বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নরখাদক মানুষের দ্বীপ

রণক ইকরাম

নরখাদক মানুষের দ্বীপ

অবিশ্বাস্য হওয়ার মতোই বিষয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও সভ্য পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন জায়গা রয়েছে। ইরিয়ান জায়া এমনই একটি জায়গা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন এবং বুনো অঞ্চলগুলোর একটি।  ইরিয়ান জায়া ছাড়াও দ্বীপটির আরও অনেক নাম রয়েছে। যেমন- আদিবাসী বুনোদের দ্বীপ, বৃক্ষচারীদের দ্বীপ, নরখাদকের দ্বীপ ইত্যাদি। ওই সময় এই দ্বীপ ও তার আশপাশের এলাকায়  ১২ মাসই জাতিগত সংঘর্ষ লেগে থাকত। সংঘর্ষ ছাড়াও এ দ্বীপে এক সময় উপজাতিরা চুরি বা হত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিপক্ষদের ধরে খেয়ে ফেলত। যারা মানুষের মাংস খেত তারা  বিশ্বাস করত শত্রুকে খেয়ে ফেললে তার শক্তি নিজেদের ভিতরে সঞ্চারিত হয়। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। অদ্ভুতুড়ে এই দ্বীপের গল্পই জানব আজ।

 

এক সময়ের অচেনা, অজানা ইরিয়ানা জায়া এখন বিদেশি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক দ্বীপটি দেখার জন্য ভিড় জমান। পর্যটকদের মধ্যে ইউরোপিয়ানদের সংখ্যাই বেশি। কেউ যাচ্ছে উপজাতিদের জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে, আবার কেউ যাচ্ছে বেলিয়েম ভ্যালিতে বেড়াতে। কারও কারও আকর্ষণ আবার আসমাট কোস্ট্রে নৌকা চালানো। পর্যটকদের জন্য সরবরাহকৃত ব্রশিউরে লেখা থাকে, ‘প্রস্তর যুগের মানুষদের দর্শন করতে আসুন। এরই মধ্যে ওখানকার কেন্দ্রীয় সরকার ইরিয়ান জায়ায় বসবাসের জন্য দুই লাখেরও বেশি লোক পাঠিয়েয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে আদিম মানুষদের এই রহস্যঘেরা এলাকায়। সভ্যতার বিবর্তনে এখানে দ্রুত গড়ে উঠেছে শহর, রাস্তা, স্কুল এবং বিমানবন্দর। প্রায় ৫০ হাজারেও বেশি অভিবাসী নিজ ইচ্ছায় ইরিয়ান জায়ায় আবাস গড়ে তুলেছেন। এখানকার নিম্নভূমির বনাঞ্চলে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের সন্ধানে ঘুরছে। অস্ট্রেলিয়ানরা করোয়াই অঞ্চল চষে বেড়াচ্ছে সোনার সন্ধানে।

 

অবশ্য ইরিয়ান জায়ার উপজাতিদের দেখলে মনে হয় না তারা সভ্যতার ছোঁয়া পাচ্ছে। ইরিয়ান জায়ার উপজাতিদের মধ্যে রয়েছে ইয়ালি, আসমাট, করোয়াই ইত্যাদি উপজাতি। এরা সবাই ন্যাংটা থাকে, সবারই বাস গাছের ডালে বানানো কুঁড়েঘরে। বিশাল সব গাছের মাথায় ঘর বানিয়ে থাকে ইরিয়ান জায়ার বুনো উপজাতিরা। করোয়াই উপজাতির কথাই ধরা যাক, এরা হলো বৃক্ষনিবাসী আরেক উপজাতি কোম্বাইদের প্রতিবেশী।

৬০০ বর্গমাইলের মহাঅরণ্যে কমপক্ষে ৩ হাজার করোয়াইয়ের বাস। এরা ইরিয়ান জায়ার আড়াইশ উপজাতির একটি। কোম্বাইদের সঙ্গে নানা দিক থেকে মিল আছে করোয়াইদের, শুধু ভাষাটা ভিন্ন। এ দুই উপজাতির সংস্কৃতিই এখন বিপন্নের পথে। এরা যে অঞ্চলে বাস করে সেখানে মূল্যবান খনিজ বা দামি গাছ নেই বলেই হয়তো ইন্দোনেশিয়া সরকার এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল দীর্ঘদিন। কোম্বাই এবং করোয়াই উভয় উপজাতি তাদের গাছের চ‚ড়ার বাড়িতে উঠে মই বেয়ে, আগুন জ্বালায় কাঠের সঙ্গে বেতের ফিতা বা দড়ি ঘষে।

এদের খাদ্যের প্রধান উৎস হলো সাগুপামের গাছ। এ গাছের কোমল তন্ত্র বা আঁশ গুঁড়িয়ে মণ্ড বানায়। মণ্ড পানিতে ভিজিয়ে পিঠা তৈরি করে। করোয়াইদের প্রধান একটি উৎসব হয় এই সাগুগাছ নিয়ে। উৎসবের কর্মকাণ্ড শুরু হয় কয়েক মাস আগে থেকেই, উৎসবের দিনক্ষণ ঠিক করা হয় চাঁদ দেখে। প্রথমে এরা জঙ্গলের নির্দিষ্ট একটি অংশ পরিষ্কার করে একটি পবিত্র খুঁটির পাশে একটি লং হাউস তৈরি করে। তারপর সাগুপামের গাছ সাবধানে কেটে ফেলে রাখে পচার জন্য। পচা গাছে গোবরে পোকা ঢোকে, ডিম পাড়ে। মাস দুই পর করোইরা ওই পচা অংশ কেটে নেয় আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য। আমন্ত্রিত অতিথিরা আসার পর নাচ-গান আর গল্পের মধ্যে শুরু হয় ভোজনপর্ব। অনুষ্ঠান চলতে থাকে নানা আয়োজনে। কখনো কখনো সারারাত চলে অনুষ্ঠান। আসমাট নামে ইরিয়ান জায়ার আরেকটি উপজাতি আছে। এরা তাদের ভোজন উৎসব করে গোবরে পোকারা শুককীট দিয়ে। এই আসমাট জাতি এক সময় কেবল যুদ্ধই করে বেড়াত। আর যুদ্ধ করার আগে তারা নানা উৎসবের আয়োজন করত। সেই উৎসবে ওরা শত্রুপক্ষের লোকদের পুড়িয়ে খেত। নরখাদক হিসেবে আসমাটদের কুখ্যাতি রয়েছে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ান সরকার আসমাটদের এসব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়, পুড়িয়ে দেয় উৎসবে ব্যবহƒত সব জিনিসপত্র। এরা ক্যাথলিক মিশনারিদের আর্থিক সাহায্যে এখনো দু-একটি উৎসব করার সুযোগ পায়। তবে যুদ্ধে যাওয়ার অবকাশ তাদের এখন নেই। ইন্দোনেশীয় সরকার অবশ্য চেষ্টা করছে অসভ্য এই উপজাতিগুলোকে সভ্য করে তোলার জন্য। সরকার যে এ ব্যাপারে অনেকটা সফল তো বোঝা যায় ইরিয়ান জায়ার একটি গ্রাম আঙ্গুরুতে গেলে। এখানে অর্থনগুপজাতি মেয়েরা ভোর বেলায় ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাজারে আসে সওদা করতে। তারা মিষ্টি আলু, শিম এবং আখের দরদাম করে, জিনিস কেনে কাগুজে নোট দিয়ে, কড়ি দিয়ে নয়।

 

 

তবে একটা সময় যখন মিশনারিরা প্রথম এ অঞ্চলে আসে তখন ইরিয়ান জায়ার উপজাতিরা ব্যবসায়িক লেনদেন করত কড়ি দিয়েই। এখন পাহাড়ের ধারের লোকজন বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে ইস্পাতের কাঁচি দিয়ে, প্রাগৈতিহাসিক পাথরের কুড়াল ফেলে দিয়েছে তারা। ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসার জন্য (এটি এ দেশের সবচেয়ে বড় হন্তারক রোগ) গির্জার ক্লিনিকেও যায়। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রস্তর যুগের মানুষ বলে কথিত এক সময়ের নরমাংসভোজী এসব উপজাতি ক্রমশ সভ্য হয়ে উঠছে, আধুনিকতার ছোঁয়া তাদের মনে অবশেষে লাগতে শুরু করেছে এবং তারা ১৫০ ফুট উঁচু গেছোবাড়িতে বাস করলেও ইদানীং নগরায়ণের সুযোগ-সুবিধার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। সভ্যতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করলেও আধুনিকতা থেকে পিছিয়ে থাকা এই দ্বীপ আর এখানকার বৃক্ষচারী নরখাদকদের দখলে প্রাচীন মানুষ ও মানবসভ্যতার বিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

 

বিজয়ী উষ্ণভূমি

 

 

অস্থিতিশীল এই দ্বীপের ইতিহাস বহু পুরনো হলেও মানুষের আলোচনায় আসে মূলত ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৬০ সালে ইন্দোনেশিয়া এই দুর্গম দ্বীপটির পশ্চিমাংশ দখল করে নেয়। তখনই দ্বীপের নতুন নামকরণ করা হয় ইরিয়ান জায়া। যার অর্থ ‘বিজয়ী উষ্ণভূমি।’

ইন্দোনেশিয়া কর্তৃক দখলের আগে দ্বীপটি ওলন্দাজদের দখলে ছিল। অঞ্চলটি সুকর্ণ এবং সুহার্তোর আমলে ইরিয়ান জায়া এবং ২০০০ সাল থেকে পাপুয়া নামে পরিচিত হয়। ইরিয়ান জায়াকে ইন্দোনেশিয়ার অংশে পরিণত করার ব্যাপারে ইন্দোনেশিয়া ও ওলন্দাজদের মধ্যে কয়েকবারের আলোচনা ব্যর্থ হয়। ফলে রক্তপাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৬১ সালে ইন্দোনেশীয় ও ওলন্দাজ সেনারা সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।

 

 

১৯৬২ সালের আগস্টে দুই পক্ষ একটি চুক্তিতে আসে এবং ১৯৬৩ সালের ১ মে থেকে ইন্দোনেশিয়া ইরিয়ান জায়ার প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করে। মূলত এরপর থেকেই দ্বীপটিতে মোটামুটি শান্তি ফিরে আসে। ১৯৬৯ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ইন্দোনেশিয়া একটি ভোটের আয়োজন করে যাতে পাপুয়ার স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর প্রতিনিধিরা ইন্দোনেশিয়ার অংশ হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। এরপর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে অঞ্চলটি ইন্দোনেশিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে পাপুয়াতে ইন্দোনেশিয়ার প্রশাসনবিরোধী ছোট আকারের গেরিলা কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে পাপুয়াতে স্বাধীনতার দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়েই তার অদ্ভুত সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যময় বসতির জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এই দ্বীপটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর