রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

‘দ্য ক্লাসিক’ মাহমুদুল্লাহ

মেজবাহ্-উল-হক

‘দ্য ক্লাসিক’ মাহমুদুল্লাহ

ক্রিকেটে সাফল্যের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে। তার আগে টাইগাররা কালেভাদ্রে এক, দুটি জয় পেত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে হঠাৎ যেন বদলে যায় বাংলাদেশ। এক ‘ফিনিক্স পাখি’র ডানায় ভর করে প্রথমবারের মতো আইসিসি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেল! —আর এই ফিনিক্স পাখি হচ্ছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। অ্যাডিলেড ও হ্যামিল্টনে টানা দুই ম্যাচে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুই সেঞ্চুরি। তার আগের ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধেও করেছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। ব্যাটে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে অবাক করে দেন মাহমুদুল্লাহ। বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যানের বিশ্বকাপে সেঞ্চুরিই ছিল না। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের পেস কন্ডিশনে বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান এতো ভালো করবেন এমনটা হয়তো কেউ-ই ভাবেনি। ‘বড় জোর একটা কিংবা দুইটা ম্যাচে জিতবে বাংলাদেশ’ —হয়তো এমন ধারণাই ছিল ক্রিকেটামোদীদের! সেখানে আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডের পর ফেবারিট ইংল্যান্ডের মতো দলকে বিদায় জানিয়ে শেষ আটে জায়গা নেয় টাইগাররা।

অ্যাডিলেডের সেই ম্যাচে বল হাতে শেষ মুহূর্তে জাদুকরি ‘এক স্পেল’ করে ম্যাচের সব আলো নিজের করে নিয়েছিলেন পেসার রুবেল হোসেন। কিন্তু ম্যাচের ভিত গড়ে দেওয়া লড়াকু সেঞ্চুরির জন্য কর্তৃপক্ষ সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা মাহমুদুল্লাহর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। শেষ মুহূর্তের মোমেন্টামে রুবেল এগিয়ে থাকলেও ম্যাচ জুড়ে ছিলেন তো মাহমুদুল্লাহই। কী দারুণ তার ১০৩ রানেরই ঝলমলে সেই ইনিংস! দলীয় ৮ রানে যখন দুই ওপেনার তামিম ও ইমরুল কায়েসকে হারিয়ে দিশাহারা টাইগাররা ঠিক তখনই ব্যাট হাতে বাইশগজে যান রিয়াদ। তারপর সেঞ্চুরি করে দলকে এনে দেন ২৭৫ রানের লড়াকু স্কোর। তারপর অসাধারণ এক জয়!

পরের ম্যাচে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে আবারও সেঞ্চুরি। মাহমুদুল্লাহ খেলেন ১২৩ বলে ১২৮ রানের হার না মানা ইনিংস। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধেও দারুণ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেখর ধাওয়ানের বিতর্কিত এক ক্যাচে আউট করে দেওয়া হয় মাহমুদুল্লাহকে।

সেই আসরে বাংলাদেশ শেষ আট থেকে বিদায় নিলেও অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যান রিয়াদ। পেস কন্ডিশনে বিশ্বসেরা পেসারদের নাকানিচুবানি খাইয়ে দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নিজেকে নতুন চেহেরায় আবির্ভূত করেন ঠাণ্ডা মাথার এই খুনে ব্যাটসম্যান। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আরেক কীর্তির সাক্ষ্য রাখেন মাহমুদুল্লাহ। কার্ডিফে ১০২ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলেন। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। তবে ওই ম্যাচে সেঞ্চুরি করার পরও মাহমুদুল্লাহ ছিলেন পার্শ্ব নায়ক। ১১৪ রান করে ম্যাচের নায়ক হয়ে যান সাকিব আল হাসান। মহানাটকীয় সেই ম্যাচে কিউইদের দেওয়া ২২৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৩৩ রানেই চার উইকেট হারিয়ে খাদে পড়ে যায় লাল-সবুজরা। এরপর সাকিবের সঙ্গে ২২৪ রানের জুটি গড়েন মাহমুদুল্লাহ। অতঃপর ঐতিহাসিক জয় ।

টি-২০তে মাহমুদুল্লাহ যে কতটা ভয়ঙ্কর তার একটুখানি ঝলক দেখিয়েছেন গত মার্চে শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফিতে। স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে ম্যাচ। জয়ের জন্য শেষ চার বলে বাংলাদেশের দরকার ছিল ১২ রান। এমন সময় কাভার দিয়ে দুর্দান্ত এক বাউন্ডারি। পরের বলে ডিপ মিডউইকেটে ঠেলে দিয়ে দুই রান। তারপরের বলে ফ্লিক করে স্কোয়ার লেগ দিয়ে অসাধারণ ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে ফাইনালে পৌঁছে দেন মাহমুদুল্লাহ। টেস্টে মাহমুদুল্লাহর ক্যারিয়ার ততটা সমৃদ্ধ নয়। সেঞ্চুরি একটি এবং হাফ সেঞ্চুরি ১৫টি। খেলেছেনই তো মাত্র ৩৭টি ম্যাচ। তবে একমাত্র পাওয়া সেঞ্চুরিটিও করেছেন নিউজিল্যান্ডের হ্যামিল্টনে, যেখানে বিদেশি ব্যাটসম্যানদের বাইশগজে গেলে কাঁপুনি এসে যায়! জাতীয় দলের জার্সিতে মাহমুদুল্লাহর অভিষেক হয়েছিল পুরাদস্তুর অলরাউন্ডার হিসেবে। কিন্তু এখন তার ফোকাস কেবলই ব্যাটিংয়ে। ঘরোয়া লিগে নিয়মিত বোলার বল হাতে দেখা গেলেও জাতীয় দলে বোলিং করেন হঠাৎ কখনো। শুধু ব্যাটিং দিয়েই তো নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন দিনে দিনে। কিছুদিন আগেও দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে মাঝেমধ্যেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতেন মাহমুদুল্লাহ। নাসির হোসেনের জন্য তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হতো। কিন্তু এখন নিজের পজিশনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যদিও মিডলঅর্ডারে দলে জায়গা করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন নাজমুল হাসান শান্ত ও আফিফ হোসেন ধ্রুব। উদীয়মান দুই তারকা ঘরোয়া লিগে রানও পাচ্ছেন। হয়তো দলে জায়গাও পাবেন দ্রুতই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মাহমুদুল্লাহর জায়গায় কি সুযোগ পাবেন তারা? মাহমুদুল্লাহর জায়গায় সুযোগ পেতে হলে তো হতে হবে ‘আরেক মাহমুদুল্লাহ’! যিনি ‘ক্যাসিক্যাল’ ব্যাটিং উপহার দিয়ে দলকে খাদ থেকে টেনে তোলার সক্ষমতা রাখেন। ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিপক্ষের বোলারদের ‘খুন’ করে ফেলেন বাইশগজে! এমন কোনো ‘নতুন মাহমুদুল্লাহ’ কী পাইপলাইনেও আছে?

সর্বশেষ খবর