বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোন দেশে কেমন হাইওয়ে

যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নত সড়ক-মহাসড়কের বিকল্প নেই। যাত্রী পরিসেবা তো বটেই, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অবিরাম ও নিরাপদ হাইওয়ে নির্মাণে বিশ্বের প্রতিটি দেশই মনোযোগী। দেশে দেশে হাইওয়ে বা মহাসড়কের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেগুলো মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও নির্মাণকৌশলে নির্মিত হচ্ছে। বিশ্বের কোনো দেশেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে স্থবির থাকে না প্রধান মহাসড়কগুলো—

তানভীর আহমেদ

কোন দেশে কেমন হাইওয়ে

ভারত

  মহাসড়ক নির্মাণে গত কয়েক দশকে ভারত মনোযোগী হয়েছে। হাইওয়ের পাশাপাশি এখনই প্রায় ৩০টির মতো এক্সপ্রেসওয়ে রয়েছে ভারতে। ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটারের বেশি এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে নির্মাণাধীন আছে আরও ৭ হাজার ৪০০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে। ২০২২ সাল নাগাদ ভারত ১৮ হাজার কিলোমিটার হাইওয়ে নির্মাণে সচেষ্ট। বর্তমানে ভারতে ছয় থেকে আট লেনের হাইওয়েগুলোর যোগফল ১ লাখ ৬৫ হাজার কিলোমিটার। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই হাইওয়েগুলো। ভারত হাইওয়েগুলোকে সর্বাধুনিক, নিরাপদ ও যাত্রীবান্ধব করে গড়ে তুলছে। এই হাইওয়েগুলোতে ১০০ কি.মি. প্রতি ঘণ্টায় নিরবচ্ছিন্নভাবে গাড়ি চলতে পারে। এক মুহূর্তের জন্য অধিকাংশ হাইওয়েতে গাড়ি দাঁড়ায় না। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে শক্ত আইন রয়েছে, রয়েছে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা। এছাড়াও পথে পথে ট্রাফিক পুলিশ পেট্রোলিং, চেকিং করা হয়। উন্নত সড়ক নির্মাণ ও মহাসড়কে সবুজায়ন প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন হচ্ছে। চীনের পর এ অঞ্চলে ভারত সবচেয়ে দ্রুত আধুনিক হাইওয়ে সম্প্রসারণে কাজ করছে। ওপরে ভারতের ‘ন্যাশনাল হাইওয়ে ফাইভ’-এর ভিজায়াওয়াদা সেকশনে ছয় লেনে উন্নীতকরণের ছবি।

 

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটে ছুটে চলার জন্য রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক মহাসড়ক। মডেল হাইওয়ের দেশও যুক্তরাষ্ট্র। বন-পাহাড়, নদী, মরুভূমি— কোনো বাধাই এই মহাসড়কগুলোর পথ আটকাতে পারেনি। ‘ইন্টারস্টেট নাইনটি’ হাইওয়েটি আমেরিকার বস্টন, ম্যাসাচুসেটস হয়ে সিয়াটল, ওয়াশিংটন পর্যন্ত চলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ এই হাইওয়ের দৈর্ঘ্য ৪ হাজার ৮৬০ কিলোমিটার! যুক্তরাষ্ট্রের রুট টুয়েন্টির পাশ দিয়ে চলা এই মহাসড়কটি ১৩টি স্টেট পাড়ি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাসড়কগুলা সর্বাধুনিক, নিরাপদ ও যাত্রীসেবায় এগিয়ে রয়েছে।

 

কানাডা

কানাডা থেকে আলাস্কা পর্যন্ত মহাসড়ক ‘দ্য আলকান হাইওয়ে’। বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় জাগানিয়া এই মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ১৬৭ কিলোমিটার। একটানা গাড়ি চালিয়েও সবমিলিয়ে একদিন সাত ঘণ্টা সময় লাগে এই হাইওয়ের পথচলা। এই মহাসড়কের অর্ধেক পথ উত্তর আমেরিকার বন্য, দুর্গম অঞ্চলের ভিতর দিয়ে চলেছে। শরতে এই পথে চলাচল শেষে অনেকে আতিশয্যে স্বর্গের সড়ক বলেও অভিহিত করেন। আবার শীতে তুষারপাতে ছেয়ে যায় ‘দ্য আলকান হাইওয়ে’।

 

১৩৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সাউদার্ন এক্সপ্রেসওয়ে কলম্বোর সঙ্গে জুড়েছে আটটি বড় শহরকে

শ্রীলঙ্কা

‘সাউদার্ন এক্সপ্রেসওয়ে’ সংক্ষেপে ই-ওয়ান মহাসড়ক শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। ইউরোপ, আফ্রিকার আধুনিক প্রযুক্তি ও নির্মাণকৌশলের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শ্রীলঙ্কার এই স্বপ্নবিলাসী প্রজেক্ট যে কাউকে চমকে দেবে। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান শ্রীলঙ্কার অহংকার হিসেবেও দেখা হয় এই মহাসড়কটিকে। ২০০৬ সালে এই স্বপ্নের যাত্রা হলেও ২০১১ সালের শেষদিকে জোরেশোরে এগোয় এর নির্মাণ। এই হাইওয়ের দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। কলম্বো ও মারাটা শহরকে বেঁধেছে এই মহাসড়ক। এছাড়া চলতি পথে আরও আটটি বড় শহরের বুক চিড়ে যাবে সাউদার্ন এক্সপ্রেসওয়ে।

 

চীনের ইনশি-কুইংজেন হাইওয়ে

চীন

আধুনিক মহাসড়ক নির্মাণে চীন দিনকে দিন সবাইকে ছাপিয়ে চলেছে। চীনের হাইওয়ে আধুনিকায়ন হচ্ছে। এরই মধ্যে ১ লাখ ৩১ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মিত হচ্ছে চীনে। ১০ লাখ ৮০ হাজার জাতীয় মহাসড়ক চীনকে মহাসড়কের সম্রাট হিসেবেই তুলে ধরে। বেইজিংকে কেন্দ্র করে ঘড়ির কাঁটার মতো এই হাইওয়েগুলো ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের অন্যতম সড়ক নির্মাণে সফল এই দেশ। রেল যোগাযোগ বিশ্বের প্রথম শ্রেণিতে নিয়ে যাওয়ার পরও ২০০৫ সালে চীন আরও ৮৫ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণের ঘোষণা দেয়। এমন কোনো প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা নেই যেগুলো মোকাবিলা করে চীন তার মহাসড়কগুলাকে বিশ্বসেরার তালিকায় নিয়ে গেছে।

 

ইলেকট্রিক গাড়ির মহাসড়ক অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের অহংকার

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া বিখ্যাত তার মেরিন ড্রাইভগুলোর জন্য। এছাড়া শহর থেকে শহরে ছুটে চলার হাইওয়েগুলো আধুনিক নির্মাণকৌশলের আদর্শ উদাহরণ। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন থেকে ‘সারফারস প্যারাডাইজ’ পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইলেকট্রিক মহাসড়ক নির্মাণের কথা কারও অজানা নয়। বৈদ্যুতিক চার্জ নিয়ে প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার ছুটতে পারবে এ পথে চলাচলকারী ইলেকট্রিক গাড়িগুলো। ‘কুইন্সল্যান্ডের স্বপ্ন’ এই মহাসড়ক বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ বৈদ্যুতিক গাড়ির মহাসড়ক। আধুনিক মহাসড়কের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার মেরিন ড্রাইভ গ্রেট ওশান রোড থাকবে শুরুতেই। ভিক্টোরিয়া থেকে ১৫০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ওয়ার্নারম্বুল শহরে গিয়ে ঠেকেছে এই মহাসড়কটি। ‘লং জার্নি’র জন্য পর্যটকদের কাছে প্রিয় এই মহাসড়কটি। এই মহাসড়ক জনপ্রিয় করে তুলেছে অ্যাপোলো সমুদ্রসৈকত।

২৫ মাইল দীর্ঘ এই সমুদ্রসৈকতের পর পোর্ট ক্যাম্পবেল জাতীয় উদ্যানের সঙ্গে জুড়েছে এই মহাসড়ক। অস্ট্রেলিয়ায় মেরিন ড্রাইভ ছাড়াও মেরিন লুপ রোডের কথাও একই সঙ্গে চলে আসে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সম্মিলন এক সুতায় জুড়েছে এই মহাসড়কটি। হুট করেই শহুরে আবহাওয়া পাল্টে রুক্ষ মরুভূমিতে এসে পড়ে গাড়ি। একের পর এক ক্ষয়প্রাপ্ত পাহাড়ের বাঁক পেড়িয়ে কখন মরুভূমির পথ পেড়িয়ে পৌঁছে যায় শীতল গুহায় তা আগে থেকে অনুমান করা যায় না। এই মহাসড়কের বেশিরভাগ অংশই বিটুমিন কার্পেটিং ছাড়া— তবু মহাসড়কটি রোমাঞ্চপ্রিয়দের কাছে আকর্ষণীয়।

 

১৮টি নদীর ওপর দিয়ে ২৩৬টি সেতু পাড়ি দেয় ‘রুতে ফোরটি’ মহাসড়ক

আর্জেন্টিনা

প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর আর্জেন্টিনার মহাসড়কগুলো মহাপরিকল্পনার অনন্য ফসল। আর্জেন্টিনার নদী, পাহাড়, রুক্ষ, দুর্গম অঞ্চল মহাসড়ক নির্মাণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সে সব ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়। আর্জেন্টিনার অন্তত ১৫টি মহাসড়ক বিশ্বজুড়েই আলোচিত ও প্রশংসিত। এ দেশের বিখ্যাত হাইওয়ের কথা এলে অনেকেই ‘রুতে ফোরটি’র কথা বলেন। পশ্চিম আর্জেন্টিনার গর্ব এই মহাসড়ক। পুনা থেকে কাবো ভার্জিন পর্যন্ত দীর্ঘ এই হাইওয়েটি পাড়ি দিয়েছে ৩ হাজার ৪৫ মাইল! রীতিমতো অবিশ্বাস্য দৈর্ঘ্যের এই মহাসড়কটি আর্জেন্টিনার সবচেয়ে দীর্ঘ মহাসড়ক। ‘রুতে ফোরটি’ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুট ওপরে নির্মিত। এই মহাসড়ক পাড়ি দিয়েছে ১৮টি বৃহদাকার নদী। ২৩৬টি সেতু, ১৩টি লেক এবং জাতীয় উদ্যানের বুক চিড়ে চলেছে মহাসড়কটি।

 

বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন পাঁচ লাখ গাড়ি যাতায়াত করে, নেই কোনো যানজট

সবচেয়ে ব্যস্ত

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া নয়, কানাডার অন্তারিও হাইওয়েটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত ও অন্যতম প্রশস্ত মহাসড়ক। কানাডার প্রদেশ অন্তারিও’র এই হাইওয়েটির নাম ‘কিংস হাইওয়ে ফোরটি ওয়ান’। প্রতিদিন এই মহাসড়কে পাঁচ লাখ গাড়ি যাতায়াত করে। মোট ১৬ লেনে সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চলতে কখনো যানজটের তৈরি হয় না। কোনো গাড়ি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে না, গতি নিয়ন্ত্রিত থাকে। ৮২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মহাসড়ক ক্যামব্রিজ, টরেন্টো, কিংসটনের মতো বড় শহরকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। এই মহাসড়ককে প্রকৌশলীরা ‘হাইওয়ে অব হিরোস’ বলে আখ্যায়িত করেন।

 

ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে

বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই মহাসড়কগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে ছুটে চলে গাড়ি। ঘণ্টায় একশ মাইল বেগে ছুটে পাড়ি দেয় শত শত মাইল— তখন বাংলাদেশের মহাসড়কের চিত্র পুরো উল্টো। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে দেশের প্রধান মহাসড়কগুলো চলে গেছে বিভাগীয় শহরে। ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র মহাসড়কগুলোর অবস্থা সঙ্গীন। মহাসড়কে যানজটের চিত্র ঈদ মৌসুমে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দেশের মহাসড়কগুলো যাত্রী চাপ সামলাতে পারছে না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের বর্ষণ ও বন্যা। বিধ্বস্ত মহাসড়কগুলোতে চলছে সংস্কার কাজ। নিয়ম ভেঙে মহাসড়কে গাড়ি চলার উৎসব চলে। ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়কে নেমে অবস্থা আরও শোচনীয় করে   তোলে। মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকসহ যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ, বৃষ্টির কারণে মহাসড়কে খানাখন্দ, ফিটনেসবিহীন যানবাহন মহাসড়কে বিকল হয়ে পড়া-যানজটের মূল কারণ। প্রধান মহাসড়কের কয়েকটি পয়েন্টে যানজটের তীব্রতা এতটাই বেশি হয় যে, ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি দাড়িয়ে থাকে।

 

ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে যানজটে দাঁড়িয়ে থাকে গাড়ি

 

কোনো কোনো মহাসড়কে যানজটের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। যানজটের কারণে ২ ঘণ্টার রাস্তা পাড়ি দিতে সময় লাগে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। মহাসড়ক সচল রাখতে দেশের সড়ক বিভাগ ও ট্রাফিক বিভাগ সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও সচেষ্ট থাকলেও সব সময় চিত্র স্বস্তিদায়ক নয়। আধুনিক বিশ্বের কোনো দেশে মহাসড়কের এই বেহাল দশা রীতিমতো অকল্পনীয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর