তাদের। ছেলেরা যখন ৯০ মিনিট খেলতেই পারে না তাহলে অযথা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশকে হেয় করার দরকার কী? হারের ভয়ে আফ্রিকার জিবুতি ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ কি সেই পরিণতির দিকে এগুচ্ছে।

সর্বশেষ খবর