স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও অরক্ষিত রয়ে গেছে রংপুরের অসংখ্য বধ্যভূমি। মুুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার নীরব সাক্ষী এসব বধ্যভূমি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। ছোট-বড় অনেক বধ্যভূমি থাকলেও সরকারিভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র ১৩টি। এর মধ্যে দুটিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও যত্নের অভাবে মলিন হয়ে গেছে। সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ না করায় অযত্ন আর অবহেলায় বাকি বধ্যভূমিগুলো পড়ে আছে।
রংপুরে বধ্যভূমির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রংপুর টাউনহল, দখিগঞ্জ শ্মশান, সাহেবগঞ্জ, দমদমা, বালার খাইল, নব্দীগঞ্জ, লাহিড়ীর হাট, ঘাঘট নদী, নিসবেতগঞ্জ, জাফরগঞ্জ ব্রিজ, বদরগঞ্জের ঝাড়–য়ার বিল ও পদ্মপুকুর এবং মিঠাপুকুর উপজেলার জয়রাম আনোয়ারা বধ্যভূমি। এর মধ্যে নগরীতে রয়েছে ছয়টি বধ্যভূমি।
রংপুরের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হলো রংপুর টাউনহল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই টাউনহলটিকে ‘জল্লাদখানা’ বানিয়েছিল পাকহানাদার বাহিনী। রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা বাঙালি নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে আসত। রাতে পাকসেনারা এসে যে যার পছন্দমতো মেয়েদের নিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালাত। পুরুষদের বিবস্ত্র করে পা উপরে বেঁধে পেটাত আর শরীরের বিভিন্ন অংশে চাকু দিয়ে কেটে দিত। নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যার পর তাদের লাশ টেনেহিঁচড়ে পাশের ইন্দারায় ফেলে দেওয়া হতো। স্বাধীনতার পর এই জল্লাদখানা থেকে ৫০ জন বিবস্ত্র যুবতীকে উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। শত শত শহীদের লাশে ভরে যায় ইন্দারাটি এবং আশপাশের এলাকা। এই জল্লাদখানায় নারীদের ধরে এনে ধর্ষণ করার অভিযোগ রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে এই বধ্যভূমির ওপর গড়ে উঠেছে জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়।
২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম রংপুর জেলা শাখার উদ্যোগে এই বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য ভিত্তি স্থাপন করা হয়। তখন থেকে ওই অবস্থায় সেটি পড়ে আছে।
একাত্তরের ৩ এপ্রিল নগরীর দখিগঞ্জ শ্মশানে নগরীর বুদ্ধিজীবীসহ অনেক বাঙালিকে চোখ বেঁধে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করা হয়। নগরীর দমদমা ব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমিতে শত শত নারী-পুরুষকে ধরে এনে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ টি এম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্য ও পাকসেনারা ৩০ মে রাতে কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসের বাসা থেকে অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায়, অধ্যাপক সুনীল কুমার চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক ড. কালাচাঁদ রায় ও তার স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়কে চোখ, হাত-পা বেঁধে বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে ও ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যা করা হয় কয়েকজন ছাত্র ও কর্মচারীকেও।
একাত্তরের ২৩ মে হত্যা করা হয় বিশিষ্ট আইনজীবী বিজয় চন্দ্রমেন্ট সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জে। এ ছাড়া ১৪ মে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় ঘাঘট নদীর পাড়ে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর ৬০ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী।
নগরীর সাহেবগঞ্জ বধ্যভূমিতে একাত্তরের পহেলা মে রংপুর সেনানিবাস থেকে ১৯ জন বাঙালি সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাকে এনে গুলি করে হত্যার পর একসঙ্গে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। রংপুর সেনানিবাসের পশ্চিমে বালার খাল বধ্যভূমিতে ১২ এপ্রিল নীলফামারীর সৈয়দপুরের আওয়ামী লীগের এমপিএ ডা. জিকরুল হকসহ অসংখ্য বুদ্ধিজীবী এবং শত শত নিরস্ত্র বাঙালিকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৬০ জন সদস্যকে।
বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সেক্টর কমান্ডার ফোরাম রংপুর বিভাগীয় কমিটির সভাপতি মোজাফফর হোসেন চাঁদ বলেন, যাদের রক্তে আজকের স্বাধীনতা। সেই বীর শহীদদের স্মৃতি অবহেলায়-অযত্নে পড়ে থাকাটা দুঃখজনক।