মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ইউরোপে বায়ার্নই সেরা

রাশেদুর রহমান

ইউরোপে বায়ার্নই সেরা

শৈল্পিক ফুটবল নিয়ে লিসবনের দ্য লুজ স্টেডিয়ামে হাজির হয়েছিলেন নেইমার-এমবাপ্পে-ডি মারিয়ারা। কিন্তু মাঝে মধ্যে কেবল শিল্প দিয়ে সফল হওয়া যায় না। তাই যেন প্রমাণ করল বায়ার্ন মিউনিখ। দুরন্ত গতির যান্ত্রিক ফুটবলে প্রতিপক্ষকে কাবু করতে অভিজ্ঞ জার্মান জায়ান্টদের সামনে শৈল্পিক ফুটবল বড্ড বেমানান মনে হলো!

রবিবার রাতে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের প্রবল আগ্রাসনের মুখে হেরে গেল পিএসজি। ১-০ গোলের জয়ে ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ঘরে তুলল জার্মান জায়ান্টরা। দ্বিতীয়বারের মতো জয় করল ট্রেবল শিরোপা (লিগ, কাপ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ)। এর আগে ২০১৩ সালেও ট্রেবল জয় করেছিল বায়ার্ন মিউনিখ।

ফাইনাল ম্যাচের উত্তেজনা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নেইমার-এমবাপ্পে-ডি মারিয়ারা। প্রথমদিকে এই ত্রয়ীর আক্রমণে বায়ার্ন মিউনিখ বেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু জার্মান জায়ান্টরা যখন নিজেদের ফুটবলীয় রূপটা পুরোপুরি মেলে ধরল, পিএসজিকে আর খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। থমাস মুলার, লেবানডস্কি, জিনাবরিরা ফ্রন্টলাইনে অবিরাম যুদ্ধ করে গেলেন। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের জন্য চূড়ান্ত আঘাতটা হেনেছেন পিএসজির অ্যাকাডেমিতে বেড়ে ওঠা ফরাসি স্ট্রাইকার কিংসলি কোম্যান। তার ৫৯ মিনিটের গোলটাই বায়ার্ন মিউনিখকে ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা উপহার দেয়। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা পিএসজির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নটাও গুঁড়িয়ে দেয়।

কিন্তু ম্যাচটা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। বায়ার্ন মিউনিখ নিজেদের স্বভাবজাত খেলাটা খেলেছে। কিন্তু পিএসজি কী খেলতে পেরেছে? নেইমার-এমবাপ্পে-ডি মারিয়া-থিয়াগো সিলভাদের মতো তারকা ফুটবলারদের মধ্যে সেই গতিই দেখা যায়নি ম্যাচজুড়ে। নেইমার-ডি মারিয়া কয়েকটা আক্রমণ করেছেন বটে। এমবাপ্পে অবশ্য কয়েক ড্রিবলিংয়ে কারিকুরি দেখিয়েছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বায়ার্ন মিউনিখের অতি আগ্রাসী ফুটবলের কাছে পিএসজির সব কৌশলই ভেস্তে যায়। প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়ার দিক দিয়ে জার্মান জায়ান্টরা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নেইমারদের পায়ে বল গেলেই বায়ার্ন মিউনিখের ফুটবলাররা মৌমাছির মতোই ঘিরে ধরেছে তাদেরকে। ছিনিয়ে নিয়েছে বল। অথচ গত বছরের শেষের দিকেও এই বায়ার্ন মিউনিখকে নিয়ে ইউরোপিয়ান ফুটবলে খুব একটা আলোচনা ছিল না। সবাই ভেবেছিল, বায়ার্নের পুরনো জৌলুস ফিরে পেতে অপেক্ষা করতে হবে ঢের! কিন্তু হ্যান্স ফ্লিক ধারণাটা বদলে দিলেন ট্রেবল জয় করে।

৫৫ বছর ১৮১ দিন বয়সে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করলেন বায়ার্ন কোচ। এর আগে এরচেয়ে বেশি বয়সে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করেছেন কেবল মার্সেইর কোচ রেমন্ড গোথালস (১৯৯৩ সালে ৭১ বছর বয়সে), বায়ার্নের কোচ হাপ হেইঙ্কেস (২০১৩ সালে ৬৮ বছর বয়সে)

এবং ম্যানইউর কোচ অ্যালেক্স ফার্গুসন (১৯৯৯ ও ২০০৮ সালে যথাক্রমে ৫৭ ও ৬৬ বছর বয়সে)।

৫৯ মিনিট

কোম্যানের একমাত্র গোল

ফাইনালের লড়াইয়ে দুটি দলই সমানতালে আক্রমণ করছিল। তবে গোলের দেখা মিলছিল না। ম্যাচের ৫৯ মিনিটে জশুয়া কিমিচ ডি বক্সের ডান কোণ থেকে বাতাসে ভাসানো লম্বা পাস দেন সেকেন্ড বারে। দারুণ এক হেডে গোল করেন কিংসলি কোম্যান। এ গোলেই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বায়ার্ন মিউনিখ।

হ্যান্স ফ্লিক, কোচ, বায়ার্ন

আমি এই দলটাকে নিয়ে গর্বিত। গত নভেম্বরে পত্রিকার হেডলাইন দেখলে মনে হতো, কেউ আর বায়ার্ন মিউনিখকে ভয় পায় না। এরপর থেকে আমাদের উন্নতিটা ছিল দেখার মতো। ফাইনাল ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে আমরা যেমন খেলেছি তাতে জয়টা আমাদের প্রাপ্য ছিল।

থমাস টাশেল, কোচ, পিএসজি

আমার মনে হচ্ছিল, ম্যাচের প্রথম গোলটাই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে। আমরা প্রথমে গোল করলে ফলাফলটা উল্টো হতে পারতো। তবে আমরা দারুণ খেলেছি। নেইমার ও এমবাপ্পে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। এবার সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।


চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ২০২০

নেইমারের কান্না

বার্সেলোনার জার্সিতে একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করেছেন নেইমার। কিন্তু বার্সেলোনার কাছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয় করা নতুন কিছু নয়। পিএসজির কাছে যেমন একেবারেই নতুন। সম্ভবত এ কারণেই পিএসজিকে প্রথমবার ফাইনালে তুলে পরাজিত হওয়ায় বেদনায় মুষড়ে পড়েছিলেন নেইমার। ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে এসেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের আলাবা ও ফিলিপ কটিনহো।

শুধু রেকর্ডটাই হলো না

উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এক মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটা স্পর্শ করতে পারলেন না বায়ার্ন মিউনিখের পোলিশ তারকা রবার্ট লেবানডস্কি। ১৫ গোল নিয়েই মৌসুমটা শেষ করলেন তিনি। এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১৭ গোলের রেকর্ড ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর (২০১৩-১৪)। পর্তুগিজ এই তারকা ২০১৫-১৬ মৌসুমে করেছিলেন ১৬ গোল। তবে মেসির ১৪ গোলের রেকর্ডটা ছাড়িয়ে গেলেন লেবানডস্কি। প্রথম পোলিশ হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার জিতলেন তিনি।

ফুটবলের মহাপ্রাচীর

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের আঁটোসাঁটো ডিফেন্স লাইন ভেঙে মাঝে মধ্যেই ডি বক্সের ভিতরে বিপজ্জনকভাবে প্রবেশ করছিলেন নেইমার-এমবাপ্পেরা। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াও কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু শক্তিশালী ডিফেন্স লাইনের পর চীনের প্রাচীরের মতোই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বায়ার্নের জার্মান গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নিউয়ার। এমবাপ্পে, ডি মারিয়া আর নেইমারদের শট রুখে দিয়ে ম্যাচের নায়ক তিনিই। অন্তত তিনটি গোল বাঁচিয়েছেন নিউয়ার।

গ্যালারিতে কেউ নেই

করোনাভাইরাসের কারণে দর্শক থাকবে না ফুটবল মাঠে, এটা জানা কথাই। কিন্তু রবিবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে দর্শক না থাকায় এক অভিনব রেকর্ডই হলো! এমন ফাইনালের কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে বটে। পিএসজির মিডফিল্ডার অ্যান্ডার হেরেরা ম্যাচের পর বলেছেন, ‘এটা একটা ভৌতিক ফাইনাল ছিল। আমার কাছে ফুটবলে দর্শক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

প্রথম দল হিসেবে মৌসুমের সব ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ।

তৃতীয় দল হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছে বায়ার্ন মিউনিখ। এর আগে কেবল রিয়াল মাদ্রিদ (৫৬৭) এবং বার্সেলোনা (৫১৭) এই মাইলফলক স্পর্শ করেছে।

ট্রেবল জয়ে বায়ার্ন মিউনিখ স্পর্শ করল বার্সেলোনার রেকর্ড। ২০০৯ ও ২০১৫ সালে প্রথম ইউরোপিয়ান দল হিসেবে দুবার ট্রেবল জয়ের রেকর্ড গড়েছিল কাতালানরা। এবার সেই রেকর্ডটাই স্পর্শ করল বায়ার্ন মিউনিখ (২০১৩ ও ২০২০)।

বায়ার্ন মিউনিখ চ্যাম্পিয়ন্স লিগে/ইউরোপিয়ান কাপে ষষ্ঠবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কেবল রিয়াল মাদ্রিদ (১৩ বার) এবং এসি মিলানই (৭ বার) এরচেয়ে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। লিভারপুল ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

টানা সাতটি দল প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলতে এসে পরাজিত হয়েছে। প্রথমবার ফাইনাল খেলেই সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বুরুসিয়া ডর্টমুন্ড (১৯৯৭)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর