শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০১৩ ০০:০০ টা

একজন সাধারণের চোখে অসাধারণের গল্প

জুলফিকার শাহাদাৎ

একজন সাধারণের চোখে অসাধারণের গল্প

২০০৬ সাল। আমি তখন গ্রামীণ ব্যাংক পাইকপাড়া, ফরিদগঞ্জ (চাঁদপুর) শাখার ম্যানেজার। ওই শাখায় কর্মরত অবস্থায় গ্রামীণ ব্যাংকের মিডিয়া বিভাগের দায়িত্ব নিতে আমাকে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়। বিভাগটা নতুন। আমিই এ বিভাগের প্রথম সদস্য। আমার দায়িত্ব গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সংক্রান্ত প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যাবতীয় দিক দেখা, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত যাবতীয় খবরাখবর তার কাছে প্রতিদিন উপস্থাপন করা, বিভিন্ন নেতিবাচক সংবাদের প্রতিবাদের খসড়া তৈরি করা ও অনুমোদিত খসড়া পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করা।

একবার দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় ওয়াহিদুল হক তার 'অভয় বাজে হৃদয় মাঝে' কলামে আমার স্যার ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের কড়া সমালোচনা করে একটা কলাম লিখেন। আমি এ কলামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি খসড়া তৈরি করি। স্যার আমার খসড়া থেকে আক্রমণাত্দক সব কটি শব্দ বাদ দিয়ে তারপর তা পত্রিকায় পাঠাতে অনুমতি দেন। একই ঘটনা ঘটেছিল বদরুদ্দীন উমরের ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি কলামকে ঘিরেও।

কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী কারণে-অকারণে স্যার ও গ্রামীণ ব্যাংককে সমালোচনা করে কলাম লিখেন। একবার এ বিষয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বললে স্যার বলেন, 'লিখুক, লিখতে থাকুক'। একবারও কারও প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে স্যারকে দেখিনি।

কোনো ফাইল আটকে রাখার নজির স্যারের মধ্যে দেখিনি। সময়ের ব্যাপারে তিনি এত সচেতন, মাঝে-মাঝে নিজেদেরই এ নিয়ে লজ্জায় পড়তে হতো। স্যার তো প্রায়ই বিদেশ থাকেন। বিদেশ থেকে এলে কত দ্রুত ফাইল ছাড় করবেন এ নিয়ে তিনি তৎপর থাকতেন। বাসা ও অফিস তখন তার কাজের ক্ষেত্র হয়ে যেত।

একটি ঘটনা বলি, আনু মুহাম্মদ সাপ্তাহিক ২০০০-এ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ও স্যারকে নির্দয় ভাষায় আক্রমণ করেন। স্যার তখন আমেরিকায়। আমরা স্যারের কাছে ফ্যাঙ্ করে লেখাটির কপি পাঠালাম। স্যার দ্রুত এর প্রতিবাদ করতে নির্দেশ দিলে আমি বন্ধের দিন অফিসে এসে প্রতিবাদের খসড়া তৈরি করি। স্যারের ল্যাপটপে বাংলা ফন্ট নেই। তাই বাধ্য হয়ে স্যার যে হোটেলে উঠেছেন ওই হোটেলের ঠিকানায় খসড়াটি ফ্যাঙ্ করি।

অবাক ব্যাপার, স্যার পুরো ড্রাফটি নিজের হাতে লিখে তৈরি করেন এবং তা আবার আমাদের কাছে ফ্যাঙ্ করেন। তার প্রেরিত ফ্যাঙ্ কপি টাইপ করে আমি পত্রিকায় সরবরাহ করি।

আরেকটি ঘটনা বলে লেখাটির ইতি টানব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় স্যারকে উদ্দেশ করে বললেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ড তদন্ত করা হবে' সে দিন স্যার দেশের বাইরে।

প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্যের পর আমরা স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম। স্যার তখন একটি কনফারেন্সে ছিলেন। তিনি তখন কথা বলতে পারছিলেন না। যখন পুরো বিষয়টি জানিয়ে তাকে মেইল করা হয় তখন তিনি দ্রুত যে মেইলটি আমাদের কাছে পাঠান, তা হলো-‘Ami Manonio Prodhanmontrir e todonther uddugke sogoto janai.’ 

ঠিক এভাবেই লিখেছিলেন। ইংরেজি ফ্রন্টে বাংলা। প্রথমে ইংরেজিতে লিখেছিলেন। আমরা অনুবাদে ভুল করব কি-না, এই ভেবে তিনি এভাবেই পরে তার মতামত পাঠিয়েছিলেন।

এমন তৎপর কর্মবীর, ধৈর্যশীল, বিনয়ী, নিরহংকারী, সৃজনশীল, উদ্যোমী ও নেতৃত্ববান অসাধারণ মানুষটিকে আমার শিক্ষক ভাবতে গেলে গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠে।

স্যার, জন্মদিনে আপনার প্রতি আমার লাখো সালাম।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

 

 

সর্বশেষ খবর