শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বেদনার মাঝেও আশার আলো

ক্রীড়া প্রতিবেদক

বেদনার মাঝেও আশার আলো

শিরোপার কাছে এসেও শিরোপা জিততে পারল না বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ দল। হেড টু হেডের সমীকরণে জুনিয়র সাফ ফুটবলে নেপালই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তীরে এসে তরী যেন ডুবে গেল বাংলাদেশ যুবাদের। ২০১৫ সালে এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে বিদায় নিয়েছিল। এবার পাঁচ দলের সরাসরি লিগভিত্তিক লড়াইয়ে যে দুর্দান্ত শুরু করেছিল তাতে দেশবাসীর আশায় ছিলেন অনেক দিন পর কোনো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হতে যাচ্ছে। সেই আশায় গুঁড়েবালি। নেপালের সমান সর্বোচ্চ ৯ পয়েন্ট সংগ্রহ করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু হেড টু হেডের ফাঁদে পড়ে রানার্স আপ হয়েই মিশন শেষ করল।

ভুটানের বিপক্ষে ২-০ গোলে জয়ের পর অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ। পরবর্তী ম্যাচে নেপাল ও ভারত ড্র করলেই পয়েন্ট ব্যবধানেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত জাফর ইকবালরা। ড্র না হলে ভারত জিতলেও লিগ ম্যাচে ভারতকে হারানোর সুবাদে হেড টু হেডের সমীকরণে বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন। দুর্ভাগ্য বলতে হয় বাংলাদেশের। সৌভাগ্য নেপালের। শেষ ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে হেড টু হেড সমীকরণে তারাই চ্যাম্পিয়ন। কারণ লিগ ম্যাচে বাংলাদেশকে পরাজিত করে নেপাল।

এমন সম্ভাবনা থাকার পরও বাংলাদেশের যুবাদের শিরোপা না জেতাটা সত্যিই বেদনাদায়ক। এই কষ্ট ভুলবার নয়। তবু বেদনা থাকার পরও ফুটবল ঘিরে নতুন আশার আলো জেগে উঠেছে। জাতীয় দলের লাগাতার ব্যর্থতায় ফুটবল ঘিরে আগ্রহই ছিল না ক্রীড়ামোদীদের মাধ্যে। এতটা সংকটাপন্ন অবস্থা যে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জাতীয় দলের সেমিফাইনাল খেলাটাই স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ভুটানের কাছে হেরে মামুনুলরা দেশকে লজ্জায় ডুবিয়েছে। অনেকে তাই রাগে ও অভিমানে বলছেন বারোটা বেজে গেছে দেশের ফুটবলের। লাইফ সাপোর্টে বেঁচে আছে এই খেলা। বড়রা পারছে না। ছোটরা অন্তত প্রমাণ দিচ্ছে ফুটবলে মৃত্যু নয়, এখনো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। ক্রিকেট সাফল্যে বাংলাদেশের দর্শকরা ফুটবল নিয়ে আলোচনা করতেই ভুলে গেছে। সবার মুখে মুখে সাকিব, মাশরাফি, মুশফিক, তামিম, মুস্তাফিজদের প্রশংসা। ফুটবলারদের নাম গন্ধ নেই।

গত এক মাসে অনূর্ধ্ব-১৮ অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬ ও মহিলারা যে নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছে তাতে ফুটবল ঘিরে নতুনভাবে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সত্যি বলতে কি ছোটদের পারফরম্যান্স যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে তা গত ১০ বছরেও ফুটবলে দেখা যায়নি। ভালো খেলতে পারলে ফুটবল নিয়ে আলোচনা হবেই। এক মাসে ছোটরা কোনো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এ নিয়ে বেদনা আছে কিন্তু হতাশা নেই। বেদনা আর হতাশার মধ্যে পার্থক্য অনেক। অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ ফুটবলে প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে প্রথমার্ধেই ৩ গোলে পিছিয়ে থেকেও ৪-৩ গোলে জিতেছে। যা বাংলাদেশের ফুটবলে সেরা জয়ই বলা যায়। মালদ্বীপকেও ২-০ গোলে হারায়। নেপালের কাছে ২-১ গোলে হারলেও বাংলাদেশ যে নৈপুণ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিল তাতে করে জেতাই উচিত ছিল। দুর্ভাগ্য পিছু নেওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।

অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ ফুটবলে ভুটানকে দুইবার বিধ্বস্ত করে। অনূর্ধ্ব-১৮ সাফেও ২-০ গোলে জয়। জাতীয় দল যেখানে ব্যর্থ সেখানে ছোটরা হেসেখেলে ভুটানকে হারিয়েছে। হেড টু হেড সমীকরণে ১৮ বয়সী কিশোররা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। এটা ভাগ্যের ব্যাপার এখানে কিছুই করার নেই। যুবরা হেড টু হেডের ফাঁদে পড়েছে। জাতীয় দলতো গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছে। গোল করা তারা ভুলেই গেছে। অথচ জাফর ইকবাল কি না চার ম্যাচে পাঁচ গোল করে দেখিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় পেশাদার লিগে বিভিন্ন দলে আছেন। অধিকাংশ খেলোয়াড়ই আবার সাইড বেঞ্চে বসে থাকে। অর্থাৎ পেশাদার লিগের এক্সটা খেলোয়াড়রা কি চমত্কার খেলাটাই না খেলল।

২০১৫ সালে সিলেটে অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবার গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলেও সেমিফাইনালে নেপালের কাছে হেরে বিদায় নেয়। তারপরও তাদের নৈপুণ্য প্রশংসিত হয়েছে। ফয়সাল টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে চমক দেখিয়েছেন। ভাগ্য সহায় না থাকায় সেমিফাইনালে নেপালের কাছে হেরে যেতে হয়। আসা যাক অনূর্ধ্ব-১৫ দলের কথা। ২০২২ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারে তারা এএফসি কাপ বাছাই পর্ব খেলতে যায়। গ্রুপে ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের মতো শক্তিশালী দল থাকায় অনেকে ভেবেছিলেন টুর্নামেন্টে গোলের বন্যায় ভেসে যাবে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক কারণে আমিরাত টুর্নামেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয়। প্রতিপক্ষ ছিল ইয়েমেন ও স্বাগতিক কাতার। ইয়েমেনের কাছে ১০ গোলে হারলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। সেখানে হেরেছে ২-১ গোলে। তাও আবার ১টি গোল পেনাল্টিতে। বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ভূয়শী প্রশংসা পেয়েছে। ফুটবলে কাতারকে বাংলাদেশ হারাবে তাতো কেউ স্বপ্নও ভাবেনি। সেই কাতারকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছে অনূর্ধ্ব-১৬ দল। ফাহিমের ছবি ছেপে দোহার একটি দৈনিকে প্রতিবেদনে ছিল বাংলাদেশ ৫ গোলে জিতলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। শিরোপা জিততে না পারায় বেদনা আছে। কিন্তু তারাতো ফুটবলে নতুন করে আশার আলো জ্বালিয়েছে। কিশোরীরাও কম যায়নি। থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ মহিলা ফুটবলে চূড়ান্ত পর্বে গ্রুপের প্রথম ম্যাচে উত্তর কোরিয়ার কাছে ৯-০ গোলে হেরেছে। কোরিয়া কতটা যে শক্তিশালী তা প্রমাণ দিয়েছে এই টুর্নামেন্টে পুনরায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে। পরের ম্যাচে জাপানের সঙ্গে সমান তালেই লড়েছিল কৃষ্ণারা। অভিজ্ঞতার অভাবে ম্যাচটি অবশ্য হেরে যায় ৩-০ গোলে। শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে তো প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে পিছিয়ে পড়েও ১০ জন নিয়েও বাংলাদেশ ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে ২ গোল করে নাটকীয়ভাবে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জিতে যায়। অধিনায়ক কৃষ্ণারাণী সরকার লাল কার্ড না দেখলে ম্যাচ হয়তো জিতেই যেত বাংলাদেশ। অন্ধকারে ডুবে থাকা ফুটবলে আশার আলো জ্বালিয়েছে ছোটরা। ফুটবলে যে জেগে ওঠা সম্ভব তা প্রমাণ দিয়েছে জাফর, সৈকত, ফয়সাল, ফাহিম, কৃষ্ণারা। এমন সম্ভাবনার পর বাফুফে ছোটদের নিয়ে নতুন কোনো চিন্তা করছে? নাকি অতীতের মতো ঘুমিয়ে থাকবে। কিশোর বা কিশোরীদের নিয়ে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি  হয়ে পড়েছে। হুট করে পরিবর্তন সম্ভব না তা সবাই স্বীকার করে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি উন্নত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যতে এ ছোটরাই বড় সাফল্য এনে দিতে পারবে এই আশা করা যায়। ফুটবলে দেখা যায় কেউ ভালো খেললে বিভিন্ন ক্লাব তাদের অন্তর্ভুক্ত করে। কাউকে খেলায় কাউকে গুরুত্বই দেয় না। তাই সব সম্ভাবনা বিলীন হয়ে যায়। নতুন আশার আলো জ্বলে ওঠার পর বাফুফে কি পদক্ষেপ নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর