শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

চা বিক্রেতা এখন প্রধানমন্ত্রী

সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত মোদিই হতে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। মোদির উত্থান ও আনুষঙ্গিক বিষয় জানাচ্ছেন- রণক ইকরাম ও তানভীর আহমেদ

চা বিক্রেতা এখন প্রধানমন্ত্রী

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গুজরাটের মেহসানা জেলায় একটি সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নরেন্দ্র মোদি। বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার বাবা দামোদর দাস একটা ছোট্ট দোকানে চা বানাতেন। কেটলিতে চা ভরে ভাদনগর রেলস্টেশনের ট্রেনযাত্রীদের কাছে বিক্রি করতে যেতেন ছোট্ট মোদি। তাদের থাকার বদ্ধঘরটিতে কেরোসিনের কুপিই ছিল একমাত্র ভরসা। মোদিকে যারা ছোটবেলা থেকে চেনেন তারা বলেন, তিনি ছিলেন সাধারণ ছাত্র। আর মোদির মতে, তিনি চার দশক ধরে একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং 'নবরাত্রি'-তে শুধু পানি খেয়ে উপবাস করে আসছেন।

 

যাযাবর জীবন

জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতে, মোদি খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু টেকেনি। তার ওই বিয়ের কথা গোপন রাখতে হয়েছিল। কারণ তা না হলে আরএসএসের [রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ] একজন 'প্রচারক' হতে পারতেন না। স্কুলেই মোদি তার বাগ্মিতা দিয়ে আকর্ষণ কেড়েছিলেন। তিনি প্রায়ই পরিবার থেকে বের হয়ে পড়তেন। মাসের পর মাস বিভিন্ন নির্জন এলাকা, হিমালয়ের আশপাশ ঘুরে বেড়াতেন। একবার গিরিবনের একটি ছোট্ট মন্দিরে আবাস গড়েন। ১৯৬৭ সালে তো পরিবার থেকে একেবারেই বের হয়ে পড়েন।

 

অন্য জীবন শুরু

মোদি আরএসএসে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান [বাংলাদেশ]-পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধের পর। তিনি দিলি্লতে আরএসএসের অফিসে চলে আসেন। ভোর ৪টায় ঘুম থেকে ওঠে অফিস পরিচ্ছন্ন থেকে শুরু করে চা বানানো, সিনিয়র নেতাদের নাস্তা বানানো ও চিঠিপত্রের জবাব লিখতেন। বাসন-কোসন পরিষ্কার করা ও পুরো বিল্ডিংটাই ঝাড়পোছ করে পরিষ্কার করতেন। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জেলে পোরা শুরু করলে মোদি গুজরাটে ফিরে আসেন। আত্দগোপন করলেও মাঝেমধ্যে দিলি্লর কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লিফলেট, পুস্তিকা ছাপিয়ে বিলি করতেন। রাজনীতিতে পুরোপুরি যুক্ত হওয়ার পরও দিলি্ল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেন এবং গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে যান মাস্টার্স করতে। এর মধ্যেই কঠোর পরিশ্রম ও দক্ষতার কারণে ১৯৮৭-৮৮ মেয়াদে বিজেপির গুজরাট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।

 

রাজনৈতিক মাঠ কাঁপিয়ে তোলা

গুজরাটের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ভারতবাসী অন্য এক মোদিকে দেখতে পেল। মুহূর্তেই তিনি গুজরাট বিজেপির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের মুঠোয় নিয়ে আসেন সর্বস্তরের কর্মীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের মাধ্যমে। ভাগ্যের সহায়তা আর নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় আস্তে আস্তে শীর্ষে চলে আসেন মোদি। মোদির বর্তমান এ অবস্থানের পেছনে ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রভাব রয়েছে, যার পেছনে তার সরকারের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ। সে অভিযোগ পেছনে ফেলে সময়ের পরিক্রমায় মোদি উন্নয়নের আদর্শ ও সুশাসনের দলীয় মডেল হয়ে পড়েন তিনি। ফলাফল ভারতের লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

 

টার্নিং পয়েন্ট

এভাবে চা বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। দিনের পর দিন দলের একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শীর্ষে আরোহণ করতে মোদিকে পার করতে হয়েছে অনেক কঠিন সময়। মোদির আসল উত্থান ২০০২ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময়। সে সময় হিন্দু দাঙ্গাবাজদের উসকে দিয়ে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রে মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও গুরু আদভানির কল্যাণে বেঁচে যান। ২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অভিষেক হয়েছিল অনভিজ্ঞ মোদির। তারপর মাত্র ১২ বছরের মাথায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী।

 

ব্যক্তিগত জীবন

বিয়ের ব্যাপারে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনো দিন মুখ খোলেননি মোদি। এর আগে চারবার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিলেও আবেদন ফর্মে স্ত্রীর কলামটি বরাবরই ফাঁকা রেখেছিলেন। পরিবারের ঐতিহ্য মেনে ১৭ বছর বয়সেই যশোদাবেনকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। ব্যাচেলর বা কুমার জীবন কাটানোর প্রতি তীব্র ঝোঁক থাকায় যশোদাবেনের সঙ্গে বিয়ে কখনো মেনে নেননি মোদি। একইভাবে যশোদাবেনও একাকী থাকার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের সময় উভয়ের বয়স ছিল ১৭। বর্তমানে তাদের বয়স ৬২ বছর। কীভাবে বিয়েটা ভাঙল, তা মোদি জানাননি। তিনি বিয়েটা চেপেই যাচ্ছিলেন। যশোদাবেনের সঙ্গে মোদির বিয়ে টিকেছিল তিন বছর। এরপর তাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। মোদিও আর বিয়ে করেননি। ২০০৯ সালে একটি ম্যাগাজিন যশোদাবেনকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। গুজরাটের বডোদরায় মনোনয়নপত্র পেশের সময় হলফনামায় প্রথমবার স্ত্রী হিসেবে যশোদাবেনের নাম লেখেন। এরপর অনেক বিতর্ক হলেও সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে ঠিক প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠলেন মোদি।

 

সর্বশেষ খবর