বুধবার, ১৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
আজ কলমজাদুকর হুমায়ূন আহমেদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী

ক্ষণস্থায়ী এক মহাজীবন

রণক ইকরাম

ক্ষণস্থায়ী এক মহাজীবন

তাহার জবানবন্দি

২৫ মে ২০১২। নুহাশ পল্লী। তখন ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সে সময় তার সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের। জীবনের নানা গল্প তিনি শুনিয়েছিলেন। পূর্বে প্রকাশিত এই প্রতিবেদকের নেওয়া সাক্ষাৎকারের কয়েক ঝলক...

 

জাদুকরের যাপিত জীবন

ক্ষণজন্মা কথাসাহিত্যক হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ছেড়ে গেছেন পাঁচ বছর হয়ে গেল। সময়টা ২০১২ সালের ১৯ জুলাই। চারদিকে হাহাকার ধ্বনি দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের এই অমর কিংবদন্তি চিরনিদ্রায় শায়িত হন নুহাশ পল্লীতে। ইতি ঘটে এক মহাজীবনের। যার শুরুটা ছিল নেত্রকোনা জেলার কুতুবপুরে। কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদের ডাক নাম কাজল। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান ও মা আয়েশা ফয়েজ। বাবার কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেন বিধায় শৈশবে তিনি দেশের নানা স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। শৈশবে তিনি যত জায়গায় গিয়েছেন তার মাঝে তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল দিনাজপুরের জগদ্দল। কারণ তারা যেখানে থাকতেন তার আশপাশে কোনো স্কুল ছিল না। স্কুলের কথা মনে হলেই যার মুখ তেতো হয়ে যেত সেই তারই এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর দেখা গেল তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয়। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষাতেও তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ১৯৭২ সালে রসায়ন বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর পাস করে তিনি একই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রফেসর যোসেফ এডওয়ার্ড গ্লাসের তত্ত্বাবধানে পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশের লেখালেখির ভুবনে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ ১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরক’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। তরুণ হুুমায়ূন আহমেদ এর মাঝে অমিত সম্ভাবনা তখনই টের পেয়েছিলেন প্রখ্যাত লেখক সমালোচক আহমদ শরীফ। এক গদ্যের মাধ্যমে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে অভিনন্দিত করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ তার জাদুকরি লেখনিতে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। উপন্যাসের ক্যানভাসে মধ্যবিত্ত জীবন রচনার পাশপাশি অসাধরণ সব সায়েন্স ফিকশন, ছোটগল্প, কবিতা, গান, নাটক লিখেছেন তিনি। প্রায় তিন শতাধিক বই প্রকাশ পেয়েছে এই কালজয়ী লেখকের। তৈরি করেছেন হিমু ও মিসির আলির মতো জনপ্রিয় সব চরিত্র। তার লেখা প্রায় তিন শতাধিক বইসমূহের মধ্যে হিমু সংক্রান্ত বই রয়েছে ২৯টি, মিসির আলি সংক্রান্ত বই রয়েছে ২২টি এবং আত্মজীবনীমূলক বই রয়েছে ১৯টি। তার রচিত উল্লেখযোগ্য বইসমূহের মধ্যে রয়েছে মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, এপিটাফ, কে কথা কয়, মেঘ বলেছে যাব যাব, অপেক্ষা ইত্যাদি। তার কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে লেখালেখি, নাটক নির্মাণ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। তার তৈরি চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে শ্রাবণ মেঘের দিন, আগুনের পরশমণি, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তাদের তিন মেয়ে এবং এক ছেলে জন্মগ্রহণ করে। তিন মেয়ে হলেন বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী হলেন অভিনেত্রী ও পরিচালক মেহের আফরোজ শাওন। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তাদের দুই ছেলে। প্রথম ছেলের নাম নিষাদ হুমায়ূূন ও দ্বিতীয় ছেলের নাম নিনিত হুমায়ূন।

 

আমার অতৃপ্তি নেই। মেবি আমি ক্রিয়েটিভ লোক না...

নিজের ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার পরও তিনি নিজেকে সাধারণ ভাবতেন। এত লিখেও কখনো ক্লান্ত হননি। নিজের কর্মে আনন্দ খুঁজে পেতেন। পেয়েছেন তৃপ্তিও। তার ভাষায়—

জনপ্রিয়তা বা লেখালেখি নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। আমি খুশি যে, আমি লিখতে পারছি। এতেও খুশি যে, কারও কারও কাছে সেটি ভালো লাগছে। সাধারণ মানুষ হয়তো লেখার চেষ্টা করেনি বা করলেও আমার মতো উপভোগ করতে পারেনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি অনেক বড় কিছু আর আরেকজন ‘সাধারণ’। উই অল আর হিউম্যান বিং। আমাদের সবার মধ্যেই চিন্তাশক্তি, ক্রিয়েটিভিটি, আনন্দ-বেদনা অনুভূতি আছে। আমি সেসব মানুষের তুলনায় মোটেও আলাদা নই। কখনো সেটা দাবিও করি না। আর লেখালেখির কাজটি আমার কাছে কখনই ক্লান্তিকর মনে হয়নি। আমার কাছে এটি খুবই আনন্দময় কাজ। আর সেই আনন্দ থেকেই লিখে যাচ্ছি।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে তৃপ্তির ব্যাপারটা। ওই যে বললাম আমার আনন্দ। আসলে দুই ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ যারা কোনো কিছুতেই তৃপ্ত নয়। কিন্তু আমি খুব অল্পতেই তৃপ্ত। অতৃপ্তি ব্যাপারটা আমার মধ্যে নেই। আর যখন যে কাজটা করি সেটাতেই আমি সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত হই। আমি যে ছবিটা বানালাম আমার কাছে মনে হয় এটাই আমার সেরা কাজ। সেরা বইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটা নতুন কাজ আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়। আমার অতৃপ্তি নেই। মেবি আমি ক্রিয়েটিভ লোক না। কারণ শুনেছি ক্রিয়েটিভ লোকদের তৃপ্তি থাকতে হয় না, অতৃপ্তি থাকতে হয়।

 

জীবন অনেক, অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার

পথ চলতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এতটা পথ পেরিয়ে এসে, জীবনের শেষ উপলব্ধি মানে রিয়েলাইজেশনটা...

শেষ রিয়েলাইজেশন হচ্ছে ‘জীবন অনেক, অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার’। তারা শঙ্করের কবির মতন মাঝে-মধ্যে আমার বলার ইচ্ছা করে, জীবন এত ছোট ক্যানে? ওই যে একটু আগে বললাম, একটা কচ্ছপ কেন সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে, মানুষ কেন বাঁচে না। জীবনটা আমার খুব ছোট মনে হয়। তোমাদের মনে হয় না? নাকি এখনো টের পাও নাই? টের পাইবা...

 

আমি আসলে আনন্দের জন্য বাঁচি

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন শিক্ষক, নাট্যকার, নির্মাতা, গীতিকার। ছবিও এঁকেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি নিজেকে কী হিসেবে দেখতে ভালোবাসেন। তিনি বলেছিলেন তার এত পরিচয় ভালো লাগে না। তার  ভাষায়—

আমি একজন লেখক। নিজেকে আমি ‘ফিকশন রাইটার’ বলতেই পছন্দ করি। ফিল্মমেকিং অন্যরকম একটা বিষয়। নিজেকে কখনোই ফিল্মমেকার বলি না। ছোটবেলা থেকে ছবি দেখার ব্যাপারে খুব আগ্রহ ছিল। লেখালেখি, ছবি দেখা পুরোটাই পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। কোনো বাবা এমন রসিক আর সংস্কৃতিমনা হতে পারেন— সেটা আমার বাবাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। তো যা বলছিলাম, ছোটবেলা থেকেই ছবি দেখতাম। বড় হওয়ার পর মনে হতো এত সুন্দর ছবি দেখি অথচ আমাদের এখানে ভালো ছবি বানানো হচ্ছে না। আরেকটা আক্ষেপ ছিল। সেটি হচ্ছে— আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির অভাব। নিজে মুক্তিযুদ্ধ না করলেও পতাকার জন্য বাবাকে হারিয়েছি। তাই একটা দায়বোধ ছিল।  ভাবতাম এতবড় একটা মুক্তিযুদ্ধ হলো অথচ সেটা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো ছবি নেই। এই আফসোস থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা ছবি বানালাম ‘আগুনের পরশমণি’। এই ছবিটি নির্মাণ করতে সব খরচ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তারপর থেকে চালিয়ে যাচ্ছি ছবি বানানো। এর বাইরে যখন যেটা ইচ্ছা করে সেটাই করার চেষ্টা করি। আমি আসলে আনন্দের জন্য বাঁচি।

আর আমাকে কলম জাদুকর বললে বাড়িয়ে বলা হবে। বাংলা সাহিত্যে অনেক বড় বড় জাদুকর তৈরি হয়েছে। আমাকে বাংলা সাহিত্যের একজন দীন সেবক বলা যেতে পারে। সেবা করে যাচ্ছি। সেবা করার যে সুযোগটা পেয়েছি এতেই আমি খুশি। লোকজন আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ছে, এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। আর কতটুকু দিতে পেরেছি না পেরেছি সেটি ভাববে সমালোচকরা, সমাজবিদরা। আমার কাজ হচ্ছে, শুধু লেখালেখি করা।

 

লেখকরা সাধারণত অহংকারী হয়

নতুন যারা লিখছে তাদের প্রসঙ্গে..

একটা মানুষ এক জীবনে ১০ হাজারের বেশি বই পড়তে পারে না। পৃথিবীতে ১০ হাজারের অনেক বেশি বই আছে। তাই আমি চেষ্টা করি সব সময় বেস্ট ক্লাসিক্যাল বই পড়তে। নতুনদের বই পড়ে সময়টা নষ্ট করতে চাই না। তবে যারা আমাকে বই উপহার হিসেবে দেয়, আমি দায়িত্ব নিয়ে সেগুলো পড়ি। কিন্তু লেখকরা সাধারণত অহংকারী হয়। তারা নিজের বই দিতে চায় না। ‘আপনার কেমন লাগল স্যার জানাবেন’— এটা বলে না। অহংকারের কারণে। আমি যখন শুরু করেছি, আমিও তাই করেছি।

 

 

এ আলো কখনো  নেভার নয়

১৯ জুলাই ২০১২। অন্য ৮-১০টি দিনের মতোই  সাধারণ একটি দিন ছিল। আচমকা সংবাদ এলো গৃহত্যাগী জ্যোত্স্না আজন্ম অভিমানে ছেড়েছেন চেনা আঙিনা। পাড়ি জমিয়েছেন অচেনা দিগন্তে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ। আকাশে তখন সীমাহীন শূন্যতা। চারদিকে হাহাকার ধ্বনি। নীল নীল বেদনার ধূলি জমে নিশ্চুপ ক্লান্তিহীন। নিন্দুকের মুখেও তখন অতৃপ্তির আহ্লাদ। বর্ণচোরা অনুভূতির আবাদে বাইয়ের পাতা থেকে একে একে বেরিয়ে আসে কল্পনার চরিত্ররা। খণ্ড খণ্ড নীলের প্রবেধ ডিঙিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে কোত্থেক যেন এগিয়ে আসে হিমু। আবেগ তাকে ছোঁয় না কখনোই। সব আবেগের ঊর্ধ্বে সে। মনের আনন্দে যখন যেটা ইচ্ছা করে, সেটাই করে বেড়ায়। নিয়ম-অনিয়মের ধার ধারে না। নিজের মতো নিজের পৃথিবী সাজানোই তার কাজ। এরপরও সেদিন ঔদাসীন্য গ্রাস করেছিল হিমুকে। নেমে পড়েছিল রাস্তায়। তবে গৃহত্যাগী জ্যোত্স্নার শবযাত্রায় শামিল হতে পথে নামেনি সে। তবে কেন নেমেছে? তখন উত্তরের যুক্তি খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেছিলেন মিসির আলি। কোনো কিছুই তাকে বিব্রত করে না। ঘটনা যত অদ্ভুতই হোক সেটাকে স্বাভাবিক মনে করে এগিয়ে চলাই তার কাজ। কিন্তু এখন বেশ বিব্রত সে। আচমকা দাঁতে চাপা পড়ে ঠোঁট কেটে গেলে যেমন লাগে ঠিক তেমন লাগছে তার। মাথার ভিতর কোনো লজিকই কাজ করছে না। চারদিককার সুনসান নীরবতা কাটিয়ে হাই পাওয়ারের চশমা চোখে হাজির শুভ্র। এমন দিনে ঘরে বসে থাকতে পারেনি সেও। এত রাতে বাইরে বেরোনোর মানুষ সে নয়। এরপরও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি কেউ। ততক্ষণে রূপাও ছাদ থেকে নেমে দৌঁড়ে আসছে এদিকেই। সবার দৃষ্টি একজনের দিকেই। তিনি সবার মুরব্বি। তিনি অযৌক্তিক কিছু বলেন না, ভাবেন না। মিসির আলি ভেবেই চলেছেন তার মতো সবারই কী একই জিজ্ঞাসা? গল্পের সব চরিত্রই কি একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে? আজ সবাইকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। হিমুকে আজ হলুদ পাঞ্জাবিতে ঠিক মানাচ্ছে না। শুভ্র সাধারণত ওর হাই পাওয়ারের চশমাটা চোখ থেকে সরায় না। আজ বরাবরই খুলছে আর পরছে। অন্যদিকে রূপার কথার জ্বালায় কারোরই টিকতে পারার কথা নয়। সেও নিশ্চুপ। গৃহত্যাগী জ্যোত্স্নার শেষ যাত্রার কথা মিসির আলিও জানে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। কারণ সে জানে মৃত্যু অমোঘ সত্য। একে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। সবার মনের অবস্থা ভেবে মুখ খুললেন তিনি। বললেন, গৃহত্যাগী জ্যোত্স্না চলে গেছে, এ জন্য আমাদের সবার মন খারাপ- সেটা আমি জানি। কিন্তু তার আজীবন থাকার কথা ছিল না। এটাও সত্যি। তিনি চলে গেছেন ঠিক। কিন্তু হিমু তোমাকে তো নিয়ে যাননি। কই রূপা তোমাকে নিয়ে গেছে? শুভ্র তুমিও তো ঠায় দাঁড়িয়ে। তোমাদের কারও তো বয়স বাড়েনি। বাড়েনি আমার বয়সও। এরপরও কিসের অস্তিত্ব সংকটে সন্ত্রস্ত তোমরা? তিনি আসলে আমাদের ছেড়ে যাননি। তিনি আমাদের মাঝেই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। এই যে হিমু, তুমি যখন হলুদ পাঞ্জাবি পরে জ্যোত্স্না দেখতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা পাকাবে, তখন তিনি আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসবেন। রূপা, তুমি যখন হিমুর জন্য অপেক্ষা করবে, তখন দেখবে ঠিক তিনি তোমার পাশে সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে। আর শুভ্র চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে একবার অনুভব করো তো কী দেখতে পাও? তিনি কি আছেন না? অবশ্যই আছেন তিনি আমাদেরই মাঝে বেঁচে থাকবেন আজ, কাল, পরশু। যুগ থেকে যুগান্তর কাল থেকে কালান্তর।

কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন পাঁচ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু সত্যি কি চলে যেতে পেরেছেন তিনি? মোটেও না। তিনি কেবল তার শরীর ত্যাগ করেছেন। মানুষের অমরত্ব তার বয়সে নয়, কর্মে। হুুমায়ূন আহমেদ তার শরীর ত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু রেখে গেছেন তারা অবারিত কর্ম। তার উপন্যাস, গল্প, নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা গানগুলো তার সঙ্গে যায়নি। তার সৃষ্টির বিশালত্বের কাছে আগেই হার মেনেছে ব্যক্তি হুুমায়ূনের দোষ-ত্রুটি। বাংলা সাহিত্যে রস, আনন্দ আর উপভোগের যে আধুনিক ধারা, তার পথিকৃৎ হুমায়ূন আহমেদ। তিনি সংসার ত্যাগ করে আকাশচারী হয়েছেন। কিন্তু তার সৃষ্টিরা বেঁচে থাকবে আজীবন। সাহিত্যের নতুন যে ধারা তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন সেই পথে হাঁটছে বা হাঁটার চেষ্টা করবে তারই অনুজ সাহিত্যিকরা। কখনো সেইসব সাহিত্যের কলম ধরে আবার কখনো তার নিজের চরিত্রগুলোর মাঝে হেঁটে বেড়াবেন হুুমায়ূন আহমেদ। আজকের পাঠকের কাছে যে হিমু-মিসির আলি চিরচেনা, আগামী দিনের পাঠকের কাছে একই চরিত্র ধরা দেবে নতুন বিস্ময়ে। জোছনা ও জননীর গল্পে আজকের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে। একই বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আঁকবে আগামী প্রজন্ম। শ্যামল ছায়া উপন্যাস বা চলচ্চিত্র আরেক প্রজন্মের কাছে নতুন হয়ে ধরা দেবে। এভাবেই হুমায়ূন আহমেদ টিকে থাকবেন ততদিন যতদিন বাংলা সাহিত্য টিকে থাকবে। এ আলো কখনো নেভার নয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর