সম্রাটের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী বাগোয়াস উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সম্রাটের সামনে এসে কুর্নিশ করে তারপর নিজের আসনের কাছে ফিরে গেলেন। তার জন্য নির্ধারিত পানপাত্র হাতে নিলেন এবং তাতে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ লাগিয়ে হাস্যমুখে সম্রাটের দিকে সেটি এগিয়ে ধরলেন। সম্রাটের মুখে তখন বিজয়ের হাসি। তিনি হাসতে হাসতে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিলেন এবং নিজের পানপাত্রটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়ে অপর পক্ষেরটি নিজের হাতে নিলেন। এবার পানপাত্রে চুমুক দেওয়ার পালা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সভ্যরা ঘটনার আগপাছ সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তারা উদ্ভূত পরিস্থিতিটিকে খুবই স্বাভাবিক বলে ধরে নিল এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্রাটের বদান্যতায় যারপরনাই খুশি হলো। প্রধানমন্ত্রী তার পানপাত্রটি হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন এবং তা পান করার আগে সমবেত অতিথিদের উদ্দেশে বললেন-
আমার প্রিয় পারস্যবাসী! আজ আমি খুবই আনন্দিত। নিজেকে আমার ভীষণ সম্মানিত বান্দা বলে মনে হচ্ছে। সদাশয় সম্রাট আমাকে যে সম্মান প্রদর্শন করলেন তা বিশ্বরাজনীতিতে অবশ্যই একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমি জানি না আমার জীবনের অন্তিম পরিণতি কি হবে! আমি এ কথাও জানি না যে আমি এই ধরাধামে কতদিন বা কতক্ষণ জীবিত থাকব। আমার সুদীর্ঘ জীবনে সব সময়ই মনে হয়েছে আমার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা উচিত। কিন্তু আজ সদাশয় সম্রাটের সুমহান স্বীকৃতি এবং মর্যাদা লাভের পর মনে হচ্ছে আমার এই মুহূর্তে মরা উচিত। কারণ এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সৌভাগ্যবান, মর্যাদাবান এবং সুখী মানুষ হয়তো দুনিয়াতে একটিও নেই। আমার ভয় হচ্ছে আজকের রাতের পর যদি বেঁচে থাকি আর পরবর্তী সময়ে সদাশয় সম্রাট যদি একটি মাত্র মুহূর্তের জন্য আমার প্রতি বিরূপ হয়ে পড়েন তবে আমার সারা জীবনের সাধনা এবং সুনাম রসাতলে যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে উপস্থিত মেহমানরা অতিশয় চমকিত হলেন। তারা সমস্বরে সম্রাট এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে সাধু! সাধু! মহান সাধু- শব্দমালা উচ্চারণ করতে থাকলেন। সম্রাট নিজেও আনমনা হয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবলেন, প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে যোগ্যতম এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা! ইস! লোকটি যদি চক্রান্তকারী শয়তান না হতো তাহলে সালতানাতের জন্য তার চেয়ে উত্তম লোক আর কে হতো। প্রধানমন্ত্রী বাগোয়াস পুনরায় মুখ খুললেন। তিনি আসমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আমার দেবতা! তুমি সব কিছু অবগত। সারাজীবন আমি যে কর্ম করে এসেছি তার প্রতিদান কোনো দিন তোমার কাছে চাইনি। আপন বাহুবল এবং তীর-ধনুক আর তলোয়ারের শক্তিবলে আমি সর্বদা সৌভাগ্যকে হাসিল করেছি এই দুনিয়ার মাটিতে। দুনিয়ার অর্জন দিয়ে সারাটা সময় আমি তোমার প্রণতি দিয়েছি- বিনিময়ে তোমার সন্তুষ্টি ছাড়া কিছু চাইনি। কিন্তু আজকের এই শুভক্ষণে তোমার কাছে চাইবো- হে মোর দেবতা! আমার মৃত্যু দাও! আমার সম্রাটের উপহার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার মৃত্যু হয়। এই কথা বলে প্রধানমন্ত্রী সম্রাটের মৃত্যুর জন্য যে ফাঁদ পেতেছিলেন সেই ফাঁদে পা দিয়ে নিজের হাতে মেশানো বিষের পেয়ালা নিজেই পান করতে আরম্ভ করলেন। তীব্র বিষের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী অচিরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। আমন্ত্রিত অতিথিরা সব ধন্য ধন্য বলতে শুরু করলেন। অন্যদিকে সম্রাট তৃতীয় দারায়ুস মনে মনে পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে থাকলেন।পারস্যের সেনাপতিরা মেসিডোনিয়ার রাজপথে রাজা আলেকজান্ডারকে প্রথমে দেখার পর তাদের মনে পড়েছিল তাদের সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসের কথা। তুলনামূলক বিচারে যদি পোশাক-পরিচ্ছদের কথা চিন্তা করা হয় তবে পারস্য সম্রাটের সাধারণ সৈনিকরাও গ্রিকের সেনাপতিদের তুলনায় উত্তম পোশাক পরিধান করে থাকে। অন্যদিকে সম্রাট দারায়ুস এবং রাজা আলেকজান্ডারকে যদি পাশাপাশি বসানো হতো তাহলে পারস্য রাজের কাছে গ্রিক রাজা ছিল একেবারেই বেমানান। আর এ কারণেই গ্রেফতারের সময় তারা রাজাকে কুর্নিশ করেনি। কিন্তু বিনোদন কেন্দ্রে আসার পর মেসিডোনিয়া, গ্রিকের অন্যান্য নগররাষ্ট্র এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ সম্পর্কে তাদের ধারণাই পাল্টে যায়। বিশেষ করে মেসিডোনিয়ার নতুন রাজা আলেকজান্ডারের জন্ম, তার ক্ষমতায় আরোহণ, তার বীরত্ব এবং তার ভুবনবিখ্যাত শিক্ষক এরিস্টটলের কথা শোনার পর রাজার প্রতি এক ধরনের সম্ভ্রম পয়দা হয়।
সেনাপতি চোখের ইঙ্গিতে কামরায় বিনোদন কর্মে নিয়োজিত ললনাদের সরে যেতে বললেন। এরপর পারস্য সেনাপতিদের উঠে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন। সেনাপতিত্রয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে সেনাপতি টার্ডিসের মুখের দিকে তাকাতে চেষ্টা করলেন। তারপর লজ্জা সংকোচ আর দ্বিধায় মাথা নিচু করে নিজেদের মানবিক দুর্বলতার জন্য আপনমনে নিজেদের ধিক্কার জানাতে থাকলেন। তারা টের পেলেন তরুণ রাজার সামান্য একটু কূটচালে তারা তাদের নীতি, নৈতিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং সততা বিসর্জন দিয়ে নিম্নশ্রেণীর ইতর প্রাণীর মতো তিনজন লোক মিলে তিনজন নারীর সঙ্গে যেভাবে আচরণ করছিলেন তা সাধারণত কোনো নিম্নশ্রেণীর পতিতালয়ের খরিদ্দাররাও করে না। স্বদেশ থেকে পালিয়ে আসার গ্লানি, মাথার ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে, ক্ষুধা, ক্লান্তি এবং মেসিডোনিয়ার রাজপথে হঠাৎ রাজা কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার পর তারা সম্ভবত কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর বিনোদন কেন্দ্রে ঢোকার পর তাদের মনে হয়েছিল যেন তারা স্বপ্নে দেখছেন।
বড় অদ্ভুত কায়দায় তাদের বিনোদন কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছিল। গ্রেফতার করার পর পরই সেনাপতিদের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে ফেলা হয়। এরপর তাদের নেওয়া হয় বিনোদন কেন্দ্রে। সারা শরীর অতি উত্তমভাবে ধৌত করার পর পরিধেয় বস্ত্র পরিবর্তন করা হয়। ইতিমধ্যে তাদের মাল-সামান এবং অর্থকড়ির বহর দেখে রাজার লোকজন নিশ্চিত হয় যে, রাজার সন্দেহই সঠিক। অর্থাৎ গ্রেফতারকৃতরা পারস্য সম্রাটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা যে গোয়েন্দাগিরি নয় বরং কোনো অপরাধ করে পালিয়ে এসেছেন তাও মোটামুটি নিশ্চিত হলো বাঙ্-পেটরার নমুনা দেখে। এদিকে ওষুধের প্রতিক্রিয়া শেষ হওয়ামাত্র সেনাপতিত্রয় তাদের বিছানায় ঘুম বিজড়িত চোখে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তাদের রাখা হয়েছিল বিশালাকার বিলাসবহুল একটি কামরায়। কামরাটির মেঝে ছিল ধবধবে সাদা মার্বেলে তৈরি আর দেয়াল ছিল রং বে রংয়ের বাহারী সব মার্বেল দিয়ে কারুকাজ করা। এটি ছিল একদম সমুদ্রের কিনারে। বড় বড় দুইটি জানালায় ছিল মিসর দেশি সাদা রংয়ের মখমলের পর্দা। সমুদ্রের বাতাস এবং ঢেউয়ের গর্জন যুগপৎভাবে কামরার ভিতরে প্রবেশ করে কামরার বাসিন্দাদের এক অনন্য সুখানুভূতিতে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল বার বার।
কামরাটি ছিল ৬ কোণবিশিষ্ট অদ্ভুত এবং অনন্য শিল্প মাধুরীতে তৈরি। প্রতি দুই কোণের মাঝখানে একটি করে সুসজ্জিত খাট। এভাবে তিনটি খাট এমন কৌণিকভাবে স্থাপন করা হয়েছে যাতে ইচ্ছা করলে কামরার বাসিন্দা নিজেদের পরস্পরের কাছে অদৃশ্য করতে পারবেন। আবার তারা যদি খাটের এক প্রান্তে এসে বসেন তবে পরস্পরকে দেখতে পাবেন। কামরার মাঝখানের ছাদের সঙ্গে ঝুলছে অতিশয় সুদৃশ্য স্বর্ণ নির্মিত ঝাড়বাতি। আর সেই ঝাড়বাতির ঠিক নিচে রয়েছে একটি গোলাকৃতির টেবিল, ওক গাছের কাঠ দ্বারা নির্মিত। টেবিলের উপর সাজানো রয়েছে থরে থরে টাটকা নানা জাতের সুমিষ্ট ফলফলারি, মধু এবং পানির জগ। সেনাপতিরা চোখ খুলে কামরার সাজসজ্জা, আয়োজন কিংবা অবস্থান নিয়ে যেই না চিন্তা করতে যাবেন ঠিক তখনই কামরায় প্রবেশ করল ৩ জন অপরূপ সুন্দরী রমণী। তারা ৩টি খাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সেনাপতিরা তাদের একনজর দেখামাত্রই চোখ বুঝলেন এবং মনে মনে ভাবলেন হয়তো স্বপ্ন দেখছেন।
রমণীরা এরপর খাটের কিনারে বসে সেনাপতিদের হাত-পা টিপতে থাকলেন। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গে রমণীরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে এমনভাবে ম্যাসেজ করে দিল যে, অল্প কিছুক্ষেণের মধ্যেই তারা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। শরীরের জড়তা কেটে যাওয়ার পর তারা উঠে বসলেন এবং ললনাদের নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকলেন। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তারা কেবল হাসতে থাকলেন এবং একটু পর পর উঠে গিয়ে ফলফলারি, মধু এবং পানীয় পরিবেশন করতে থাকলেন। ফলে শরীরে এক সময় উত্তেজনা দেখা দিল। সেনাপতিরা কোনো কিছু না ভেবেই প্রথমে মেয়েদের শরীরে হাত রাখলেন এবং কাছে টেনে নিয়ে বুকের ওপর শুইয়ে রাখলেন। মেয়েরা কোনো বাধা দিল না, বরং অর্থপূর্ণ বাঁকা হাসি দিয়ে পুরুষগুলোর মনের জ্বালা বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। এ অবস্থায় পুরুষরা উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে যেই না পরবর্তী কর্মসূচির দিকে এগুবে ঠিক তখনই টার্ডিস কামরায় ঢুকলেন। টার্ডিস পারস্য সেনাপতিদের বললেন, প্রিয় ভদ্র মহোদয়রা! আমাদের সদাশয় রাজা আলেকজান্ডার অধীর আগ্রহ নিয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি খুবই দুঃখিত যে, আপনাদের সুখময় মুহূর্তের সময় আমি নিতান্ত বেরসিক একজন মানুষের মতো এখানে ঢুকে পড়েছি। আপনাদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। মহামতি রাজা আপনাদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এখানে রেখে মেহেমানদারী করতে চান যদি আপনারা তার কথামতো চলেন এবং তিনি যা জানতে চান তা ঠিক ঠিক মতো বলে দেন। তিনি কিছুই চান না আপনাদের কাছে কেবল আপনাদের সম্রাট, সাম্রাজ্য সম্পর্কে কিছু রাজনৈতিক এবং সামরিক তথ্য ব্যতিরেকে। আপনারা যদি সততার সঙ্গে ঠিকভাবে তথ্যগুলো জানাতে পারেন সেক্ষেত্রে এই বিনোদন কেন্দ্রের সবকিছুই হবে আপনাদের। আপনারা এখানে থাকতে পারবেন যতদিন ইচ্ছা ততদিন। এখানকার রমণী, বিত্ত-বিলাস, উদ্যান এবং চমৎকার ঘোড়াগুলো সবকিছুই আপনাদের জন্য অবারিত করে দেওয়া হবে।
যে তিনজন সেনাপতি পারস্য থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তাদের নাম ছিল আমেন, রিকজা এবং নজভী। তিনজনই একেকটি রেজিমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাদের একেকজনের অধীনস্থ সৈন্যসংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ তাদের দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তপথের প্রবেশমুখে স্থাপিত ক্যান্টনমেন্টের প্রধান সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের বয়স যেদিন ১৭ বছর পূর্ণ হয়েছিল সেদিনই পারস্যবাহিনীতে সরাসরি অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তৎকালীন সম্রাট এবং রাজ পরিবারের সঙ্গে রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত পরিবারের মেধাবী, সাহসী, শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান যুবকদের সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। সাধারণ সৈনিক নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশ, জাতি, বংশ মর্যাদা, আভিজাত্য ইত্যাদি বিবেচনা না করে কেবল বীরত্ব বা যুদ্ধ করার ক্ষমতাই ধর্তব্যের মধ্যে আনা হতো। কিন্তু সেনা কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কড়াকড়ি ছিল অস্বাভাবিক।
আমেন, রিকজা এবং নজভী পারস্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় সমসাময়িক সময়ে। তাদের কর্ম পদোন্নতি এবং পতনও হয়েছিল একইসঙ্গে। তারা শৈশবে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন এবং আত্দীয়তার বন্ধনের পাশাপাশি তাদের বন্ধুত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন বটে এবং সম্রাট তৃতীয় দারায়ুস সম্পর্কে তাদের ধারণাও ভালো নয়, তথাপি তারা নিজের দেশের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে বিদেশি কোনো রাজাকে সাহায্য করবেন এমন কথা কল্পনাও করতে পারছিলেন না। প্রায় ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজরক্তের টনটনে আভিজাত্য এবং স্বদেশ প্রেমের মোহময় আকর্ষণ তাদের যারপরনাই আহত করে তোলে। সেনাপতি আমেনই প্রথম মুখ খুললেন।
তিনি টার্ডিসকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, সম্মানিত জনাব! আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, আমরা আপনাদের জালে বন্দী হয়ে পড়েছি। জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটি বিরাট অংশ আমরা ক্ষমতা, বিত্তবৈভব আর মর্যাদার মধ্যে কাটিয়েছি। আমাদের আজকের দুর্ভোগের জন্য আমাদের রাষ্ট্র বা সম্রাট দায়ী নন। আমাদের অতিমাত্রার অহংকারী মনোভাব, বেপরোয়া চালচলন এবং প্রতিপক্ষের কূটচালের কারণে আমরা মহামতি সম্রাটের রোষানলে পতিত হয়েছি। আমাদের খুব ভয় হতে লাগল যখন আমরা এত্তেলা পেলাম সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য। আমাদের অপরাধী মন আমাদের সম্রাটের দরবারের দিকে তাড়িত না করে তাড়িত করল সাগরের দিকে- তারপর আপনাদের রাজ্যে। আজ এ প্রাসাদের শত সহস্র নেয়ামতের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বার বার কেবল নিজ দেশের কথা মনে পড়ছে। আর মনে পড়ছে বিভিন্ন সময়ে সম্রাটের কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্মান এবং সহানুভূতির কথা। কাজেই আপনারা আমাদের কারাগারে নিক্ষেপ কিংবা হত্যাও করতে পারেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের কাছ থেকে কোনো নেমকহারামি ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক তথ্য আদায় করতে পারবেন না। এই কথা বলে সেনাপতি আমেন ডানে বামে ফিরে তার অপর দুই সঙ্গী রিকজা ও নজভীর দিকে তাকালেন। তারাও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন।
সেনাপতি টার্ডিস বয়সে তরুণ হলেও জ্ঞান, বিজ্ঞান, ভূগোল এবং দর্শনশাস্ত্রে ছিলেন অতিশয় পারদর্শী। তিনি একাধারে রাজা আলেকজান্ডারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বিশ্বস্ত সহচর এবং সতীর্থ। মহামতি এরিস্টটলের কাছে দুজনেই একত্রে শিক্ষালাভ করেছেন।
তাই টার্ডিসের প্রজ্ঞা ছিল সমসাময়িক বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠতর। তিনি বুঝলেন পারস্য সেনাপতিরা আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো নন। তাই তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, সম্মানিত মেহমানবৃন্দ! আমি বোধহয় আমার বক্তব্য দ্বারা আপনাদের মর্যাদা, পদ-পদবি কিংবা মনুষত্বকে অপমান করেছি। আমার এত কথা বলা ঠিক হয়নি। আমার বলা উচিত ছিল যে, মহামতি রাজা আলেকজান্ডার আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি খুবই দুঃখিত এবং অনুতপ্ত রাজার পক্ষে আমন্ত্রণ জানাতে এসে অতিরিক্ত কথা বলে ফেলার জন্য। পারস্যের সেনাপতিরা গ্রিক সেনাপতি টার্ডিসের কথা শুনে মোমের মতো গলে গেলেন। তারা চোখে মুখে বন্ধুত্বের হাসি ফুটিয়ে তুললেন। এবার মুখ খুললেন সেনাপতি রিকজা। তিনি বললেন, আমরা অবশ্যই মহামান্য রাজা আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। আমাদের সাক্ষাৎ এবং সম্ভাব্য আলোচনা সম্পর্কে কোনো পূর্ব ধারণা করাটা হবে মহামান্য রাজার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ওপর এক ধরনের জুলুম। আমরা এখন কার্যত বন্দী। রাজা কোনো বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এটা বন্দীর জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য এবং আশার বাণী। আমরা নিশ্চয়ই নিতান্ত নির্বোধের মতো সেই সৌভাগ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত করব না। হে সম্মানিত সেনাধ্যক্ষ! আপনি আমাদের নিয়ে চলুন আপনার মালিকের কাছে। টার্ডিস পারস্য সেনাপতিদের আচার-আচরণ একং বক্তব্যে খুবই খুশি হলেন। রাজা আলেকজান্ডারের কাছে তাদের নিয়ে যাওয়ার সময় চলতি পথে তিনি সেনাপতিদের উদ্দেশে বললেন, সম্মানিত পারস্যবাসী! আমরা আপনাদের রাজ্য, সম্রাট এবং জনগণ সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল। আমার মনে হচ্ছে আমাদের ক্ষুদ্র রাজ্য সম্পর্কে আপনারা তেমনটি অবগত নন। তাই বলছি, আমাদের তরুণ রাজা কেবল একজন রাজাই নন! তিনি দেবতা জিউসের পুত্র বলে সমগ্র ইউরোপের লোকজন বিশ্বাস করে। তার জন্মের বহুকাল আগে ডেলফির মন্দির থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, তিনি মেসিডোনিয়ার রাজ পরিবারে জন্ম নেবেন এবং এক সময় বিশ্ব জয় করবেন। মন্দিরের সব ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে কেবল বিশ্ব বিজয়ের ঘটনাটুকু ছাড়া। আমার মনে হয় সেটিও হয়ে যাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। টার্ডিসের কথা শুনে পারস্য সেনাপতিরা চলতি পথের মাঝখানে থেমে গেলেন এবং হঠাৎ করেই সমস্বরে বলে ফেললেন- আমরা পানি খাব! (চলবে)