মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অবহেলায় অরক্ষিত বধ্যভূমি

জিন্নাতুন নূর

অবহেলায় অরক্ষিত বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত রাজধানীর অনেক বধ্যভূমি অযতœ -অবহেলায় পড়ে থাকে সারা বছর। ময়লা-আবর্জনাময় রায়েরবাজার বধ্যভূমি -ছবি : জয়ীতা রায়

অযত্ন, অবৈধ দখল, অবহেলা আর উদাসীনতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হওয়া মানুষ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হতে চলছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবরের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যায়নি। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং’ সংগঠনের দেওয়া তথ্যে, রাজধানীর ৭০ বধ্যভূমির অধিকাংশেই এখন অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে আবাসিক ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কাঁচাবাজার ও পাবলিক টয়লেট। আর হাতেগোনা কয়েকটিতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভগুলোও এখন জরাজীর্ণ। তবে দেশের বেশির ভাগ বধ্যভূমিতেই লাগানো হয়নি স্মৃতিফলক। কারণ, সরকারি পর্যায় থেকে এ বিষয়ে কোনো জরিপ নেই। এমনকি ২০১০ সালে বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭১ কোটি টাকার প্রকল্প নিলেও তার গতি নেই। এ ছাড়া মন্ত্রণালয় ১৭৬টি বধ্যভূমি ও গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলেও সেটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। সব মিলিয়ে অবহেলায় একে একে হারিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমি। 

সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত দেশে মোট ২০৯টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ১৯৩টি শনাক্ত করেছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং-এর তথ্যে ৭১ সালে দেশে প্রায় ৫ হাজার ছোট-বড় বধ্যভূমি ছিল। এর মধ্যে সারা দেশে ৯২০টি শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ-কালভার্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে শত শত বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীতে ৭০টি  বধ্যভূমির মধ্যে মিরপুরেই রয়েছে ২৩টি। কিন্তু ২৩টি বধ্যভূমির মধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে মাত্র তিনটি। অযতœ ও অবহেলায় দেশের বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। পবিত্র সে স্থান আজ পরিণত হয়েছে গোচারণ ক্ষেত্রে। মাদকসেবীরা কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় সেখানে মাদক নিচ্ছে। জানা যায়, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি হারিয়ে যাওয়া বধ্যভূমিগুলো রক্ষায় গুগল সার্চ ইঞ্জিনে তৈরি করেছে জিপিএস ম্যাপ। এর মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা যাবে। সংগঠনটির  আহŸায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, পুরো দেশে এ কমিটি ৫ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পেয়েছে। এর মধ্যে নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছে ৯৪৫টি বধ্যভূমির। 

জানা যায়, এরই মধ্যে অনেক বধ্যভূমি মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বধ্যভূমির তালিকায় ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় রয়েছে ৩৯টি বধ্যভূমির নাম। এর মধ্যে উলে­খযোগ্য বধ্যভূমিগুলো হচ্ছে, মোহাম্মদপুর এলাকার আদাবর গণকবর, থানা বধ্যভূমি, রায়েরবাজারের বসিলা ইটখোলা বধ্যভূমি, রায়েরবাজার বধ্যভূমি; মিরপুরের শিয়ালবাড়ি, বাঙলা কলেজ, জল্লাদখানা, হরিরামপুর, মুসলিমবাজার, রাইনখোলা বধ্যভূমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, জগন্নাথ হল, হরিহরপাড়া বধ্যভূমি, রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি, এম এন এ হোস্টেল বধ্যভূমি, ধলপুর ডিপো গণকবর, ঠাঁঠারীবাজার মৎস্যপট্টি বধ্যভূমি, তেজগাঁওয়ের কৃষি ইনস্টিটিউট বধ্যভূমি, সূত্রাপুরের লোহারপুল বধ্যভূমি, কমলাপুরের ধামরাই বধ্যভূমি, কেরানীগঞ্জের বধ্যভূমি ও কুর্মিটোলা সেনানিবাস বধ্যভূমি। এ ছাড়া পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারিবাজার, নারিন্দা খেলার মাঠ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনেও বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মিরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমি সংরক্ষণ করছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং সদস্যসচিব মফিদুল হক বলেন, বধ্যভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়। মুক্তিযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির পরিবারবর্গ ও নাগরিকদের উদ্যোগে দেশের বধ্যভূমিগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব।

রায়েরবাজার ও জগন্নাথ হলের বধ্যভূমি ছাড়া অনেক বধ্যভূমির অবস্থা জরাজীর্ণ। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে এখন হুমকিতে আছে মিরপুরের শিয়ালবাড়ি, আলুদ্দি, মুসলিমবাজার, পল্লবীর কালাপানি, রাইনখোলা, মিরপুরের শিন্নিরটেক, সারেংবাড়ি, গোলারটেক পালপাড়া, বাঙলা কলেজের আমবাগান, কল্যাণপুর বাস ডিপো  ইত্যাদি। জল্লাদখানা ও মুসলিমবাজার বধ্যভূমি ছাড়া বাকিগুলো সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জানা যায়, ১৯৯৯ সালে মুসলিমবাজার বধ্যভূমিটি আবিষ্কার হয়। সে সময় সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এটি খনন করা হলে তখন উঠে আসে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড় ও কঙ্কাল। সরকারি নথিপত্রে বধ্যভূমিটি সংরক্ষিত লেখা থাকলেও এর অধিকাংশ জায়গাই এখন দখল হয়ে গেছে। ঠিক যে জায়গায় কূপ ছিল, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়েছিল, সে জায়গাটি দখল করে টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ডা. এম এ হাসান বলেন, মিরপুরের মুসলিমবাজার বধ্যভূমির জায়গায় টয়লেট নির্মাণ করে শহীদদের প্রতি অসম্মান করা হয়েছে। ঢাকার রায়েরবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধটি বছরের ১১ মাসই অবহেলায় পড়ে থাকে। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে কর্তৃপক্ষ এ স্মৃতিসৌধটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে। বছরের অন্যান্য সময়ে দিনে-রাতে এ স্মৃতিসৌধ ঘিরে চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। স্থানীয়রা এখানে নিয়মিত ক্রিকেট খেলে। চারপাশে পড়ে থাকে বিভিন্ন খাবারের উচ্ছিষ্ট। জলাধারটির পানিতেও অধিকাংশ সময় ময়লা থাকে। এখানে নেই কোনো নিরাপত্তা প্রহরী। স্মৃতিসৌধের পেছনে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা।

নিষেধ সত্তে¡ও দেয়ালের ওপর উঠে স্থানীয়রা আড্ডা দেয়। একই অবস্থা মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের। ডা. এম এ হাসান বলেন, ঢাকার বধ্যভূমিগুলোর বড় একটি অংশ রয়েছে মিরপুরে। কিন্তু এর বেশির ভাগই বেহাল অবস্থায়। রায়েরবাজার বধ্যভূমির পরিবেশ অত্যন্ত খারাপ। বিশেষ দিন ছাড়া রায়েরবাজার বধ্যভূমির রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। দেশে বধ্যভূমিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা একটি বিভাগ থাকা উচিত।

সর্বশেষ খবর