শিরোনাম
রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
মাও সে তুং

বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক

বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক

মাও সে তুং। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা, গেরিলা সংগঠক, চীনা বিপ্লবী, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও এক অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা। ইতিহাসের চাকা বারবার বদলে দিয়েছেন চৈনিক এই মানুষটি। তিনি শ্রমিকের বদলে কৃষককে চিহ্নিত করেছেন বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে, গড়ে তুলেছেন সশস্ত্র রেড আর্মি, প্রচলন করেছেন আরণ্যক গেরিলা যুদ্ধের। বিশ্বময় তরুণরা আজও হাঁটছে তার দেখানো পথে। তাকে নিয়েই আজকের রকমারি। লিখেছেন—নাহিদুর রহমান হিমেল

 

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন

কর্মের মাধ্যমেই একটি মানুষের জন্মের সার্থকতা বা ব্যর্থতার পরিচয়। কিছু কিছু জন্ম সার্থক হয়ে গড়ে ওঠে সত্তা হিসেবে, যা তার মৃত্যুকেও ছাপিয়ে তার ব্যাপ্তিকে পৌঁছে দেয় এক নতুন উচ্চতায়। এমনই এক সত্তা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং। মার্কসবাদ-লেনিনবাদে তার তাত্ত্বিক অবদান। সমর কৌশল এবং তার কমিউনিজমের নীতি এখন একত্রে মাওবাদ নামে পরিচিত। মাও ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে ২৪ বছর বয়সে রাজধানী পিকিংয়ে গমন এবং মার্কস তত্ত্বের আলোকে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও নিজ প্রচেষ্টায় তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যানের শীর্ষ পদে পৌঁছতে পেরেছিলেন এবং সফলভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন।

১৯১১ সালে চীনের কিঙ রাজতন্ত্রের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হয় জাতীয়তাবাদীদের তীব্র গণআন্দোলন। সেই আন্দোলনের অন্যতম নেতা সান ইয়াত সেনের সঙ্গে যোগ দেন মাও সে তুং। আন্দোলনে জয়ের পর গঠিত হয় কউমিঙটাঙ (জাতীয়তাবাদী) দল। ১৯১৮ সালে মাও সে তুং চীনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সে সময় বামপন্থি এক বুদ্ধিজীবীর চিন্তাধারায় মাও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এছাড়া কাজের অবসরে তিনি পাঠ করতে শুরু করেন সভ্যতার বিস্ময়কর এক তত্ত্ব মাকর্সবাদ। তখনই বুঝতে পারলেন মায়ের ‘বুদ্ধবাদ’ ও বাবার ‘কনফুসিয়বাদ’ কোনো কাজের জিনিস না।

তরুণ বয়স থেকেই মাও বামপন্থি রাজনৈতিক ধ্যানধারণার প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯১৯ সালে চীনকে আধুনিকায়ন করার লক্ষে চীনের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে একটি আন্দোলন চলছিল। সে আন্দোলনে মাও সে তুং-ও যোগ দিয়েছিলেন তার লেখনীর মাধ্যমে। ১৯২০ সালের দিকে তিনি একজন মার্কসবাদী হিসেবে চীনা রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন। ওই বছরেই চীনের চাংশায় ফিরে যান মাও। হুনান প্রদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য মাও উদ্যোগী হলেও তা ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর ১৯২১ সালে সাংহাই যান তিনি। সে সময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হচ্ছিল ওখানে। সেই গোপন মিটিংয়ে উপস্থিত হন মাও। তারপর হুনান প্রদেশে ফিরে এসে কমিউনিস্ট পার্টির একটি আঞ্চলিক শাখা খোলেন তিনি। এই শাখায় কীভাবে ধর্মঘট করতে হয়— শ্রমিকদের তাই শেখান মাও। ১৯২৩ সালে কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদী কউমিঙটাঙ দলের সঙ্গে জোট গঠন করে। এসময় মাও কউমিঙটাঙ দলে যোগ দিয়ে সেখানকার সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হন। ১৯২৫ সালে জন্মগ্রাম শাওশানে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন মাও। ১৯২৭ সালের দিকে কৃষক আন্দোলন নিয়ে তার লেখনীতে তিনি কৃষকদের বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।

ওই বছরই জাতীয়তাবাদী কউমিঙটাঙ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তার। কউমিঙটাঙ দলের নেতা চিয়াং কাই সেক কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ায় প্রবল কমিউনিস্টবিরোধী দমননীতি অনুসরণ করেন। এদিকে হুনান প্রদেশের কৃষকদের নিয়ে সৈন্যবাহিনী গঠন করেন মাও। এই বাহিনী নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নিলেও পরাজিত হন তিনি। এরপর চীনের দক্ষিণের পার্বত্য এলাকা জিয়াংজি প্রদেশে চলে যান মাও। এ সময়ে অসংখ্য তরুণ দলে দলে মাও নিয়ন্ত্রিত কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে শুরু করে। মাও সে তুং তাদের সশস্ত্র সংগঠিত করেন। ইতিহাসে এই সশস্ত্র দলটি রেড আর্মি নামে পরিচিতি পায়। এদের লক্ষ ছিল কৃষকের মুক্তি। আর সে লক্ষ অর্জনে অভিনব গেরিলা যুদ্ধের পথ অনুসরণ করে এ দল। ১৯৩৪ সালে চিয়াং কাই শেক চীনের জিয়াংজি প্রদেশ ঘিরে ফেলে। তবে বিস্ময়কর ও অপ্রতিরোধ্য গতিবেগে সে বেড়াজাল ছিন্ন করে রেড আর্মিকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন মাও সে তুং।

এর পর তিনি শুরু করেন এক দীর্ঘ পদযাত্রা। যা ইতিহাসে লং মার্চ হিসেবে পরিচিত। চীনের উত্তরের ইয়ানান প্রদেশের উদ্দেশ্যে রেড আর্মির সঙ্গে ছয় হাজার মাইল দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে শুরু হয় এই পদযাত্রা।

১৯৩৭ সালে চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হলে পরস্পরবিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই শেকের ন্যাশনাল পার্টি এবং মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি একত্রিত হয়ে আগ্রাসী জাপানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে ১৯৪৫ সালে জাপান পরাজিত হয়। তারপর শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এ গৃহযুদ্ধে জয়ী কমিউনিস্ট পার্টি মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীনের বিশাল ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর বিজয়ী কমিউনিস্ট মুক্তিফৌজের অগ্রগামী অংশ ক্যান্টনে প্রবেশ করলে চিয়াং কাই শেক সদলবলে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে ফরমোজা দ্বীপে আশ্রয় নেন। স্বৈরশাসক কাই শেককে পরাস্ত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন মাও। ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মাও স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তিনি এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ পদে বহাল থাকেন।

মাও সেতুংয়ের সবচেয়ে বড় অবদান তিনি চীনে শিল্প ও কৃষিতে বিপ্লব সাধন করেন এবং সমাজতান্ত্রিক গণচীনের ভিত্তি সুদৃঢ় করার জন্য প্রথম সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত করেন। বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ ভাগে এসে মাও সেতুং বেশ দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। জীবনের শেষ ছয় মাস তাকে খুব একটা প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এই অবিসংবাদিত মহান নেতা ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তাকে বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কয়ারে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে তার সমাধিকে কেন্দ্র  করে গড়ে ওঠে ‘মাও সে তুং স্মৃতিসৌধ’।

 

সোনায় মোড়ানো মাও

চীনে মাও সে তুংয়ের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। বিপ্লবী এই নেতার মৃত্যুর ৪০ বছর পার হলেও চীনের অধিকাংশ মুদ্রা ও ব্যাংক নোটে তার স্থান রয়েছে। এছাড়া চীন জুড়ে রয়েছে তার বিভিন্ন মাপের মূর্তি। সেসব মূর্তির মধ্যে একটি রয়েছে সোনায় মোড়ানো।

দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং প্রদেশের শেনঝেনে আপাদমস্তক সোনায় মোড়ানো এই মূর্তিটির মূল্য ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। মূর্তিটি ৮০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৫০ কেজির বেশি ওজন। ২০ জন কারিগরের একটি দল এই মূর্তিটি তৈরি করতে আট মাস সময় নিয়েছে। মূর্তিটিতে মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া এর ওপর সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।

 

৩২ মিটার উঁচু মূর্তি

চীনের হুনান প্রদেশ চাংসা শহরে জিয়াংজিয়াং নদীর জুজি উপত্যকায় মাও সেতুংয়ের ৩২ মিটার উঁচু এক মূর্তি রয়েছে। মূর্তিটিতে ১৯২৫ সালের ৩২ বছর বয়সের তরুণ মাওকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মূর্তিটি লম্বায় প্রায় ৮৩ মিটার এবং চওড়ায় ৪১ মিটার। মূর্তিটি তৈরিতে লাল গ্রানাইট মোজাইক আট হাজারের বেশি পাথরের টুকরা ব্যবহার করা হয়েছে। এর ওজন প্রায় দুই হাজার টন। ২০০৯ সালে নির্মিত এ মূর্তিটিতে খরচ হয় ৩৫ মিলিয়ন ডলার।

 

মাওবাদ

‘মাওবাদ’ পূর্ব চীনের রাজনৈতিক নেতা মাও সেতুংয়ের চিন্তাধারা নামে পরিচিত ছিল। মূলত মাও সেতুংয়ের শিক্ষাসমূহ থেকে পাওয়া রাজনৈতিক মতবাদই হলো মাওবাদ। মাওবাদকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিশ্ব-ভাণ্ডারে মাও সেতুংয়ের নতুন অবদানসমূহ হিসেবেও উল্লেখ করা যেতে পারে। এর অনুসারীরা মাওবাদী নামে পরিচিত। মাওবাদীরা এটিকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সংশোধনবাদ-বিরোধী রূপ হিসেবে বিবেচনা করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মাওবাদ বিকশিত হয়। ধীরে ধীরে এটি বিস্তৃতভাবে রাজনৈতিক ও সামরিক চালনামূলক আদর্শ হিসেবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বাস্তবায়ন করে।

 

নয়া গণতন্ত্র

মাও সেতুং ১৯১৭ সালের রাশিয়ার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ও অক্টোবর বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় সংশ্লেষিত করে এক নতুন তত্ত্ব তৈরির চেষ্টা করেন। মূলত সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ দ্বারা নিপীড়িত দেশে বিশেষ করে উপনিবেশিক বা নয়া-উপনিবেশিক এবং পুঁজিবাদী দেশে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নতুন তত্ত্ব নির্মাণ করেন তিনি। এই তত্ত্ব হলো শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে কয়েকটি বিপ্লবী শ্রেণির যৌথ একনায়কত্বাধীন প্রজাতন্ত্র যা বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশ।

 

সাংস্কৃতিক বিপ্লব

মহান শ্রমিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব যা চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব নামে বৈশ্বিক অঙ্গনে পরিচিত। মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে বৃহত্রূপে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে এ বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৯৬৬ থেকে ৭৬ সময়কালে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে এটি হয়েছিল। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মাও সে তুংয়ের প্রস্তাবে পুঁজিবাদী ও প্রাচীনকালের ধ্যান-ধারণা থেকে দূরে রাখতে এবং প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা সংরক্ষণের লক্ষ্যেই এ বিপ্লবের সূচনা ঘটে। এছাড়াও মাওবাদ দলে প্রভাব বিস্তারের জন্য এর সূত্রপাত হয়। এ বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া, প্রাচীন পুঁজিবাদী ও সামন্তীয় সংস্কৃতির বিলোপ সাধন করে সমগ্র সমাজে জ্ঞানভিত্তিক বুদ্ধি বৃত্তির জাগরণ সৃষ্টি করা। ১৯৬৬ সালের মে মাসে ধীরে ধীরে শুরু হওয়া এ বিপ্লবটি ১৯৬৯ সালে শেষ হয়।

 

লং মার্চ

জাপানি আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং দেশের অভ্যন্তরে সামরিক শক্তিগুলোর অপ্রয়োজনীয় সংঘাত এড়ানোর জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন লাল ফৌজ প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে যা ইতিহাসে লং মার্চ নামে পরিচিত। ১৬ অক্টোবর ১৯৩৪ থেকে শুরু হয়ে ২২ অক্টোবর ১৯৩৫ পর্যন্ত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির লাল ফৌজের এই লংমার্চ কর্মসূচি সারাবিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রকৃতপক্ষে এই লং মার্চ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল পশ্চাদপসরণের কৌশল হিসেবে। এর মধ্য দিয়েই উদ্ভাবিত হয়েছিল নতুন এক পদ্ধতি। চিয়াং কাই শেক এর বিশাল সেনাবাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে পরাজিত বিপর্যস্ত হয়ে পার্টি বাহিনী যখন পশ্চাদপসরণ করছে, তার এক পর্যায়ে চীনের পশ্চিম ও উত্তর দিকে এই পশ্চাদপসরণকে নতুন অঞ্চল আবিষ্কার, নতুন জনপদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, নতুন নতুন স্থানে মুক্তাঞ্চল বা সোভিয়েত গঠনের কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। মাও সে তুং, চু তে এবং চৌ এন লাইয়ের নেতৃত্বে ৩৭০ দিনে লং মার্চ অতিক্রম করে ৬ হাজার মাইলেরও বেশি। কয়েকটি ভাগে এ যাত্রা অব্যাহত থাকে।

 

মাওকে ভূপাতিত করল চীন

মাও সে তুংয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসা থেকেই চীনের হেনান প্রদেশের টংজু গ্রামে নির্মিত হয়েছিল সর্ববৃহৎ এক মূর্তি। তবে সেই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধের প্রতিফলন ঘটাতে দেয়নি চীনা সরকার। স্টিল, কংক্রিট আর সোনালি রঙের প্রলেপ দিয়ে নির্মিত প্রায় ১২১ ফুট (৩৬.৬ মিটার) উঁচু এই মূর্তিটি ভেঙে ফেলেছে চীনা সরকার। গণমাধ্যমে ছবিসহ এই মূর্তির খবর ছড়িয়ে পড়লে সরকারের অনুমোদন না নেয়ার কারণ দেখিয়ে এটি ভাঙার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ।

মাও সে তুংয়ের বসে থাকার ভঙ্গিতে মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়েছিল ঐ  গ্রামের আবাদি জমির পাশে একটি খালি মাঠে। দেশটির এক কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং ব্যবসায়ীর অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল মূর্তিটি। প্রায় তিন মিলিয়ন ইউয়ান ব্যয়ে মূর্তিটি নির্মাণে গ্রামবাসীও কিছু অর্থ সহযোগিতা করেছিলেন।

চীনের হেনান প্রদেশ অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় অতি দরিদ্র। ৪৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই প্রদেশ গত কয়েক বছর ধরে প্রচ্ছন্ন দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত। কিন্তু তারপরেও গত বছরের মার্চ থেকে মাও সে তুংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তারা তৈরি করতে শুরু করে ওই মূর্তি। এ বছরের ৪ জানুয়ারি এ মূর্তি তৈরির কাজ শেষ হলে হেনানভিত্তিক গণমাধ্যমে এই শিল্পকর্মের ছবি প্রকাশ হয়। এতে হইচই পড়ে যায় গোটা চীনে। পরে ওই মাসেই চীনা সরকারের নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয় মূর্তিটি। অধিকাংশেরই মতে, একটি দরিদ্র প্রদেশের পক্ষে এই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা উচিত হয়নি। ১৯৫০ সালে মাওয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে সেখানে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। যার ফলশ্রুতিতে সেখানে মারা যায় কয়েক মিলিয়ন মানুষ।

 

একনজরে মাও

জন্ম : ২৬ ডিসেম্বর ১৮৯৩

জন্মস্থান : হুনান প্রদেশ, শাওশান গ্রাম

মৃত্যু : ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ (৮২ বছর)

মৃত্যু স্থান : বেইজিং

রাজনৈতিক দল : চীনের কমিউনিস্ট পার্টি

পেশা : বিপ্লবী, রাষ্ট্রনায়ক

ধর্ম : নেই (নাস্তিকতাবাদী)

স্ত্রী : ৪ জন

সন্তান : ১০ জন

প্রবক্তা : মাওবাদ ও লং মার্চ

 

যে গ্রামে দীপ্যমান মাও সে তুং

মাও সে তুং-কে বলা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠাতা। দেশে সমাজতন্ত্রের সাম্য প্রতিষ্ঠায় তার অবদান চিরস্মরণীয়। এ কারণেই ৪০ বছর আগে মারা গেলেও এখনো তিনি দেশের অগণিত মানুষের মনে জাজ্বল্যমান। এর উজ্জ্বল উদাহরণ চীনের হেনান প্রদেশের নানজিকুন গ্রাম। ওই গ্রামে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরোটা সময় দীপ্যমান থাকেন মাও সে তুং।

রোদ-বৃষ্টি যাই থাকুক না কেন, প্রতিদিন সকাল সোয়া ৬টায় চীনের সাবেক এ নেতার স্তবগান বাজে এ গ্রামে। সবার কাছে মাওয়ের গুণগান পৌঁছাতে রাস্তার প্রতিটি বাতির খুঁটিতে ও মোড়ে মোড়ে লাগানো হয়েছে লাউড স্পিকার। এসব স্পিকারেই বাজে অবিসংবাদিত এ নেতার গুণগান। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরি শাসকেরা রাষ্ট্রের মালিকানাধীনে নেওয়া এখানকার জমি গত শতকের আশির দশকে কৃষকদের কাছে ফিরিয়ে দেন। তবে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতেই কৃষকরা জমিগুলো গ্রাম কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিজেদের অংশীদারিত্ব বজায় রাখেন। তারা যৌথভাবে এসব জমির মালিক। এসব জমিতে তারা আবাদ করেন, আবার প্রয়োজনে এসব জমিতেই অন্যদের কারখানা স্থাপন করতে দিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। সবাই মিলে যৌথভাবে জীবনমানের উন্নয়ন করেন। ফলে একদিকে যেমন উপকৃত হচ্ছে গ্রামবাসী অন্যদিকে দ্বন্দ্ব-দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পাচ্ছে কৃষকরা। সমষ্টিগতভাবে এ গ্রামের সবারই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এক সময়ের বস্তি ঘরগুলোর জায়গায় তৈরি হয়েছে আধুনিক ভবন। গ্রামের বিরাট প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে মাও সে তুং, লেনিন ও স্ট্যালিনের বড় ভাস্কর্য। চারদিকে ঝুলছে লাল ব্যানার। কৃষক ও গ্রামবাসীর এমন একতাবদ্ধ দেখে অন্য অঞ্চলের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তির এখানে বিনিয়োগ করেছেন। গড়ে উঠেছে নুডলস, বিয়ার আর ওষুধ তৈরির কারখানা। স্থানীয় লোকজনের খবরের তৃষ্ণা মেটাতে এ গ্রামে আছে একটি পত্রিকা অফিস। বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি বেতারকেন্দ্র, সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে মাও সে তুং-এর গান প্রচার হয়। সেই সঙ্গে প্রচারিত হয় তাকে নিয়ে নানা আলোচনা অনুষ্ঠান। টেলিভিশন স্টেশনটি জনপ্রিয় অনেক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো নানজিকুনে ব্যক্তিগত গাড়ি নেই বললেই চলে। আছে কিছু বিদ্যুত্চালিত স্কুটার আর তিন চাকার গাড়ি। কৃষিনির্ভর হলেও উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে নেই এ গ্রাম। এখানকার মানুষের মূল বেতন খুবই কম, মাসে মাত্র ৩২-৩৫ ডলারের মতো আয় করেন তারা। তবে সামাজিকভাবে দলবদ্ধ এসব মানুষ বিনা ভাড়ায় ভবনগুলোতে থাকেন। খাদ্যপণ্য, শিক্ষাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিনামূল্যে পাওয়া যায় এখানে। সমাজতন্ত্রের মূল চেতনা ধারণ করে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপনে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন নানজিকুনের বাসিন্দারা। মাও সে তুং-এর চিন্তাধারাকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে এ গ্রামের বাসিন্দারা।

 

আধুনিক চীনের স্থপতি

১৯৪৯ সালে মাও যখন ক্ষমতায় আসেন তখন চীনের পরিচিতি ছিল একটি অনুন্নত ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হিসেবে। সেসময় যুদ্ধবিগ্রহে ক্ষতবিক্ষত এবং ভগ্নপ্রায় পুঁজিবাদী চীনকে সমাজতন্ত্রের আদর্শে গড়তে মাও উদ্যোগী হন। চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব সংগঠিত করার পাশাপাশি সামাজিক বিপ্লব ঘটানোরও চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে মাও ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামের কর্মসূচি চালু করেন। কিন্তু তার এই কর্মসূচি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। ১৯৬৬ সালে অনেক কমিউনিস্ট নেতাকর্মীর বিরোধিতা সত্ত্বেও ‘কালচারাল রেভ্যুলুশন’ শুরু করেছিলেন। এর ফলে পার্টিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মাওয়ের একগুঁয়েমির কারণে গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড ও কালচারাল রেভ্যুলুশনে প্রায় এক কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। সেই সঙ্গে সমগ্র চীনে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ব্যাপক ধস নেমেছিল অর্থনীতিতে। মাও প্রথম জীবনে বিশ্বাস করতেন যে, শহরের শিল্পকারখানার শ্রমিকরাই পার্টির বড় শক্তি। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শিল্পকারখানার শ্রমিকরা নয়, গ্রামাঞ্চলের কৃষকেরাই পার্টির প্রাণ। তাই কৃষিজীবীদের প্রাধান্য দিয়ে তিনি পার্টির শাসনব্যবস্থার নীতিনির্ধারণ করেছিলেন। মাওয়ের রাষ্ট্রনীতি চীনকে আমূল বদলে দিয়েছিল। তার যোগ্য নেতৃত্বের ফলেই সামন্তবাদী সমাজ থেকে চীন অতি অল্প সময়ে আধুনিক সমাজে পরিণত হয়। জীবদ্দশায় নিজের প্রণীত রাজনৈতিক দর্শন ও বিপ্লবীতত্ত্বের জন্য মাও সে তুং যেমন পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামী প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন, তেমনি নানা মহলের তীব্র সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছিলেন। 

 

চিঠির মূল্য ৯ লাখ ডলার!

চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে তুং-এর একটি চিঠি লন্ডনের একটি নিলামে ৯ লাখ ১৮ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছে। ১৯৩৭ সালে চীনা এই নেতা ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও লেবার পার্টির নেতা ক্লেমেন্ট অ্যাটলিকে চিঠিটি লিখেছিলেন। এ চিঠির মাধ্যমে মাও সে তুং চীনে জাপানি বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকাতে ব্রিটেনের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। চিঠিটি কিনেছেন চীনা একজন ব্যক্তিগত সংগ্রহকারী।

নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সদিবে’স জানায়, ঐতিহাসিক এই চিঠিতে মাও সে তুংয়ের একটি বিরল সই রয়েছে। সদিবে’স ধারণা করেছিল, চিঠির দাম এক লাখ থেকে দেড় লাখ পাউন্ডে বিক্রি হবে।

ইংরেজিতে টাইপ করা এ চিঠিতে মাও তৎকালীন বিরোধী নেতা ক্লেমেন্ট অ্যাটলিকে লিখেন, ‘আমরা বিশ্বাস  করি ব্রিটিশ জনগণ যখন সত্যটা জানবে যে কীভাবে জাপানিরা চীনে আগ্রাসন চালাচ্ছে।  তারা চীনা জনগণকে সমর্থন করবে, তাদের পক্ষ থেকে সহযোগিতা আসবে এবং ব্রিটিশ জনগণ নিশ্চয়ই তাদের সরকারকে এমন নীতি গ্রহণে চাপ দেবে যাতে এই বিপদের মোকাবিলা করা যায়, কারণ এই বিপদ আমাদের মতো তাদের উপরও আসতে পারে।’

চিঠিটি চীনের উত্তর-পশ্চিমের শহর ইয়ায়ান থেকে লেখা হয়েছিল, যেখানে জাপানি আক্রমণের সময় কমিউনিস্টরা সদর দফতর স্থাপন করেন।

সদিবে’স জানায়, চিঠি লেখার সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ক্লেমেন্ট অ্যাটলি তখন তার দীর্ঘ শান্তিবাদী অবস্থান থেকে সরে এসে লেবার পার্টির নেতৃত্বে চলে আসেন। সেসময় তিনি নািস জার্মানি ও দেশটির সহযোগীদের প্রতি কনজার্ভেটিভ সরকারের ইতিবাচক অবস্থানের সমালোচনাকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। মাও মাও সে তুং-এর  লেখা চিঠিটি জেমস বারট্রাম নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের মাধ্যমে ক্লেমেন্ট অ্যাটলিকে পাঠানো হয়েছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর