বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
গুরমিত রাম রহিম সিং

ভণ্ডগুরুর উত্থান-পতন

সাইফ ইমন

ভণ্ডগুরুর উত্থান-পতন

ভারতের বিতর্কিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং। বিহার রাজ্যের ডেরা সাচ্চা সওদার আশ্রমের গোপন ডেরায় নানা অপকর্ম চালাতেন এ ধর্মগুরু। অঢেল অর্থ-বিত্ত ও দামি দামি গাড়ি, সিনেমার হিরো, বিদেশ সফর আমোদ-প্রমোদের কোনো ঘাটতি ছিল না তার জীবনে। কিন্তু গত কয়েক দিনে বদলে গেছে অনেক কিছু। ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত কথিত এই ধর্মগুরুকে নিয়ে আজকের রকমারি—

 

দামি কাপড় ও গয়না পরাই তার স্টাইল। এই কারণে তাকে অনেকেই সম্বোধন করেন ‘গুরু অব ব্লিং’ নামেও আবার অনেকে বলেন ‘রকস্টার বাবা’। বলা হচ্ছে ‘মেসেঞ্জার অব গড (এমএসজি)’, সিক্যুয়েল ‘এমএসজি২’ এবং ‘এমএসজি: দ্য ওয়ারিয়র লায়ন হার্ট’ নামের তিনটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করা ধর্মগুরু রাম রহিম সিং এর কথা। ভারতে মাত্র ৩৬ জনকে ভিভিআইপি জেড ক্যাটাগরিতে সুরক্ষা দেওয়া হয়। এই ৩৬ জনের মধ্যে ধর্মগুরু রাম রহিম সিং একজন। হরিয়ানার সিরসা শহরের কাছে অবস্থিত এলাকার ডেরা সাচা সওদার সদর দফতরের ভিতরে দুই শিষ্যকে রাম রহিম নিয়মিত ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সেই মামলায় আদালতে রাম রহিম সিংয়ের বিরুদ্ধে নিজের শিষ্যকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তার শিষ্যরা রায় ঘোষণার পরপরই সহিংস প্রতিবাদ শুরু করে। ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় ৩২ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রাম রহিমকে। জানা গেছে এই ধর্মগুরুর রয়েছে পাঁচ কোটিরও বেশি ভক্ত! তার এত ক্ষমতার উৎস কী তা নিয়ে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। 

ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ডেরা সাচা সওদার এই প্রধান ধর্মগুরুর পুরো নাম গুরমিত রাম রহিম সিং। পাঞ্জাব ও হরিয়ানার শহর ও গ্রামাঞ্চলে ডেরা সাচার বহু কেন্দ্র রয়েছে। ১৯৬৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের রাজস্থানের গঙ্গানগর জেলার শ্রী গুরুসর মোদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রাম রহিম। পড়াশোনা করেন গ্রামের স্কুলেই। তরুণ বয়স থেকেই আশপাশের মানুষের মন জয় করে নেন তিনি। বিশেষ করে দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হন রাম রহিম। রক্তদান শিবির, বৃক্ষরোপণের মতো কাজ করে মানুষের মন জয় করতেন তিনি। অনলাইনে যোগের প্রশিক্ষণ দেওয়ায়ও তার সুনাম রয়েছে। নিজেকে সমাজসেবায় নিয়োজিত করে মেয়েদের জন্য হোস্টেল, হাসপাতাল এবং যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের মতো কাজ করেন এই ধর্মগুরু। ১৯৯০ সালে ডেরা সাচা সৌদা সংগঠনের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। ব্যক্তি জীবনে রাম রহিমের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। হরিয়ানা রাজ্যের সিরসায় প্রায় ৮০০ একর জমির ওপর তার ডেরা রয়েছে। তার সংস্থা এমএসজি ব্র্যান্ডের অর্গানিক মধু, নুডলস বিক্রি করে। ২০০৩ সালে গিনেজ রেকর্ড করে ডেরা সাচা। বিশ্বের বৃহত্তম রক্তদান শিবিরের আয়োজনের মাধ্যমে সেই গিনেজ রেকর্ড হয়। রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট প্রভাবশালী রাম রহিম। ২০১৪ সালে হরিয়ানার নির্বাচনে রাম রহিম বিজেপিকে সমর্থন করেন। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে প্রচারণায় নামেন তার সমর্থকরা। সন্যাসি পোষাকের বদলে চামড়া ও রাইনস্টোন রাম রহিমের খুব প্রিয়। তার পোশাক-আশাকে এই দুটিই বেশি দেখা যায়। রাম রহিমের বিরুদ্ধে রয়েছে তিনটি ফৌজদারি মামলা। ২০০২-এ সিরসার এক সাংবাদিক রাম চন্দ্র ছত্রপতিকে খুনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই একই বছরে ডেরার ম্যানেজার রঞ্জিত সিংহকে খুনের অভিযোগ ওঠে। ধর্মীয় গুরু ছাড়াও গায়ক হিসেবে ব্যাপক সুনাম রয়েছে রাম রহিমের। ব্রিটেনের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রিও লাভ করেন এই ধর্মগুরু। এ ছাড়া ডেরার দৈনিক আয় এক কোটি টাকারও উপরে। রাজনৈতিক নেতা থেকে পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত টাকা দিয়ে বশে রাখতেন। ফলে তার বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস কেউ করত না। ২০০৭ সালের মে মাসেও একবার বিতর্কে জড়িয়েছিলেন রাম রহিম। পাঞ্জাবের সাতাওয়ালপুরের একটি সভায় আচমকাই শিখদের দশম ধর্মগুরু, গুরু গোবিন্দ সিংয়ের মতো পোশাক পরে হাজির হন তিনি। একই পোশাকে একটি সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনেও দেখা যায় তাকে। এতে শিখ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। দিল্লি এবং পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ দেখান তারা। রাম রহিমের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। তাতে চটে যায় ডেরা সমর্থকরা। ভাটিণ্ডায় শিখদের ওপর হামলা চালায় তারা। সেই ঘটনায় রাম রহিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। ২০০৭ সালের মে মাসে তিনি পাঞ্জাবে গেলে ফের বিক্ষোভ শুরু হয়। সেখানে প্রতিবাদীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় এক ডেরা সমর্থক। তাতে কোমল সিং নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। যার পর পাঞ্জাব সরকার রাজ্যে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। ওই বছর জুন মাসে ভাটিণ্ডা কোর্টে মামলাটি উঠলে তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তাতে ডেরা সমর্থকরা নতুন করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। এভাবেই ভক্তদের বারংবার নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করে আসছিলেন রাম রহিম। এ ঘটনার আরও পরে ফকিরচাঁদ হত্যার পেছনেও দায়ী করা হয় তাকে। ২০১০ সালে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্টে একটি পিটিশন জমা পড়ে। ডেরা সাচা সওদা সংগঠনের প্রাক্তন ম্যানেজার রামকুমার বিষ্ণোই পিটিশনটি জমা দায়ের করেন। সংগঠনের আর এক প্রাক্তন ম্যানেজার ফকিরচাঁদ নিখোঁজ মামলায় সিবিআই তদন্তের দাবি করেন তিনি। রাম রহিমের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ফের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত। তাতে রাজস্থান, হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবজুড়ে বিক্ষোভে নামে ডেরা সমর্থকরা। বহু সরকারি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রমাণের অভাবে সেবার তদন্ত বন্ধ করে দেন গোয়েন্দারা। তাদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন রামকুমার বিষ্ণোই। আর ১৫ বছর আগে ভারতের স্থানীয় সংবাদপত্র ‘পুরা সাচ (সম্পূর্ণ সত্য)’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল রাম রহিমের নানা কুকর্মের কথা। সেই সঙ্গে পত্রিকার সে খবরে ধর্মগুরু রাম রহিম কীভাবে নারী ভক্তদের ধর্ষণ করছেন তা প্রকাশ করা হয় বিস্তারিতভাবে। সংবাদ প্রতিবেদনটি ভিত্তি ছিল কথিত সেই ধর্মগুরু কর্তৃক ধর্ষণের শিকার এক নারী ভক্তের লেখা চিঠি। চিঠিটি তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বরাবর লেখা হয়েছিল। চিঠির কপি পাঠানো হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছেও। তিন পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছিল রাম রহিম কীভাবে অসংখ্য নারী ভক্তকে ধর্ষণসহ নানাভাবে যৌন নির্যাতন করতেন। পত্রিকায় ওই খবর প্রকাশের পরই পুরো রাজ্যজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা আদালত সেই চিঠি আমলে নিয়েছিল। তৎকালীন সিরসা জেলা ও সেশন জজকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। বিচারক তখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে তদন্ত চালানোর সুপারিশ করলে হাই কোর্ট সিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে নড়েচড়ে বসে কথিত ধর্মগুরু রাম রহিম। ‘পুরা সাচ’ পত্রিকার সম্পাদকের ওপর ভীষণ চটে যান রাম রহিম।

পরবর্তীতে খুন করা হয় সেই সম্পাদককে। ‘পিতাজি কি মাফি’ নামে একটি সেশন করাতেন রাম রহিম। সেই অনুযায়ী একটি গোপন গুহাতে নিয়ে যাওয়া হতো অনুসারীদের। সেখানেও দুজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে শোনা যায়। এ ছাড়াও অভিযোগ উঠেছে ডেরার আশ্রমে প্রায় ৪০০ পুরুষকে জোর করে লিঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে। এরকম নানা কুকর্ম করে আসছিলেন এই ভণ্ড ধর্মগুরু। কিন্তু আবারও প্রমাণিত হলো আইন সবার জন্য সমান।

 

লাগামহীন জীবন

সেবাদাসীর আড়ালে যৌনদাসীরা

কথিত ধর্মগুরু রাম রহিম একেবারে বেপরোয়া জীবনযাপন করতেন। শত শত সেবাদাসী ছিল তার। যাদের সঙ্গে অবাধে যৌনাচার করতেন এই ধর্মগুরু। জানা যায়, প্রায় হাজার একর জমির ওপর তৈরি আস্তানার মাঝখানে আয়নায় মোড়া প্রাসাদে চলত তার সব কুকর্ম। একেক সময়ে সেবাদাসীদের ডেকে নিতেন নিজের খাস কামড়ায়। তারপর বাধ্য করতেন যৌন ক্রিয়ায়। পাশাপাশি টেলিভিশনে চলত অশ্লীল ভিডিও। কেউ এ কাজে অস্বীকৃতি জানালে নিজেকে ঈশ্বর দাবি করে নানা ভয় ভীতি দেখাতেন। এখানেই শেষ নয়। তার কথামতো কাজ না করলে পরিবারের সদস্যদের চাকরি কেড়ে নিবেন এবং নিজস্ব গুণ্ডা বাহিনী দিয়ে হত্যা করবেন বলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতেন রাম রহিম। একবার ভাতিন্দার এক তরুণী রাম রহিমের সব নির্যাতনের কথা পরিবারকে জানান। পরে রাম রহিমের নির্দেশে সবাই মিলে তাকে বেধড়ক মারধর করেন। মেরুদণ্ডে গুরুতর চোট নিয়ে শয্যাশায়ী হন সেই তরুণী। তার বাবা আশ্রমে কাজ করতেন। কাজে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে যান মেয়েকে নিয়ে। রাম রহিমের ভয়ে এবং আত্মসম্মানের কথা ভেবে মুখ খোলেননি তারা। ১৫ বছর আগে নির্যাতনের শিকার হন কুরুক্ষেত্রের এক তরুণীও। ডেরা ছেড়ে বাড়িতে চলে যান তিনি। তার কাছ থেকে রাম রহিমের কুকর্মের কথা জানার পর তার ভাইও আশ্রমের কাজ থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে যান। একবার পাঞ্জাবের সঙ্গরুর এক তরুণী সাহস করে বাড়ি ফিরে আশ্রমের ভয়ঙ্কর দিকটা সবাইকে জানিয়েছিলেন। পর দিনই রাম রহিমের অস্ত্রধারী গুণ্ডারা তার বাড়িতে পৌঁছে তাকে খুনের হুমকি দেয়। ২০১৫ সালে দিনমজুর কমলেশ রাইগর ও স্ত্রী গুড্ডি দেবী একসঙ্গে গিয়েছিলেন রাম রহিমের সাক্ষাতের আশায়। অথচ রাম রহিম সেই দিনমজুরের স্ত্রীকে জোর করে রেখেদেন আশ্রমে। মামলা হলে ওই বছর ২১ মে আদালতে শুনানির দুদিন আগে কমলেশকে অপহরণ করে আশ্রমের গুণ্ডাবাহিনী। এদিকে পালিত মেয়ের সঙ্গেও যৌন সম্পর্ক করতেন বলে দাবি করেছিলেন পালিতে মেয়ের স্বামী গুপ্তা বিশ্বাস।

 

গুরু যখন খুনি

সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতি হত্যা

কথিত ধর্মীয়গুরু রাম রহিমের বিরুদ্ধে রয়েছে সাংবাদিক হত্যার অভিযোগ। ২০০২ সালে ধর্ষণের তথ্য ফাঁস করায় সাংবাদিক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে হত্যা করেন রাম রহিম। রামচন্দ্র ছিলেন ভারতের স্থানীয় সংবাদপত্র ‘পুরা সাচ (সম্পূর্ণ সত্য)’ পত্রিকার সম্পাদক। ১৫ বছর আগে রাম রহিম কর্তৃক ধর্ষণের খবর ছেপেছিলেন তিনি। তখনই ছত্রপতিকে হত্যার নীলনকশা করা হয় রাম রহিমের আশ্রমে। শুরু হয় রামচন্দ্র ছত্রপতির ওপর পাল্টা চাপ আর হুমকি। খবরটি সম্পূর্ণ অসত্য এমন দাবি করে একের পর এক হত্যার হুমকি আসতে থাকে রামচন্দ্র ছত্রপতির ওপর। কিন্তু এতে দমে না গিয়ে উল্টো নিয়মিত রাম রহিমের আশ্রমের নানা কুকীর্তি তার পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন রামচন্দ্র ছত্রপতি। আশ্রম থেকে নানা তথ্য দিয়ে পত্রিকাটিকে সাহায্য করছিলেন রণজিৎ ও তার বোন। এরা দুজনই ছিলেন রামচন্দ্র ছত্রপতির সোর্স। রাম রহিমের আশ্রমের দশ প্রধানের একজন ছিলেন রণজিৎ এবং তার বোন ছিলেন আশ্রমের একজন ভক্ত। পত্রিকাটির তথ্য পাওয়ার ‘সোর্স’ কে খোঁজাখুঁজি শুরু হলে পালিয়ে যান ভাইবোন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয় রণজিৎকেও। এই হত্যার পেছনেও রয়েছে রাম রহিমের হাত। এর পর রামচন্দ্র পুলিশের কাছে নিরাপত্তার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেসময় পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা পাননি তিনি। এ ঘটনার এক মাস পরেই ২০০২ সালের ২৪ অক্টোবর নিজ বাড়ির সামনেই সাংবাদিক রামচন্দ্র ছত্রপতিকে খুব কাছ থেকে গুলি করে এক বাইক আরোহী। টানা ২৮ দিন লড়ে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রামচন্দ্র ছত্রপতি। কিন্তু মৃত্যুর আগে পুলিশের কাছে এ ঘটনার জন্য রাম রহিমকে দায়ী করে যান। বাবার মৃত্যুর বিচারের দাবিতে লড়ে যাচ্ছেন রামচন্দ্রের ছেলে সাংবাদিক অংশুল। তিনি দাবি করেন পুলিশ এফআইআর থেকে প্রধান আসামি রাম রহিমের নাম মুছে দেন। পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে ১৫ বছর ধরে মামলাটি ঝুলে রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে খুব শিগগিরই এই মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হতে যাচ্ছে।

 

আলোচিত সেই পালিত কন্যা

হঠাৎ করেই আলোচনায় উঠে এসেছে রাম রহিমের পালিত মেয়ে হানিপ্রীত। রাম রহিমের উত্তরাধিকার ভাবা হচ্ছে এই পালিত মেয়েকেই। রাম রহিম সিংহের ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি। রাম রহিমের ভক্তরা তাকে ‘পাপা’স অ্যাঞ্জেল’ বলে ডাকেন। এদিকে পালিত মেয়ের সঙ্গেও যৌন সম্পর্ক করতেন বলে দাবি করেছেন পালিত মেয়ের স্বামী গুপ্তা বিশ্বাস। তার দাবি, ২০১১ সালে একবার তিনি আশ্রমে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছিলেন রাম রহিম, তার স্ত্রী ও পালিত মেয়ে হানিপ্রীতকে। এদিকে পালিত মেয়ে ছাড়া আর কেউ রাম রহিমের মাইগ্রেন আর পিঠ ব্যথার দেখাশোনা করতে পারে না। তাই ধর্ষণ মামলায় সাজা ঘোষণা হওয়ার পরে পালিত মেয়ে হানিপ্রীতকে সঙ্গে নিয়েই জেলে থাকার জন্য আদালতের কাছে আবদার করেন রাম রহিম। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনুমতি মেলেনি।

 

সাধ্বীর আলোচিত বেনামি চিঠি

আমি পাঞ্জাব থেকে আসা মেয়ে। সিরসার ডেরা সাচ্চা সৌদায় একজন সাধ্বী হিসেবে সেবা করে চলেছি গত ৫ বছর ধরে। আমার মতো আরও কয়েকশো মেয়ে এখানে রয়েছেন, যারা প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা করে সেবা করে চলেছেন।

কিন্তু এখানে আমরা যৌন নির্যাতনের শিকার। ডেরায় মেয়েদের ধর্ষণ করেন ডেরা মহারাজ। আমি একজন স্নাতক। ডেরা মহারাজের উপরে আমার পরিবারের অন্ধ বিশ্বাস। সাধ্বী হওয়ার বছর দুয়েক পর একদিন জানানো হয়, মহারাজ আমাকে ডেকেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তার ঘরে যেতেই দেখলাম ওনার হাতে একটা রিমোট এবং টিভিতে তিনি ব্লু ফিল্ম দেখছেন। আমাকে ঠিক তার পাশে নিয়ে গিয়ে বসান। খাওয়ার জন্য এক গ্লাস জল দেন। তার পর খুব আস্তে করে বলেন, ডেকে পাঠানোর কারণ আমাকে তিনি নিজের খুব কাছের বলে মনে করেন। এটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। এর পরই এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে তার আরও কাছে টেনে নেন। আমার সঙ্গে সহবাস করতে চান। বলেন, তার শিষ্যা হওয়ার সময়ই আমার সব সম্পদ, আমার শরীর এবং আত্মা তার কাছে উৎসর্গ করেছি এবং তিনি তা গ্রহণও করেছেন। আমি বাধা দিলে তিনি বলেন, ‘আমি ঈশ্বর, এতে তো কোনো সন্দেহ নেই’। আমি তাকে বলি, ঈশ্বর কখনো এ রকম করেন না। আমাকে বাধা দিয়ে তিনি বলেন— শ্রীকৃষ্ণও ঈশ্বর। তার ৩৬০ জন গোপী ছিলেন। যাদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমলীলা করতেন। আমাকেও সবাই ঈশ্বর বলে মানে। এতে এত অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাকে এখনই খুন করতে পারি। তোমার পরিবারের প্রতিটা সদস্য কখনই আমার বিপক্ষে যাবেন না। সরকারের উপরেও আমার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রের অনেক মন্ত্রীও আমার কাছে আসেন। আমার প্রতি তাদের ভক্তি দেখান। রাজনীতিবিদরা আমার কাছ থেকে সাহায্য নিতে থাকেন। সুতরাং তারাও আমার বিরুদ্ধে কোনো রকম পদক্ষেপ করবে না। আমি তোমার পরিবারের সদস্যদের সরকারি চাকরি কেড়ে নেব এবং তাদের সেবাদার দিয়ে খুন করাব। আর সেই খুনের কোনো প্রমাণ থাকবে না। তুমি খুব ভালো করেই জানো, ডেরা ম্যানেজার ফকিরচাঁদকেও আমি গুণ্ডা দিয়ে খুন করিয়েছি। এখনো সেই খুনের কিনারা হয়নি। ডেরার দৈনিক আয় এক কোটি। এই টাকা দিয়ে আমরা রাজনীতিক নেতা, পুলিশ এমনকি বিচারক সবাইকেই কিনে ফেলতে পারি।

ঠিক এর পরই মহারাজ আমাকে ধর্ষণ করেন। গত তিন বছর ধরেই মহারাজ এভাবে আমাকে ধর্ষণ করে আসছেন। প্রতি ২৫ থেকে ৩০ দিন অন্তর আমার পালা আসে। আমি জানতে পেরেছি, আমার মতো যত জন সাধ্বীকে তিনি তলব করেছেন, তাদের সবাইকেই ধর্ষণ করেছেন। বেশিরভাগেরই বয়স এখন ৩০ থেকে ৪০। বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে। তাদের কাছে এখন ডেরার এই আশ্রয় ছাড়া আর কোনো অবলম্বন নেই। এসব মহিলার বেশিরভাগই শিক্ষিত। কারও স্নাতক তো কারও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে। কিন্তু তারা তা সত্ত্বেও এই নরকবাস করছেন। কারণ একটাই, মহারাজের উপরে তাদের পরিবারের অন্ধ বিশ্বাস। আমরা সাদা পোশাক পরি, মাথায় স্কার্ফ বাঁধি, পুরুষদের দিকে চেয়ে দেখি না। পুরুষদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হলে ৫-১০ ফুট দূরত্ব বজায় রাখি। কারণ, এসবই মহারাজের ইচ্ছা। তার কথা মতোই আমরা এখানে চলাফেরা করি। সাধারণ মানুষ আমাদের দেবী গণ্য করেন। কিন্তু তারা জানেন না, ডেরাতে আমরা আসলে রক্ষিতা। ডেরা এবং মহারাজের আসল সত্যিটা আমি আমার পরিবারকে জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। তাতে তারা আমাকেই বকাবকি করেন। জানান, ডেরায় স্বয়ং ঈশ্বরের বাস। সুতরাং এর থেকে ভালো জায়গা আর নেই এবং ডেরা সম্পর্কে যেহেতু আমার মনে খারাপ ধারণা জন্মেছে, তাই আমার উচিত ‘সত্যগুরু’-র নাম করা। শেষ পর্যন্ত আমাকে মহারাজের সব আদেশ পালন করতেই হয়, কারণ আমি সব মিলিয়ে অসহায়। এখানে কাউকেই অন্যদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে দেওয়া হয় না। পাছে ডেরার সত্য ফাঁস হয়ে যায়, তাই টেলিফোনেও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। কোনো সাধ্বী যদি মহারাজের এই আচরণ ফাঁস করে দেন, তাহলে মহারাজের আদেশ মতো তাকে শাস্তি  দেওয়া হয়।

সাধারণ মানুষের স্বার্থেই এই সত্য আমি সামনে আনতে চাই।   (ঈষৎ সম্পাদিত)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর