রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা

তানিয়া তুষ্টি

প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা

ভারতীয় উপমহাদেশে আজও  সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী নামটি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি এখনো অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণীয় ব্যক্তিত্ব। ভারতের প্রথম ও এ পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রীও তিনি। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সবাইকে মুগ্ধ করে। বিভিন্ন খাতে অবদান, তার স্বীকৃতি ও অর্জন নেহাতই কম নয়। রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠায় তার আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না। প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের প্রতি ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধুবৎসল। তার প্রমাণ মেলে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সংকটকালে তার সাহায্য-সহযোগিতা ও  উৎসাহের মাধ্যমে। এ ছাড়া তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিচক্ষণতা বিশ্ববাসীকে চিনিয়ে দিয়েছিল এক দাপুটে রাজনীতিক ইন্দিরা গান্ধীকে।

 

ইন্দিরা গান্ধী

ভারতের প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর বিশিষ্ট নেহেরু পরিবারে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মেয়ে তিনি। বাবা মেয়েকে ‘প্রিয়দর্শিনী’ নামেই ডাকতেন। তার দাদা মতিলাল নেহেরু ছিলেন প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা। সে কারণে এক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার সুযোগ পান। ১৯৬৬ থেকে ’৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরে ১৯৮০ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দিরা। শৈশবে তিনি ‘বাল চরকা সঙ্ঘ’ ও ১৯৩০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে কংগ্রেসকে সাহায্য করার জন্য ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বানর সেনা’। ইন্দিরা পড়াশোনা করেন সুইজারল্যান্ডের বেকস-এ ইকোলে নোভেল, জেনেভার ইকোলে ইন্টারন্যাশনাল, পুণে ও বোম্বাইয়ের পিউপিলস ওন স্কুল, ব্রিস্টলের ব্যাডমিন্টন স্কুল, শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী এবং অক্সফোর্ডের সামারভিল কলেজে। ১৯৩৬ সালে ইন্দিরার মা কমলা নেহেরু মারা যাওয়ার পর তিনি একা হয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালে অক্সফোর্ড থেকে ফিরে এসে ইন্দিরা গান্ধী বাবার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এ কারণে তাকে কারাবন্দী করা হয় ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরে। ইন্দিরার বয়স যখন মাত্র চার তখনই তার বাবা-দাদাকে কারাবন্দী হতে হয় ব্রিটিশবিরোধিতার জন্য। ইন্দিরা গুটিয়ে যান নিজের মধ্যে। বাবার অফিসে অনিয়মিতভাবে সহকারীর কাজ করে আসছিলেন। ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। তখন ইন্দিরা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর হঠাৎ মৃত্যুতে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি কে কামারাজ এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

 

পারিবারিক জীবন

সাংবাদিক ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে ১৯৪২ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বিয়ে হয়। ফিরোজ গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদদের একজন এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক। তিনি ১৯৬০ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ইন্দিরা ও ফিরোজ দম্পতির দুটি সন্তান জন্ম হয়। দুটিই ছেলে। বড় ছেলে রাজীব গান্ধী ও ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী। রাজীব ছিলেন পেশাদার বিমানচালক। কিন্তু সঞ্জয় অল্প বয়সেই কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ইন্দিরাও ছেলে সঞ্জয়ের মধ্যে অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা দেখতে পান। একটা সময় দলে সঞ্জয় হয়ে ওঠেন মায়ের থেকেও ক্ষমতাশালী। মায়ের বিরুদ্ধাচরণের বেশকিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। এমনকি শোনা যায়, ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ২৩ জুন, ১৯৮০ সালে নতুন দিল্লির কাছে সফদর জং এয়ারপোর্টের কাছে জরুরি অবতরণ করতে গিয়ে নিহত হন সঞ্জয় গান্ধী। বিমানে থাকা বোমা বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। সঞ্জয়ের স্ত্রী মেনকা গান্ধী। তাদের ছেলে বরুণ গান্ধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ১৯৯১ সালের ২১ মে মাদ্রাজে গুপ্ত ঘাতকের হাতে প্রাণ যায় রাজীব গান্ধীর। বর্তমানে রাজনীতিতে আছেন তার স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী, ছেলে রাহুল গান্ধী। তাদের অন্য সন্তান প্রিয়াংকা গান্ধী।

 

নেহেরু থেকে গান্ধী

অনেকেই ইন্দিরা গান্ধী ও মহাত্মা গান্ধীকে ভেবে থাকেন রক্তসম্পর্কীয়। আসলে তা নয়। ইন্দিরা গান্ধীর বাবা জওহরলাল নেহেরু এবং মা কমলা নেহেরু। ইন্দিরা গান্ধীর নামও ছিল ইন্দিরা নেহেরু। তাহলে তিনি ইন্দিরা গান্ধী হলেন কীভাবে? ১৯১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বোম্বেতে একটি পার্সি পরিবারে ফিরোজ জেহাঙ্গির খান গান্ধী বা ফিরোজ গান্ধী নামে একটি ছেলের জন্ম হয়। ছেলেটির পূর্বপুরুষ পারস্য থেকে ভারতে এসে বসবাস করে। তারা ছিল পার্সি বা জরস্ত্রিয়ান ধর্মের অনুসারী। ফিরোজ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পার্টির একজন নবীন সদস্য ছিলেন। এলাহাবাদে পার্টির কাজের সুবাদে ইন্দিরা ও তার মা কমলা নেহেরুর সঙ্গে তার বন্ধত্ব হয়। ফিরোজ নেহেরু পরিবারের খুব কাছের একজন হয়ে যান। ১৯৩৩ সালে তিনি ইন্দিরাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, তখন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কমলা নেহেরু। ইন্দিরার বয়স তখন মাত্র ১৬। ১৯৩৬ সালে কমলা নেহেরু মারা গেলে ইন্দিরা খুব একা হয়ে যান। বাবা জওহরলাল ইন্দিরাকে অক্সফোর্ডে পাঠান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার জন্য। সে সময় ফিরোজ গান্ধীও অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলেন। সেই সময়টাতেই ইন্দিরা ও ফিরোজ খুব ঘনিষ্ঠভাবে একে অন্যের কাছে চলে আসেন। সে সময়ই ইন্দিরা বাবা জওহরলাল নেহেরুকে প্রায় ১০০ চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রতি চিঠিতেই একটি মাত্র বাক্য লেখা থাকত! কী হতে পারে সেই বাক্য? বাক্যটি হলো— ‘বাবা! আমি ফিরোজকে ভালোবাসি।’

হতভম্ব জওহরলাল কন্যার এই ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালের মার্চে নিজেরা বিয়ে করেন তারা। বিয়েটি হয় হিন্দু ধর্মমতে। ফিরোজ গান্ধীকে বিয়ের পরই ইন্দিরা নেহেরু হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী। মহাত্মা গান্ধীর দ্বারস্থ হয়েও জওহরলাল নেহেরু তাদের বিয়ে ঠেকাতে পারেননি। পরে অবশ্য তিনি তাদের সাদরে মেনে নিয়েছিলেন।

 

রাজনৈতিক অবদান

নেহেরু পরিবার অনেক আগে থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। ইন্দিরা গান্ধী চার বছর বয়স থেকেই বাবা দাদার কারাবন্দীর কালীন উত্তেজনা পেরিয়ে এসেছেন। এমন সংকটকালীন জীবন অববাহিকায় মহাত্মা গান্ধী ইন্দিরার রাজনৈতিক জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর বাবা জওহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হন। তখন থেকেই ইন্দিরা ছায়ার মতো বাবার পাশে পাশে থাকতেন। ১৯৩৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। রাজনৈতিক কারণেই কারাবন্দী হয়ে ৮ মাস বন্দীও থেকেছেন। ১৯৫০ সাল থেকে তিনি  জওহরলাল নেহেরুর অফিস সহকারী পদে অবৈতনিক কাজ করে আসছিলেন। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন। ১৯৬৬ সালে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক ভোট  পেয়ে ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি দেশে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ জরুরি আইন জারি করেন। এ জন্য সমালোচিতও হন তিনি। ইন্দিরা গান্ধী এরপর ১৯৮০ সালে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে বিজয়ী হন। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ বছর ভারতে প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি ছিলেন তুখোড় রাজনীতিবিদ। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নিজের দেহরক্ষীর গুলিতেই নির্মমভাবে মৃত্যু বরণ করতে হয়।

 

অনন্য গুণ

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ধ্যান-ধারণার গঠন রাজনীতিকেন্দ্রিক। তাই তো আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো করে সাধারণ চিন্তার ফুরসত ছিল না ইন্দিরা গান্ধীর। তবে হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি লিখে গেছেন বেশকিছু গ্রন্থ। ‘দ্য ইয়ার্স অফ চ্যালেঞ্জ’ (১৯৬৬-৬৯), ‘দ্য ইয়ার্স অফ এনডেভার’ (১৯৬৯-৭২), ‘ইন্ডিয়া (লন্ডন)’ (১৯৭৫) এবং ‘ইন্ডে (লুসানে)’ (১৯৭৯) নামের সংকলন গ্রন্থগুলোয় তার বহু লেখা ও বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ভাষণ স্থান পেয়েছে। দেশ-বিদেশে তিনি একাধিকবার সফর করেছেন। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, চীন, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বিভিন্ন সময়ে তিনি সফর করেন। সরকারিভাবে সফর করেছেন ফ্রান্স, তৎকালীন দুই জার্মানি, গুয়ানা, হাঙ্গেরি, ইরান, ইরাক ও ইতালি। এ ছাড়া আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, কানাডা, চিলি, চেকোস্লোভাকিয়া, বলিভিয়া এবং মিসরেও তিনি সফর করেন। ইন্দোনেশিয়া, জাপান, জ্যামাইকা, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, নাইজেরিয়া, ওমান, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, সিরিয়া, সুইডেন, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, ত্রিনিদাদ-টোবাগো, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ব্রিটেনসহ আরও অনেক দেশ ছিল তার সফর তালিকায়।

তার যত সম্মাননা

বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট ডিগ্রিতে সম্মানিত করেছে। ছাত্রজীবনের উজ্জ্বল সফলতার সুবাদে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে বিশেষভাবে সম্মান জানিয়েছে। একইভাবে কর্মজীবনেও তিনি বহু কৃতিত্ব ও সাফল্যের নজির রেখে গেছেন। ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে ‘ভারতরত্ন’ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেন ‘মেক্সিকান অ্যাকাডেমি পুরস্কার’ (১৯৭২)। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরাকে দেওয়া হয় এফ এ ওর দ্বিতীয় বার্ষিক পদক। তিন বছর পর ১৯৭৬ সালে লাভ করেন নাগরী প্রচারিণী সভার সাহিত্য বাচস্পতি (হিন্দি) পুরস্কার। ১৯৫৩ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাদার্স অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত হন। কূটনীতিতে বিচক্ষণতার জন্য ইতালির আইবেলা ডি এস্ট পুরস্কার ও ইয়েল ইউনিভার্সিটির হোল্যান্ড মেমোরিয়াল প্রাইজ পান। ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক ওপিনিয়নের এক জনমত সমীক্ষার নিরিখে ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে পরপর দুবার ‘বিশ্বের সেরা মহিলা’ খেতাবে তাকে সম্মানিত করা হয়। একইভাবে ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্যালাপ পোল সার্ভের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত ব্যক্তি হিসেবে তাকে সম্মান জানানো হয়। শুধু মানুষ নয়, প্রাণী ও জীবজন্তুর প্রতি তার বিশেষ যত্নের স্বীকৃতিতে আর্জেন্টাইন সোসাইটি ১৯৭১ সালে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে তাকে।

ইন্দিরার যত প্রেম

ভারতীয় উপমহাদেশের শক্তিশালী নারী রাজনীতিবিদ ইন্দিরা গান্ধী। নেতৃত্বগুণে এ উপমহাদেশের কোটি মানুষের হৃদয়ে তিনি আজও অমলিন। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সফলতা লাভকারী এই নারী তরুণ বয়সে ব্যক্তিজীবনের নানা কারণে আলোচিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে বিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত আর একসঙ্গে থাকা হয়নি। বিয়ের সম্পর্কছেদের পর তিনি প্রেমে পড়েন তার বাবার সচিব এম ও মাথাইয়ের। মাথাইয়ের সঙ্গে প্রেম চলে একটানা প্রায় ১২ বছর। এমনকি এ সময় একবার গর্ভবতীও হয়েছিলেন ইন্দিরা। মাথাইয়ের আত্মজীবনী থেকে ‘রিমিনিসেন্স অব দ্য নেহেরু এজ’ অধ্যায় থেকে তথ্যগুলো মেলে। এরপর জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীনেশ সিংয়ের সঙ্গে প্রেমে মজেন ইন্দিরা।  দীনেশ প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী ভবনে এসে ইন্দিরার সঙ্গে গল্পে মশগুল থাকতেন। সেখানেই তাদের প্রেমের সূত্রপাত। এ ছাড়া জানা গেছে, ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালে মুহাম্মদ ইউনুস নামে আরও একজনের সঙ্গে প্রেমে জড়ান ইন্দিরা। কে এন রাও ‘নেহেরু ডায়ন্যাস্টি’ বইতে লিখেছেন, ‘ইন্দিরার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী মূলত ইন্দিরা-ইউনুসের ছেলে।’ ব্যক্তিগত জীবনের এসব ঘটনার কোনোটিই ইন্দিরার রাজনৈতিক জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তিনি আজও ভারতের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিপক্ষে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের আশ্রয়দান, অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিসংগ্রামকে সফল করতে ভূমিকা রেখেছেন। পাশাপাশি বিশ্বের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন ও শরণার্থী সমস্যাটি তুলে ধরেন। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমতও গড়ে তুলেছিলেন। মিত্রবাহিনীতে থাকা ভারতীয় সেনাদের তিনি যে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন। ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়। এর আগে ২৭ মার্চ ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় এক প্রস্তাবে অবিলম্বে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। এরপর ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানায়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তখন বিচক্ষণতার সঙ্গে ধীরে চলো নীতি ও কূটনৈতিক কৌশলের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ১৩ এপ্রিল বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘পূর্ববাংলায় যা ঘটেছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকবে না।’ ৩০ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেন। পরে ১৭ মে ইন্দিরা গান্ধী যান পশ্চিমবঙ্গে। সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল সেখানেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, শরণার্থী বিষয়ে কেন্দ্র তাদের পাশে আছে ও থাকবে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে শরণার্থী আশ্রয় নেয় প্রায় ১ কোটি। ভারতীয় কমান্ডারদের প্রতি ইন্দিরার আদেশ ছিল, ‘আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি কামানগুলো নিস্তব্ধ না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের অভিযান চলবে।’ এর পরপরই ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী মিলিতভাবে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করতে থাকে। ৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এর ১০ দিনের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ছিনিয়ে আনে রাতের বৃন্ত থেকে ফুটন্ত সকাল।

 

হত্যাকাণ্ড

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। ১ নম্বর আকবর রোডের অফিসের কাছের ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাসভবনের বাগানের একটি পথ দিয়ে হাঁটছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি যখন সতবন্ত সিং ও বেয়ন্ত সিংয়ের প্রহরাধীনে উইকেট গেট দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন তারা তার ওপর গুলি ছোড়েন। সাব-ইন্সপেক্টর বেয়ন্ত সিং সাইড আর্ম থেকে তিনটি গুলি ছোড়েন ইন্দিরা গান্ধীর তলপেটে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সতবন্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলি করার পর উভয়েই তাদের অস্ত্র হাত থেকে ছুড়ে ফেলেন। বেয়ন্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই প্রিয় দেহরক্ষী। তাকে তিনি চিনতেন ১০ বছর ধরে। ঘটনার সময় অন্য খুনি সতবন্ত সিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে তাকে ইন্দিরার প্রহরী নিয়োগ করা হয়। ১৯৭০-এর দশকে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত হাজার হাজার শিখকে আটক করে কারাগারে রাখা হয়। তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র শিখেরা মাঝেমধ্যেই সন্ত্রাসী হামলা চালাত। ভারতীয় সরকারের কাছে এরা ছিল সন্ত্রাসী। ১৯৮৪ সালের জুনে ইন্দিরা গান্ধী আদেশ দেন শিখদের স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান চালিয়ে এই মন্দিরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী-মুক্ত করতে। কারণ বলা হচ্ছিল, এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখেরা স্বর্ণমন্দিরে অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছে। এই সামরিক অভিযানের নাম ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। এরই জেরে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রাণ হারাতে হয়। ওই বছর শিখবিরোধী দাঙ্গা চলে ভারতে। শিখ ধর্মাবলম্বী দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করার পর এর প্রতিক্রিয়ায় এ দাঙ্গা বাধে। এক হিসাবে এ দাঙ্গায় ৮ হাজারের মতো লোক নিহত হয়। শুধু দিল্লিতেই নিহত হয় ৩ হাজার। দাঙ্গা চলে ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর