বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ওয়ান্ডারার্সের দশায় মোহামেডান!

ক্রীড়া প্রতিবেদক

ওয়ান্ডারার্সের দশায় মোহামেডান!

কয়েক বছর ধরে ফুটবলে এই হতাশার দৃশ্য যেন ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছেন না সাদা-কালো জার্সিধারীরা —ফাইল ফটো

দৃশ্য এক। ১৯৮০ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগের প্রথম পর্ব। ম্যাচে প্রথমে এগিয়ে থেকেও সেই ম্যাচে মোহামেডান ১-৩ গোলে হেরে যায় ব্রাদার্স ইউনিয়নের কাছে। ম্যাচ শেষে মোহামেডানের ফুটবলার গাফফার মাঠে শুয়ে কাঁদছেন। এই দৃশ্য দেখে মোহামেডানের অনেক সমর্থকই চোখে জল ধরে রাখতে পারেনি।

দৃশ্য দুই। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে প্রথম বিভাগ লিগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান-আবাহনীর ম্যাচে। দলের শক্তি বাড়াতে নাইজেরিয়ার চিমা ওকোরিকে মাঠে নামায় মোহামেডান। প্রথমার্ধে চিমার গোলেই এগিয়ে গিয়েছিল মোহামেডান। পুরো ম্যাচে প্রাধান্য ছিল সাদা-কালোদের। অথচ ডিফেন্ডারদের ভুলে দ্বিতীয়ার্ধে আবাহনীর আসলাম গোল পরিশোধ করে দেন। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ ১-১ গোলে ড্র হয়। জিততে না পারায় হতাশায় ভেঙে পড়েন মোহামেডানের অভিজ্ঞ সংগঠক মুনিরুল হক চৌধুরী। মাঠে নেমে বেশ কিছুক্ষণ তিনি নীরবভাবে দাঁড়িয়েছিলেন।

সেকালের মোহামেডান আর একালের মোহামেডানের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তখন মোহামেডানের পয়েন্ট হারানোটাই ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। এখন সেই ঐতিহ্যবাহী দলের হারটা যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আবাহনী বা বড় প্রতিপক্ষের কথা বাদ দিলাম। পেশাদার লিগে যেনতেন দলের কাছেও হারছে মোহামেডান। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ১৯৮০ থেকে ১৯৯২। এই ১২ বছরে মোহামেডান লিগে ৮টি ম্যাচে হার মানে। সেই দল কিনা এবারের লিগে ৮টি ম্যাচে হেরেছে। গত ১২ বছরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে এখনকার মোহামেডানের হারের সংখ্যা ২০-ও ছাড়িয়ে গেছে।

একটি ক্লাবের খারাপ সময় যেতেই পারে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী মোহামেডানতো নিচের দিকেই নামছে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো লক্ষণই নেই। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক গত ১৬ বছরে মোহামেডান ২ বার ফেডারেশন কাপ ও ২ বার সুপার কাপ ও একবার স্বাধীনতা কাপের  ট্রফি ঘরে তোলে। কিন্তু পেশাদার লিগে শিরোপা জেতাটা স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ২০০২ সালের পর মোহামেডান লিগে চ্যাম্পিয়নই হতে পারেনি। যে দলের কাছে ট্রফি জেতাটা কোনো ব্যাপারই ছিল না সেই মোহামেডান ১৬ বছর ধরে লিগ জিততে পারছে না। অথচ তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা আবাহনী ছয়বার পেশাদার লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। শেখ জামাল ৩, শেখ রাসেল ১ বার করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

পেশাদার লিগে প্রথম তিন আসরে রানার্সআপ হয়েছিল সাদা-কালোরা। এখন রানার্সআপও স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এক সময় মোহামেডান ম্যাচ হারা ছিল ক্রীড়াঙ্গনে আলোচিত ঘটনা। খেলোয়াড়, কর্মকর্তারা আফসোসে কাঁদতেন। অনেক সমর্থকই দুঃখে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতেন। এখন পরাজয় নয়, ম্যাচ জেতাটাই বড় ঘটনা। ফুটবলে সেই উন্মাদনা নেই বলে মোহামেডানের হারে সবকিছুই স্বাভাবিক থাকে। এভাবেই কি একটি ঐতিহ্যবাহী দল চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফুটবল কেন, কোথায় আছে মোহামেডানের সাফল্য। ২০০৮ সালের পর ক্রিকেট লিগেও শিরোপা নেই। হকিতেও চলছে হাহাকার। লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর নতুন কমিটি গঠন হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে এই কমিটি গঠন হয়। সেদিন জোর গলায় বলা হয়েছিল মোহামেডান অচিরেই এশিয়ার অন্যতম সেরা ক্লাবে পরিণত হবে। মতিঝিলে বহুতল ভবন নির্মাণ। সাভারে নিজস্ব জায়গায় আলাদা ক্রীড়া কমপ্লেক্স কত কিছুই না প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে কি তার ছিটেফোঁটার দেখা মিলেছে। এখন এতটা সংকটাপন্ন অবস্থা যে গত লিগে কোনোরকমে রেলিগেশন রক্ষা করেছে মোহামেডান। এবার হয়েছে পঞ্চম। একেই নাকি কর্মকর্তারা বলছেন, বড় প্রাপ্তি! মোহামেডান-আবাহনীর ম্যাচকে মর্যাদার লড়াই বলা হয়। অনেকে বলছেন, মর্যাদার শব্দেও মর্যাদা আছে। ঢাকা আবাহনী শুধু জিতেই চলেছে। এখন তাই মর্যাদার লড়াই বললে তা হবে হাস্যকর।

যেভাবে এগুচ্ছে মোহামেডানকে এখন সেকালেই ঐতিহ্যবাহী ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এক সময়ে ক্রীড়াঙ্গনে দলটির দাপট ছিল তুঙ্গে। ছয় বার প্রথম বিভাগ ফুটবলে তাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। ১৯৬০ সালের পর ওয়ান্ডারার্স আর লিগ জিততে পারেনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে লিগে রানার্সআপ ও ১৯৮৭ সালে ফেডারেশন কাপে রানার্সআপটাই ছিল বড় প্রাপ্তি। সেই দাপুটে দল ওয়ান্ডারার্সের এখন বেঁচে আছে শুধু নামেই। সেকালের ওয়ান্ডারার্সের কথা বললে একালের মোহামেডানের দৈন্যদশার সঙ্গে তুলনা করা যায়। তাহলে কি সেই পথেই যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী দলটি। কর্মকর্তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা কি একবারও ভাবছেন না মোহামেডান নিস্তেজ হওয়া মানে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় একটা ধস নেমে আসা। এক মোহামেডান হারিয়ে গেলে নতুন এক মোহামেডান সৃষ্টি করা যাবে কি? জানিনা কে কি ভাবছেন। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থেই উচিত হবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া।

সর্বশেষ খবর