বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্রিকেটে মেয়েদের স্বপ্নযাত্রা

মেজবাহ্-উল-হক

ক্রিকেটে মেয়েদের স্বপ্নযাত্রা

ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বুঁদ হয়ে ছিল গোটা দেশ! প্রথমে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল এবং পরে ক্রোয়েশিয়া। ফুটবলের ডামাডলে ক্রিকেট যেন মাথায় ছিল না! ক্রিকেট যে এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রীড়া ইভেন্ট তা বোঝার উপায় ছিল না শেষ এক মাসে। প্রিয় দল আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ফাইনালের আগেই বাদ পড়ে যাওয়ায় এদেশের ক্রীড়ামোদীদের সেকি আক্ষেপ!

এই সময়ের মধ্যে যে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ গিয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে, ক্যারিবীয়দের কাছে ৪৩ রানে গুটিয়ে যাওয়ার লজ্জা পেয়েছে— তা নিয়ে তেমন হৈচৈ নেই। বলতে গেলে সাকিবরা ফুটবল বিশ্বকাপের কারণে সমালোচকদের হাত থেকে বেঁচেই গেছেন। এমন লজ্জাজনক ঘটনা অন্য কোনো সময় হলে টাইগাররা সমালোচনায় তুলোধুনা হয়ে যেতেন। ফুটবল বিশ্বকাপটা যেন টাইগারদের জন্য আশির্বাদ ছিল।

তবে এই বিশ্বকাপটা আবার মেয়েদের জন্য ছিল অনেকটা হতাশার! কেন না এই সময় যে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা দেশের জন্য সাফল্য বয়ে নিয়ে এনেছেন বিশ্বকাপের উত্তেজনার কারণে তা নিয়ে আলোচনা হয়নি। ইউরোপ সফরে পর পর দুই দুটি সাফল্য পেয়েছে এদেশের মেয়েরা। প্রথমে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ জয়, তারপর বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা।

কিছুদিন আগেই সালমা-রুমানারা মালয়েশিয়ার মাটিতে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের শিরোপা জিতে। ওই টুর্নামেন্টে দুই দুবার ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। সালমাদের এশিয়া কাপ জয়ের পর ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা আইসিসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছিল—‘একই টুর্নামেন্টে ভারতকে দুবার হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা প্রমাণ করেছে তাদের এই সাফল্য নিছক কোনো অঘটন নয়। তারা সত্যিই ক্রিকেটে অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের মহিলা দল অনেক শক্তিশালী।’

এশিয়া কাপ জয়ের পরও মেয়েদের পারফরম্যান্স নিয়ে হয়তো একটুখানি সংশয় ছিল—ইউরোপে তারা ভালো করতে পারবে তো! কিন্তু সেই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে আইরিশদের ২-১ ব্যবধানে সিরিজে হারিয়েছে চমক সৃষ্টি করেছে সালমারা।

আয়ারল্যান্ডে সফলতার পর বাংলাদেশের মেয়েরা বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলতে চলে যায় নেদারল্যান্ডসে। সেখানে তারা পায় আরও বড় সাফল্য। বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত করে।

বাছাইপর্বের প্রতিটি ম্যাচেই তারা প্রতিপক্ষকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছে। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে তারা পাপুয়া নিউগিনিকে হারায় ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে। দ্বিতীয় ম্যাচে স্বাগতিক নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ৭ উইকেটের বড় জয়। তৃতীয় ম্যাচে সালমাদের কাছে পাত্তাই পায়নি সংযুক্ত আরব আমিরাতের মেয়েরা। রুমানাদের বিরুদ্ধে মাত্র ৩৯ রানেই প্যাকেট হয়ে গিয়েছিল আমিরাতের মেয়েরা। এরপর ৮ উইকেটের বড় জয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।

সেমিফাইনাল ও ফাইনালেও দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে জিতেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। সেমিতে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৪৯ রানের জয়। শেষ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডকে ২৫ রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ফুটবল বিশ্বকাপের কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটামোদী মেয়েদের সাফল্য উদযাপনের যেন সুযোগই পাননি।

সে যাই হোক— হঠাৎ মেয়েদের ক্রিকেটে ঈর্ষণীয় সাফল্যের পেছনে রহস্য কি?  এশিয়া কাপের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ভরাডুবি হয়েছিলে এই মেয়েরা। ওয়ানডে ও টি-২০—দুই সিরিজেই হোয়াইটওয়াশ। চলতি বছরের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় নাস্তানাবুত হওয়ার পরের মাসেই যেন বদলে যায় বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল।

তবে একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দেওয়ার ইতিহাস যিনি লিখিছেন, তিনি হচ্ছেন প্রধান কোচ অঞ্জু জৈন। তার সহকারী দেবিকা পালশিখরও কৃতিত্বের দাবিদার। ভারতের এই দুই কোচের ছোঁয়াতেই এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার ডেভিড ক্যাপেল দক্ষিণ আফ্রিকা সফর পর্যন্ত জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। কিন্তু এই ইংলিশ কোচ বিদায়ের পরই যেন সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হাতে পেয়ে যায় সালমা-জাহানারারা। ভারতীয় দুই কোচের পরামর্শ বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কাছে টনিক হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের ব্যর্থতা থেকেও সফলতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। গতির উইকেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে খেলে সালমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিটা বেড়ে গেছে। সেই অভিজ্ঞতা দারুণ কাজে দিয়েছে সাম্প্রতিক সাফল্যগুলোতে।

সাকিব-মাশরাফিরা দুই দুবার এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেও শিরোপা জিততে পারেনি। সেখানে সালমারা প্রথমবার ফাইনালে উঠেই বাজিমাত করে দিয়েছে। এশিয়া সেরা হওয়ার পর মেয়েরা ইউরোপ মিশনেও পেয়েছে সেরা সাফল্য। এখন মেয়েদের লক্ষ্য বিশ্বকাপ।

যদিও বাস্তবতার বিচারে, বিশ্বকাপের শিরোপার আশা করাটা দুঃস্বপ্নের মতোই। কিন্তু কোচ অঞ্জু জৈনের জাদুকাঠির স্পর্শে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্বকাপের শিরোপা স্বপ্নও বাস্তব হয়ে যেতে পারে।

ভারতের মাটিতে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টি-২০ সিরিজে হোয়াইওয়াশ হওয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে টেস্টেও যখন সাকিবরা লজ্জার রেকর্ড সৃষ্টি করছে তখন মেয়েরা এদেশের ক্রিকেটকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। এশিয়া কাপ জয়, আয়ারল্যান্ড সিরিজ জয়, অতঃপর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন—পর পর তিনটি বড় অর্জনই নির্দেশ করে এখন মেয়েদের ক্রিকেটে চলছে স্বপ্নযাত্রা!

সর্বশেষ খবর