মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

সেন্ট পিটার্সবার্গ যেন স্বপ্নের স্টেডিয়াম

সেন্ট পিটার্সবার্গ যেন স্বপ্নের স্টেডিয়াম

রাশিয়া বিশ্বকাপে অন্যতম ভেন্যু সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়াম —ইন্টারনেট

কমরেড কিরভ আগত অতিথিদের আসন দেখিয়ে বসার নিমন্ত্রণ করছেন। দৃশ্যটা বহু বহু বছর আগের। সম্ভবত এভাবেই তিনি তার কমরেডদের আবেদন জানাতেন। হয়তবা সম্মুখ সমরের সেই দিনগুলোতে এভাবেই তার সহযোদ্ধাদের দিক নির্দেশনা দিতেন। কমরেড কিরভ বলশেভিক বিপ্লবের এক অন্যতম সেনাপতির নাম। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্বকাপের জন্য নতুন করে গড়ে ওঠা সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামের সদর দরোজার ঠিক সামনে। পাশেই ক্রেসত্রভস্কি পার্ক। নানান ফুল-ফল আর সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছের সমাহার পার্কে। ক্রেসত্রভস্কি আসলে একটা দীপ। সেন্ট পিটার্সবার্গের এই দ্বীপটাই এখন শহরে বিশ্বকাপের মূল কেন্দ্র। সাবেক কিরভ স্টেডিয়ামের ওপর এখন দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল স্থাপনা। যেখানে সমর্থকদের জন্য অপেক্ষায় আছে ব্রাজিল-কোস্টারিকা এবং আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচ দেখতে।

ফিনল্যান্ড সাগরের মোহনা থেকে তৈরি হয়েছে নিয়েভা নদী। সেন্ট পিটার্সবার্গকে কয়েকটা ধারায় চিড়ে দিয়ে পৌঁছে গেছে লাদোগা লেকে। এই নদীর ওপরেই তৈরি হয়েছে শত শত কালভার্ট। জারদের আমলে তৈরি করা এসব কালভার্ট আজও শোভা বাড়াচ্ছে সেন্ট পিটার্সবার্গের। ফিনল্যান্ড সাগরের তীরেই দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়াম। স্পেসশিপের আদলে তৈরি করা স্টেডিয়ামটির জন্য রাশিয়ানরা খরচ করেছে অনেকটা সময়, ঘাম, শ্রম, রক্ত আর অর্থ। তবে সবকিছু মিলিয়ে যা দাঁড়িয়েছে, তা সত্যিই অসাধারণ। ফুটবলারদের মাঠ থেকে প্রেস কনফারেন্সে আসতেও তাদের চড়তে হয় বিএমডব্লিউ গাড়ি। স্টেডিয়ামটা এক চক্কর দিতেই কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়। আর পুরো স্টেডিয়াম চত্বর দেখতে গেলে, বড় একটা দিনও বুঝি কুলোবে না। এখানে লোকেরা এসে সময় কাটায়। প্রাণ জুড়াতে বিদেশিরা তো বটেই, শহরের বাসিন্দারাও মেট্রো চড়ে বিকালটা এখানে কাটাতে আসে। বেশিরভাগেরই থাকে স্কেটিং শু। বাচ্চারা  ছোটাছুটি করে। খেলে বেড়ায়। কিন্তু স্থানটা এতই বিশাল, ধারণ করতে পারবে যেন পুরো দুনিয়াকেই! হাজার, লাখ কিংবা কোটি মানুষ এলেও বুঝি এর সমস্যা হবে না। দর্শকধারণ ক্ষমতা প্রায় ৬৭ হাজার। কিন্তু বাইরের পার্কটা অযুত-নিযুত মানুষকে ধারণ করতে পারের।

 সেন্ট পিটার্সবার্গের বাসিন্দারা গত কয়েক দিন ধরেই এখানে অপরিচিত মানুষের মুখোমুখি হচ্ছেন। দেখা দিচ্ছে নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ। সুদূর মিসর থেকে ছুটে আসা বৃদ্ধ তার খাবারের পুটলিটা খুলে ‘তীন’ ফল খেতে দেয় ভিনদেশি অপরিচিত সাংবাদিককে। পরিচয় জানলে আপ্লুুত হয়। না জানলেও ক্ষতি নেই। সেন্ট পিটার্সবার্গে আজ রাশিয়া-মিসর খেলা। ফলাফলটা কী হবে? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, মোহাম্মদ সালাহ খেলবেন তো? মিসরীয়রা বিশ্বাস করে, তিনি খেলবেন। প্রথম ম্যাচে উরুগুয়ের কাছে পরাজয়ের দুঃসহ স্মৃতিটা মুছে দিয়ে নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাবে মিসরীয়রা। এজন্যই সেন্ট পিটার্সবার্গ এখন আর কেবল রাশিয়ানদের শহর নয়। মিসরীয়দেরও। তারা স্টেডিয়ামের পাশে কয়েকজন স্বদেশি পেলেই ‘মো সালাহ লা লা লা’ গান গেয়ে উঠে। আর সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে বিকালের সূর্যোদয় দেখে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখে। সেন্ট পিটার্সবার্গ রাশিয়ানদের বাণিজ্যিক রাজধানী। শিল্পের শহর। কিন্তু এই শহরের মাটিতেই মিশে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লাখ-লাখ মৃতের শরীর। জার্মানি এই শহরটাকে (সেই সময় নাম ছিল লেনিনগ্রাদ) ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। আধুনিক যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ (প্রায় দুই বছর) ছিল লেনিনগ্রাদে। লাখ লাখ মানুষ না খেয়েই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। শহরের কোথাও এখন ধ্বংসস্তূপের সেই চিহ্ন নেই। সেন্ট পিটার্সবার্গের আজকের চাকচিক্য দেখে করুণ সেই ইতিহাস জানার উপায় নেই। প্রতিটা জাঁকজমকপূর্ণ শহরের পেছনেই বুঝি এমন করুণ ইতিহাস থাকে!

সর্বশেষ খবর