শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভগবান রাজনীশের যত কাণ্ড!

ভগবান রাজনীশের যত কাণ্ড!

ভক্তদের সঙ্গে নিজ আশ্রমে গুরু রাজনীশ

ক্সগুরু ভগবান শ্রী রাজনীশ। জীবনে বহুবার বিতর্কিত হয়েছেন এই সন্ন্যাসী। ছিলেন প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। বিশ্বাস করতেন সেক্সের মাধ্যমেই পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়া সম্ভব। আর মানুষের সৃষ্টি সবচেয়ে বড় মিথ্যার নাম হলো ‘ঈশ্বর’। ধ্যানের শিক্ষা দিয়ে গেছেন নিজের শিষ্যদের। সেই সঙ্গে তার আশ্রমে অবাধে সেক্সের সুযোগ ছিল। লিখেছেন— সাইফ ইমন

 

রক্ষণশীলতার শৃঙ্খল থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখতেন ভগবান রাজনীশ। যার আধ্যাত্মিকতা গৌতম বুদ্ধের মতো মহীয়ান এবং একই সঙ্গে যার ইহজাগতিকতা গ্রিক উপন্যাসে যুক্ত করার মতো স্বচ্ছ বস্তুগত। যিনি যুগপৎ বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে একীভূত। যার সবকিছু বস্তুগত লাভের জন্য, আবার সবকিছুই আত্মার প্রশান্তির জন্য। তবে এই নতুন মানুষ পরিবার, বিয়ে, রাজনীতি ও ধর্মের ফাঁদে পা দেবে না। এক্ষেত্রে ভগবান রাজনীশের চিন্তা ছিল অত্যাধুনিক। সর্বোপরি তার নৈতিক শিক্ষা ও লৌকিকতাবর্জিত নয় বরং স্বাভাবিক। মানবতাবাদী এই দার্শনিকের কাছে প্রতিটি মানুষই গুরুত্বপূর্ণ এবং অসীম সম্ভাবনাময়। তার মতে, আমরা সবাই সম্ভাবনাময় বুদ্ধ এবং সবারই আলোক প্রাপ্তির ক্ষমতা রয়েছে। তিনি বিশ শতাব্দীর ভারতীয় দার্শনিক ভগবান রাজনীশ। তিনি শ্রী ভগবান রাজনীশ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং পরবর্তীতে পরিচিত হন ‘সেক্সগুরু’ হিসেবেও। বিতর্কিত এই মানুষটি জন্ম থেকেই আলোচিত বা সমালোচিত ছিলেন না। ভারতের মধ্য প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের এক কাপড় ব্যবসায়ীর পরিবারে জন্ম তার। জীবনের প্রথম সাত বছর কাটে মামা বাড়ির আঙিনায়। ষাটের দশকে রাজনীশ নাম হলেও সত্তরের দশকে তিনিই বনে যান ওশো রাজনীশ। অনেক মেধাবী ছিলেন শ্রী রাজনীশ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর দর্শনের শিক্ষক ছিলেন রাজনীশ। পড়াশোনা চলাকালীন বিশ্বভ্রমণে আগ্রহী ছিলেন তিনি। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এই মানুষটি শুরু থেকেই ছিলেন গান্ধীবাদী। তার মতে, ‘সমাজতন্ত্র এবং গান্ধী উভয়েই দারিদ্র্যকে নির্মূল করার চেয়ে বিশেষায়িত করে।’ তিনি হিন্দু ধর্মের ব্রাহ্মণবাদের বিরুদ্ধেও অত্যন্ত জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। গত্বাঁধা নিয়মকে ব্যাতিরেকে কীভাবে হাসি-আনন্দ আর নাচ-গানের মধ্য দিয়ে জীবনকে ভরিয়ে দেওয়া যায়, কীভাবে প্রেম, সততা, ধ্যান এবং অবাধ যৌন মিলনের মধ্য দিয়ে জীবনকে আরও ভালোভাবে উপভোগ করা যায়। জীবনটা হতে পারে স্বপ্নের মতো। একই সঙ্গে বুদ্ধ দর্শন তথা জাগতিকতায় নিরাসক্ততার বিপরীতে তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেন— ‘যে ধর্ম জীবনকে অর্থহীন এবং দুঃখময় ভাবে জীবনকে ঘৃণা করতে উদ্বুদ্ধ করে, তা সত্য ধর্ম নয়। ধর্ম হলো একটি শিল্প যা আমাদের শিক্ষা দেয় কী করে জীবনকে উপভোগ করা যায়।’ এই ভাবনার রেশ ধরেই তিনি মানুষের যৌনক্রীড়ার ওপর বিভিন্ন ধর্মের আরোপিত অসঙ্গতি, বিধি-নিষেধ ও অবদানের শিক্ষাকে সমালোচনা করেছেন।

১৯৭০ সালে মুম্বাইতে তিনি নতুন ধরনের চিন্তাভাবনার প্রচার করেছেন। এটাই ছিল তার শুরুর ভাবনা। সেই থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তার প্রচারিত নতুন ভাবনাগুলো অনেকেই উদ্ভট বলে মনে করত। এরপর তিনি সাত বছর পুনেতে একইভাবে নিজের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ করেন। একসময় তার ভাবনার পরিধি আশ্রমে রূপ নেয়। তিনি পুনেতেও মুম্বাইয়ের মতো বিশাল আশ্রম গড়ে তোলেন। প্রচুর মানুষ তার কাছে এসে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। তার শিষ্যদের মধ্যে শিক্ষিত আর ধনী ব্যক্তির সংখ্যাই ছিল বেশি। এই গ্রুপের সদস্যরা সবসময় কমলা রঙের লম্বা আলখেল্লা পরত। তাদের গলায় ঝুলত রুদ্ধাখ্যের মালা। কাজ-কর্ম, ধ্যান, নাচ এবং আলোচনা ছিল এই জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের রুটিন। মনে তাদের যত ধরনের সংকোচবোধ ছুড়ে ফেলে দিত এর সদস্যরা।

এরপর ১৯৮১ সালে ভগবান রাজনীশ পাড়ি জমান মার্কিন মুল্লুকে। রাজনীশ ওরেগনের একটি নির্জন জায়গায় একটি খামার কেনার পরিকল্পনা করেন। একটি কমিউন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেখানকার কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। সেই কাজের দায়িত্ব যার হাতে ছিল তার নাম দ্যান দারো। তখন দ্যানের কোনো ধারণাই ছিল না যে ভগবান রাজনীশের হাজার হাজার ভক্ত রয়েছে। এরা যখন ওরেগনে দলে দলে এসে জড়ো হতে থাকল তখনই তিনি সেটা টের পেলেন। সেখানে রাজনীশের কাছে অনেকেই জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন। ১৯৮২ সালে কমিউনের নেতারা তাদের আবাসকে শহর হিসেবে ঘোষণা করার আবেদন করেন। তারা শহরের নাম দিতে চেয়েছিলেন রাজনীশপুরম। তাদের আবেদন মঞ্জুর হলে সেখানে অনেক দালান নির্মাণ করতে পারবে। কিন্তু সেখানকার স্থানীয়দের অনেকেই এর বিরোধিতা করে আদালতে মামলা করেন। দুই বছর ধরে মামলা চলার পর ১৯৮৪ সালে কমিউনের নেতারা দেখলেন মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার চমৎকার সুযোগ এসেছে। আর সেটা হলো স্থানীয় কোনো শিষ্যকে আদালতের দুজন বিচারকের পদে আসন্ন নির্বাচন। কিন্তু এই নির্বাচনে জয়ের পুরো ভোট রাজনীশ কওমের ছিল না। তাই ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মকাল নাগাদ পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে হাজার হাজার গৃহহীন মানুষকে তারা তাদের রাজনীশপুরমে নিয়ে আসতে শুরু করেন। কিন্তু প্রায় চার হাজার মানুষ রাজনীশপুরমে নিয়ে আসার পরও এই নির্বাচনে জেতার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এমনটা কিছু করতে হবে যেটা করলে ভোটের দিন ভোটাররা ভোট কেন্দ্রেই যাবে না। পরবর্তীকালে তদন্তে যা বেরিয়ে এসেছিল যে কওমের নেতারা গোপনে স্থানীয় ডালাস শহরে স্যালমনিয়া ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার শুরু করে। তদন্তকারীরা পরে দেখতে পান যে, রাজনীশ ভক্তের একটি দল শহরের আটটি সালাদ ক্যাফে ও দুটি রেস্টুরেন্টে এই ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে দেয়। এরপরই স্থানীয় হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাজনীশপুরমের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা ক্রমাগতই একা হয়ে যাচ্ছিলেন। তারা সবাইকে শত্রু বলে মনে করতে শুরু করেছিলেন। অ্যান গ্যারিটির মতো মানুষ যারা এসব দেখে সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন, তারাও ক্রমাগত চাপের শিকার হচ্ছিলেন। এর কিছুদিন পরই অ্যানকে কমিউন থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং পাঠানো হয় জার্মানির একটি কমিউনে। ওরেগনের সংকট ঘনীভূত হয় ১৯৮৫ সালে, যখন রাজনীশ কমিউনের কয়েকজন নেতা হঠাৎ করেই ইউরোপে পালিয়ে যান। এর কিছুদিন পরই ভগবান রাজনীশ জনসম্মুখে এক অদৃষ্টপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি তার সাবেক ভক্তদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, অগ্নিকাণ্ড, গোপনে আড়ি পাতা এবং গণহারে বিষ প্রয়োগের অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, এসব অপরাধ সম্পর্কে তিনি নিজে কিছুই জানতেন না। ভগবান রাজনীশের এই ভিডিও দেখে শেষ পর্যন্ত অ্যানের মোহভঙ্গ হয়। ভগবান রাজনীশ তদন্তকারীদের রাজনীশপুরে এসে তদন্ত করার আমন্ত্রণ জানান। তারা সেখানে সালমোনেয়ারে একটি গবেষণাগার আবিষ্কার করেন এবং আড়ি পাতার যন্ত্রপাতির খোঁজ পান। কমিউনের মূল নেতারা শেষ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে তাদের শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে আনেন। ডালাসে বিষ প্রয়োগের অভিযোগসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ তারা স্বীকার করে নেন। এতে তিনজনের কারাদণ্ড হয়। তাদের গুরু ভগবান রাজনীশের বিরুদ্ধে ইমিগ্রেশন আইন ভঙ্গের প্রমাণ মেলে এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়। তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল তাকে। ১৯৮৫ সালে ভারতের দিল্লিতে ফেরত আসার পর তাকে তার অনুসারীরা উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। এরপর হিমাচল প্রদেশে ছয় সপ্তাহ অবস্থানের পর ভারত সরকারও তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এরপর গুরু রাজনীশ নেপালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল না ভগবান রাজনীশের। তার মতবাদ হলো, ঈশ্বর মানুষের সৃষ্টি করা সব থেকে বড় মিথ্যা। তবে পূর্ণ সম্মতি ছিল সম্মোহনে। আধ্যাত্মিকতা আর যৌনতার সংমিশ্রণে এক ধরনের দার্শনিক জ্ঞানের প্রচার করতে থাকেন। অপার যৌনতাই মুক্তির মূলমন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন নিজে। ভগবান রাজনীশ যৌনতাকে দেখেছেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে। তিনি দাবি করতেন, যৌনতায় খারাপ কিছু নেই। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজে যৌনতার শিক্ষা দেওয়া উচিত। মানুষের মনকেই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে দাবি করতেন তিনি। ধনকুবেররা এই গুরু রাজনীশের দীক্ষা নিতেন। তাদের সৌজন্যে রাজনীশের ব্যক্তিগত ধনসম্পদ ছিল প্রচুর। যদিও তিনি এসব ধনসম্পদকে অপাংক্তেয় মনে করতেন। ভারতের পুনেতে আছে ওশো ইন্টারন্যাশনাল মেডিটেশন রিসোর্ট। প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে আসেন কয়েক লাখ ভক্ত-পর্যটক। ১৯৯০ সালের ৯ জানুয়ারি প্রয়াত হন পুণের আশ্রমে থাকাকালীন অবস্থায়। অনেকেই বলেন, তাকে চক্রান্ত করে হত্যা করিয়েছে মার্কিন সরকার। আবার অনেকেই তার ওপর তোলা অভিযোগগুলোকে মিথ্যা বলে দাবি করেন।

 

কে এই

 

ভগবান শ্রী রাজনীশ

১৯৩১ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাইজান জেলার নরসিংহপুরে জন্ম নেওয়া ভগবান শ্রী রাজনীশের প্রকৃত নাম চন্দ্রমোহন জৈন। রাজনীশ ছিল তার উপনাম। ভক্তরা তাকে ওশো কিংবা আচার্য রাজনীশ নামেও চেনে। ভারতীয় গুডম্যান খ্যাত ভগবান রাজনীশকে তার ভক্তরা সাক্ষাৎ ভগবান বলে মনে করত। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন বিতর্কিত এবং রহস্যময় গুরু। ভক্তরা তাকে আধ্যাত্মিক মানুষ বলেও মনে করত। ভগবান শ্রী রাজনীশ তার মায়ের পিতামহের বাড়িতে এক বস্ত্র ব্যবসায়ীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১১ সন্তানের মধ্যে রাজনীশ ছিলেন সবার বড়। তার বাবা ছিলেন বাবুলাল এবং মা ছিলেন সরস্বতী জৈন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দর্শন ভারতের সাওগড় বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে। এরপর দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন রায়পুর সংস্কৃত কলেজ এবং পরবর্তীতে জাবালপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপনাকালেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। কঠোর সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতার মাধ্যমে তুলে ধরেন সমাজতন্ত্র, মহাত্মা গান্ধী, আনুষ্ঠানিক ধর্ম, প্রথাগত যৌনচর্চা প্রভৃতিসহ তার নিজস্ব ভাবনা বা দর্শন। অনেকেই তাকে বিশ শতাব্দীর দার্শনিক বলে থাকেন। কিন্তু তার তৈরি আশ্রমে উদ্দাম যৌনতার কারণে তিনি ব্যাপক আলোচিত এবং সমালোচিত হন। তার সম্পর্কে খ্যাতিমান লেখক ক্রিস্টোফার ক্যাডলার, ধর্মগুরু ইউজি কৃষ্ণমূর্তি প্রমুখ ব্যক্তিত্বের যেমন বিরূপতা রয়েছে, তেমনি তার দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রশংসাও করেছেন— খুশবন্ত সিং, জার্মান দার্শনিক পিটার স্লোটারডিজক, জালালউদ্দীন রুমীর অনুবাদক কোলেম্যান বার্কস, মার্কিন লেখক টম রবিনস প্রমুখসহ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। তিনি ছিলেন মূলত মুক্ত চিন্তক। জীবদ্দশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যাখ্যাত এবং দেশি-বিদেশি লেখক, সমালোচক ও ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে বিপুল উপেক্ষা জুটেছে ভগবান শ্রী রাজনীশের। অতঃপর বিখ্যাত ব্যক্তিদের বেলায় যা ঘটে; ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি রাজনীশের মৃত্যুর পর তিনি রাতারাতি ভারতসহ সারাবিশ্বে মহানায়ক বনে যান। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি।

 

তার যত ভণ্ডামি

 

‘‘জীবনের দর্শনচ্যুত হয়ে অতলে তলিয়ে যেতে থাকে কেউ কেউ। নিজেকে তখন সহায়হীন মনে হয়। ঠিক এমন মুহূর্তে এক চিলতে আলোর দেখা পেলে মানুষ পায় বাঁচার আশা। সময়ে সময়ে এমনি আলোর শিখা হাতে হাজির হন কিছু স্বঘোষিত গুরু শ্রেণির ব্যক্তি। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের থাকে অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করা সেসব গুরুর ভণ্ডামি বেরিয়ে আসে লোকসম্মুখে।

 

মানুষ নিজ জ্ঞানে যে নীতিকে শ্রেষ্ঠ মেনে জীবন বাঁধে তাকে অনেকেই ধর্ম বলে। তার ওপর সে ধর্ম যদি যৌনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তবে বুঁদ হওয়ার বাকি থাকে না কিছুই। যে নীতি কারও ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয় তাতে শুধু যৌনতা-মাখা বাণী দেওয়া নয়, যৌনতাকে উপভোগ্য করতে প্রতিটি বাঁকের বিশদ বর্ণনা এবং সবকিছুর বন্দোবস্তও স্বয়ং গুরু করে দিচ্ছেন তখন তা কামবুভুক্ষু মানুষকে টেনে আনবেই। ভগবান শ্রী রাজনীশ ওরফে, ‘সেক্সগুরু’ ওশো ছিলেন তেমনি একজন গুরু। গ্রিক ফিলোতেস, রোমান কিউপিড, হিন্দু মদনদেব কেউই কলির এই ভগবানের কাছে কিছু নন! অপার যৌনতাই ছিল রাজনীশের মতে মুক্তির মূলমন্ত্র। কোনো ঢাকঢাক-গুড়গুড় পছন্দ করতেন না তিনি। তিনি স্পষ্টই বলতেন, ‘আই অ্যাম অ্যা স্পিরিচুয়াল প্লেবয়! ইজ দেয়ার সামথিং রং?’ ১৯৭০ থেকে ১৯৭৪ মুম্বাই, তারপর সাত বছর পুনেতে তার অবস্থান। তার এমন বাণীর প্রচারে ক্রমশ আশ্রমের পরিধি বাড়ছিল, যুক্তরাজ্য আর মার্কিন অনুগামীর সংখ্যাও বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে। শোনা যায় এ সময় থেকেই তার বক্তৃতায় নাকি দার্শনিক ব্যাখ্যার বদলে ক্রমশ জায়গা করে নিতে থাকে ‘নোংরা’ চুটকি। আধ্যাত্মিকতা আর যৌনতার ককটেল যে পাশ্চাত্যের এসব অনুগামীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষক বিজ্ঞাপন, তা তিনি ভালোই বুঝে গিয়েছিলেন। ভক্তদের কল্যাণে ১৯৮১ সালে রাজনীশের পদধূলি পড়ল মার্কিন মুল্লুকে। ওরেগনে গড়ে উঠল নতুন আশ্রম ‘রাজনীশপুরম’।

তারপর যত ভণ্ডামি কর্মকাণ্ড রাজনীশপুরমেই। কখনো হালকা সুর, কখনো হার্ড মিউজিকের সঙ্গে উত্তাল নাচ। কখনো বক্তৃতা, কখনো অনুগামীদের কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে প্রশান্তির তরঙ্গ প্রেরণ। তার আশ্রমে ভিড় বাড়তে থাকা এসব ভক্তের কর্মকাণ্ড দেখে লোকে বলতে লাগল রাজনীশের আশ্রম যৌনতার মুক্তাঞ্চল। যে খুশি, যার সঙ্গে খুশি, যখন খুশি, যেভাবে খুশি সঙ্গম করতে পারত! সেখানে যে কেউই চাইলে মাসে নব্বই জনের সঙ্গেও নাকি সঙ্গম করতে পারত! এসব অভিযোগ তার দিকে ছুটে এলে, তিনি হাসিমুখে বলে গেছেন ‘লেট সেক্স বি আ প্লেফুলনেস, অ্যা ফান। আফটার দি ইনভেনশন অব পিল, ইটস নট অ্যা প্রবলেম।’ শুধু সেক্সের অভয়াশ্রম নয়, তার আশ্রম ছিল নেশার আখড়া হিসেবে অভিযুক্ত। নেশার পক্ষেও ছিল তার স্পষ্ট অবস্থান। তার ভাষ্যটা এরকম— ‘ইফ ইউ ক্যান নট প্রোভাইড মেডিটেশন, ইউ শুড প্রোভাইড মেডিসিন’। রাজনীশ মনে করেন, প্রতিটি হাসপাতালে একটি ঘর থাকা উচিত যেখানে মানুষ নেশা বা ড্রাগস নিতে পারে। সব সরকারেরই দায়িত্ব প্রত্যেকের জন্য একটু প্রশান্তির ব্যবস্থা করা। রাজনীশপুরমে মাদক আর নেশাদ্রব্যের পাশাপাশি ছিল অগাধ মার্কিন ডলারের আনাগোনা। সাংবাদিকরা তার নামই দিয়েছিলেন ‘রোলস রয়েস গুরু’! যারা তার ‘নব্য সন্ন্যাস’-এ দীক্ষা নিতেন, তাদের সৌজন্যে রাজনীশের ব্যক্তিগত রোলস রয়েসের সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছিল নিরানব্বইতে! সবার সমর্থন পেয়ে অতি সাহসী হয়ে মানুষ মারার খেলায় সচেষ্ট হয়ে পড়েছিলেন তিনি এবং তার ডান হাত মা আনন্দ শিলা। ততদিনে ওরেগন প্রদেশের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে রাজনীশ-ভক্তদেরই হাতে। কিন্তু সেখানকার স্থানীয়রা উড়ে এসে জুড়ে বসা এই সন্ন্যাসীদের কাণ্ডকারখানা দুচক্ষে দেখতে পারতেন না। আর ঠিক তখনই মার্কিন কাউন্টি নির্বাচন। অতএব রাজনীশপুরমের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গেলে চাই চূড়ান্ত ক্ষমতা নিজেদের প্রার্থীকে জেতাতে হবে, বিরোধীরা যাতে ভোট দিতে যেতেই না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে ফোনে আড়িপ াতা, ভোট জালিয়াতি, অগ্নিসংযোগসহ গর্হিত নানা কাজ তার মাধ্যমে হয়। এ ছাড়াও খাবারে বিষ মিশিয়ে ১৯৮৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ছড়ালো বিষ স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া। বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন ৭০০-এর বেশি মানুষ। শুরু হলো তদন্ত। এগুলো প্রকাশ পাওয়ার পর ১৯৮৫ সালে রাজনীশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। মার্কিন মুল্লুকে ভগবানের সাজানো বাগান শুকাতে থাকে। খুব দ্রুত নিজের সবকিছু গুটিয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। রাজনীশের এত এত ভণ্ডামি সবার সামনে উঠে এলেও তার গুণের প্রশংসা করেছেন মনমোহন সিং, ম্যাডোনা, কপিল দেব, টম ক্রুজ, দালাইলামা এমনকি ফেদেরিকো ফেলিনি। পঞ্চান্নটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে রাজনীশের বই। মৃত্যুর পরও পুনে তার গড়ে তোলা আশ্রম রমরমিয়ে চলছে এখনো। তবু তার এসব কেচ্ছা-কাহিনীর দাগ কি মুছে গেছে এতটুকু? ‘গুরু’ হয়েছেন বটে, ‘ভগবান’ কি হতে পেরেছেন জাবালপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের সাবেক অধ্যাপক শ্রী চন্দ্রমোহন জৈন?

 

সুন্দরী বিবেকের আত্মহত্যা

সুন্দরী বিবেক ছিলেন ভগবান রাজনীশের আমেরিকান ভক্ত। ১৯৯০ সালে এই ভক্তের হঠাৎই মৃত্যু হয়। তবে সংবাদমাধ্যমের ধারণা, সুন্দরী বিবেক আত্মহত্যা করেছেন। যদিও কোনো শিষ্যই এই মৃত্যুতে মারাত্মক ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেনি কিংবা আত্মহত্যার এই তত্ত্বকে প্রমাণ করার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণও মেলেনি। তবে এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য সবাই রাজনীশকে দায়ী করেছেন। অনেকে মনে করেন, বিবেকের সঙ্গে রাজনীশের সম্পর্ক ছিল।

আবার সর্বাধিক প্রেম আর অতিরিক্ত যৌনতার জন্যই সুন্দরী বিবেক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন। তবে কিছু সূত্র থেকে উঠে আসে সেই আত্মহত্যার খণ্ডচিত্র। মৃত্যুর এক মাস আগে রাজনীশের ভ্রমণের সময় মুম্বাইয়ের হোটেলে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন দ্য বিউটিফুল খ্যাত সুন্দরী বিবেক। আর বিবেক চেয়েছিলেন রাজনীশের জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতার আগেই নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে। এর আগেও এই ভক্ত ওরেগনের আশ্রমে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। শেষ নিঃশ্বাসের মুহূর্তে বিবেক রাজনীশের কাছে বলেছিলেন— ‘আমাকে যেতে দিন। আমার শরীর আমার জন্য নরকে পরিণত হয়েছে। কথিত আছে, রাজনীশের এসব অবৈধ কার্যকলাপের একমাত্র প্রমাণ ছিল রাজনীশের একান্ত অনুসারীরা। সুন্দরী বিবেকও ছিলেন সেই অনুসারীদের একজন। হয়তো এসব অপকর্ম থেকে মুক্তি পেতেই আত্মহত্যা করেন বিবেক।

 

 

গুরুর ডান হাত শিলা

ভগবান রাজনীশের সঙ্গে মা আনন্দ শিলার রয়েছে অনেক স্মৃতিকথা। শিলা রাজনীশকে পছন্দ করতেন বলেও অনেকে মনে করতেন। এই অন্ধ ভক্তকে আধ্যাত্মিকতা রপ্ত করিয়েছিলেন ভগবান রাজনীশ। শিলা জন্মগ্রহণ করেন শিলা অম্বালাল প্যাটেলে।

বারোদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব এবং আমেরিকার নিউজার্সির মানক্লেয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করেন শিলা। স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সিরামিক নিয়ে পড়াশোনা করেন। রাজনীশের সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা ছিল শিলার বাবার মাধ্যমে। শিলার বাবা তার মেয়েকে রাজনীশের কাছে পেশ করেন। এরপর থেকেই নিজেকে ভালোভাবে উৎসর্গ করেন শিলা। রাজনীশ ১৯৮১ সালে আমেরিকার ওরেগনে আশ্রম গড়ে তোলেন এবং সেখানে মা আনন্দ শিলা ছিলেন ব্যক্তিগত সহকারী। রাজনীশপুরের দ্বিতীয় হুকুমদাতাও মানা হতো তাকে। কিছু কিছু জায়গায় শিলা ছিলেন গুরুর যোগ্য শিষ্য। ওরেগনের সেই বিষক্রিয়ায় রাজনীশের সঙ্গে শিলারও সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল।

আর এজন্য রাজনীশের সঙ্গে মা আনন্দ শিলাকেও গ্রেফতার করেছিল ওরেগন পুলিশ। আদালতে রাজনীশপুরের সন্ন্যাসীরা তাদের অপকর্মের কথা স্বীকার করলে তাদের আদালত শাস্তিস্বরূপ দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়। ভগবান রাজনীশের অনেক কুকর্মের রাজসাক্ষী ছিলেন এই মা আনন্দ শিলা। অনেকে শিলাকে গুরুর রক্ষী মনে করত। গুরুর সঙ্গে শিলার অবৈধ সম্পর্কও ছিল বলে অনেকেই মনে করতেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর