মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ছাদকৃষিতে ঝুঁকছে নগরবাসী

অসংখ্য মানুষ নতুন করে করোনাকালে ছাদকৃষিতে যুক্ত হয়েছেন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ছাদকৃষিতে ঝুঁকছে নগরবাসী

সাজিয়া রহমানের ছাদকৃষি, রাজধানীর উত্তরায় ছবি : রোহেত রাজীব

কচি পাতার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে জামরুলের থোকা। হালকা হরিৎ গায়ে লাল আভার জামরুল দেখে মনে হচ্ছে একঝাঁক টিয়া পাখি ঠোঁট বের করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পাশেই চৈত্রের কড়া রোদের আঁচ থেকে বাঁচতে মাচানের বেষ্টনীতে ঝুলছে মাঝারি গড়নের লাউ। চিলেকোঠার টবে উঁকি দিচ্ছে লাল টমেটো, কাঁচা মরিচ আর বেগুন। সিঁড়ি ধরে নামতেই চোখ জুড়ায় আম, কলা, সফেদা, পেয়ারা, আনার, আনারস আর জাম্বুরা মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি গাছের কচি পাতা, ফুল আর মুকুলের ঘ্রাণ। বড় গাছের বৃত্ত থেকে মাথা তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পুঁইশাকের কোমল পাতা। আর ছাদের ধার ঘেঁষে হাওয়ায় শিমের কচি ডগা আর বাহারি মৌসুমি ফুলের শাখা-প্রশাখা।

রাজধানীর উত্তরা এলাকার সাজিয়া রহমানের ছাদের দৃশ্য এটি। তার ছাদকৃষির গল্প শুনতে চাইলে বলেন, আমার মায়ের খুব গাছ লাগানোর শখ ছিল। ছোটবেলা থেকে মায়ের দেখাদেখিই আমার গাছের প্রতি ভালোবাসা। ভাড়া বাসায় থাকাকালীন বেলকুনিতে গাছে ভরিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু জায়গা কম থাকায় ফলের গাছ লাগাতে পারতাম না। তাই যখন নিজেদের বাড়ি হলো তার তিনটি ফ্লোরে শুধু বাগানের জন্যই জায়গা রেখেছি। আমার ছাদের এই বাগানে শাক, সবজি, ফল, ফুল সব ধরনের ছোট-বড় গাছ রয়েছে। ছাদে আলু, কচু পর্যন্ত লাগিয়েছি। গাছগুলো সন্তানের মতো। বীজ ফেলে চারার আগমনের অপেক্ষায় এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। প্রতিদিন প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে গাছের  পেছনে। কিন্তু এই সবুজের দিকে তাকালে যে কারও মন ভালো হতে বাধ্য।   

সাজিয়া রহমানের মতো এমন গাছপ্রেমী উদ্যোগী মানুষের সংখ্যা এখন বাড়ছে। শখের ছাদবাগান এখন রূপ নিচ্ছে ছাদকৃষিতে। রাজধানী পাড়ার গন্ডি পেরিয়ে এ বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে মফস্বলের অলিগলিতে। শস্য শ্যামল বাংলার প্রকৃতি চোখ জুড়ায় তার সবুজের অভয়ারণ্যে। কিন্তু সভ্যতার চাকায় ভর করে ইট-কাঠ, পাথরের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। তাই প্রকৃতি বাঁচিয়ে সবুজের স্পর্শ পেতে নীলাভ আকাশের নিচের খোলা ছাদকেই বেছে নিচ্ছেন দালানের বাসিন্দারা। প্রথম দিকে ছাদের কোনায় টবে রকমারি মৌসুমি ফুল লাগানো ছিল মানুষের শখ কিন্তু শৌখিনতা থেকে এখন কৃষি খাতে অবদান রাখতে শুরু করেছে ছাদের ফলমূল-সবজি।

মোহাম্মদপুরের রফিকুল ইসলাম এবং তার পরিবার মিলে গড়ে তুলেছেন ফল, ফুল আর সবজির এক বিশাল সমারোহ। পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার হাতের স্পর্শে কোনো রকমের কীটনাশক ছাড়াই তরতাজা হয়ে উঠছে সবুজ চারাগুলো। রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথম দিকে শখের বশে ছাদে ফুল গাছ লাগাতাম। এরপর মরিচ, টমেটো, পুদিনা পাতাসহ বিভিন্ন রকমের শাক লাগানো শুরু করলাম। এরপর লাউ, বেগুন, করলা, শিম থেকে শুরু করে বাগানে আম, জামের গাছও রয়েছে। নিজেরা খেয়ে বন্ধুদের উপহার দিয়েও অনেক সবজি থেকে যায়। এলাকার এক সবজি বিক্রেতার কাছে বাড়তি শাক-সবজি বিক্রি করে দেই। নিজেদের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে তিন মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় হয় ছাদ কৃষি থেকে।

জানা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে ছাদকৃষি। দক্ষিণ আফ্রিকায় জোহানেসবার্গের ছাদে বাগান তৈরির পাশাপাশি হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ও পানির অপচয় না করে সেখানে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হচ্ছে। জার্মানিতে ১২ শতাংশ ছাদে সবুজ গাছ রয়েছে। টোকিও সরকার বলছে, যদি তাদের অর্ধেক ছাদ সবুজ হয় তাহলে প্রতিদিন এয়ারকন্ডিশনে ব্যবহৃত জ্বালানি বাবদ এক মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়। তাই টোকিওর আইনে সব বাড়ির নতুন ছাদে অন্তত ২০ শতাংশ সবুজ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ক্রমাগত বৈশ্বিক উষ্ণতা রাজধানী ঢাকার টুঁটি চেপে ধরেছে। উষ্ণতা বাগে আনতে কমাতে হবে কার্বন নিঃসরণ, বাড়াতে হবে অক্সিজেন। ঢাকায় অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে ছাদবাগান হতে পারে বড় উৎস। এরই মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ছাদবাগানের মালিকদের গৃহকর রেয়াতের আওতায় এনে তাঁদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ছাদবাগান করলে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফের ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। গত ২৫ আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বরে মুকুল ফৌজ মাঠে ১ লাখ চারা রোপণ কর্মসূচি উদ্বোধন করার সময় এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে ২০১৬ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ছাদবাগান করলে ট্যাক্স রেয়াত দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের জুনে ১ হাজারের বেশি বাড়ির মালিক ছাদবাগান করে কর মওকুফের সুবিধা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির কর কর্মকর্তারা। করোনাকালের আতঙ্কের সময়ে ছাদকৃষিতেই সময় কাটছে অনেকের। অসংখ্য মানুষ এখন নতুন করে ছাদকৃষিতে যুক্ত হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর