বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফুলের গ্রাম যশোর

ফুলের গল্প

সাইফুল ইসলাম, যশোর

ফুলের গ্রাম যশোর

কনকনে শীতের সকালে গদখালী বাজারে রঙিন গ্লাডিওলাস, চলছে দরদাম

মানব সভ্যতা আর ফুলের অগ্রযাত্রা প্রায় একই সঙ্গে এগিয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। আর তাই পশ্চিম এশিয়ায়ই প্রথম ফুলের চাষ শুরু হয় বলে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে ধারণা পাওয়া যায়। সাড়ে চার হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতার স্মারক মোহেঞ্জোদারোতে মাটির পাত্রে পদ্ম ফুলের নকশা দেখতে পাওয়া যায়। শাপলা আর পদ্ম ফুল তো ছিল মিসরীয়দের রাজশক্তির প্রতীক। সনাতন ধর্মে দেবতাকে পূজার অর্ঘ্য দিতে ফুলের ব্যবহার অপরিহার্য। আর আধুনিককালের ফুলসজ্জায় জাপানিদের ইকেবানার খ্যাতি তো বিশ্বজুড়ে।

১৬ শতাব্দীতে কিছু বিজ্ঞানী অলঙ্কারিক ফুল নিয়ে গবেষণা শুরু করলে ফুল চাষ অন্যরকম মাত্রা পেতে থাকে। উদ্যানতত্ত্বের আওতায় ফুল চাষ বা ফ্লোরিকালচার বিকশিত হতে থাকে। ১৬ আর ১৭ শতাব্দীজুড়েই গ্রিনহাউস ধারণার মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসে কাট-ফ্লাওয়ার চাষ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বসন্তের ফুল শীতের শুরুতেই ফোটাতে শুরু করে তারা। ১৭ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইউরোপিয়ানদের অনুকরণে আমেরিকায়ও কাট-ফ্লাওয়ার চাষ শুরু হয়।

তবে সে সময় পরিবহন ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। ফলে চাষবাস যা হতো, তা সীমিত পরিসরেই। ইউরোপিয়ানরা যখন এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন তাদের মাধ্যমে ফুল চাষও ছড়িয়ে পড়ে। ফুল চাষ কেবল গ্রিনহাউসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, অন্য ফসলের মতো খোলা মাঠে এর চাষ শুরু হয়। এরপর আকাশপথে পরিবহন এবং ফ্রিজিং ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য হওয়া শুরু করলে ফুল চাষ ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করতে থাকে। যেখানেই ফুল চাষের উপযোগী আবহাওয়া ও মাটি পাওয়া যায়, সেখানেই ফুল চাষ শুরু হয়। এরপর এসব ফুল উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রেডিং, প্যাকেজিং ও সংরক্ষণ করে সেগুলো বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আসলে পুরোপুরি বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ফুল চাষের ব্যাপক অগ্রযাত্রা হয় আশির দশকে। সে সময় বিশ্বে ফুল বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল দেড় হাজার কোটি ডলার। নব্বইয়ের দশকে এসে এর পরিমাণ দুই হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর এখন এর পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

বর্তমানে বিশ্বে যে পরিমাণ ফুল উৎপাদন হয় তার ৬৮ শতাংশ হল্যান্ড একাই করে। এই ফুল থেকে তারা বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি আয় করে থাকে; যা তাদের মোট রপ্তানি আয়ের ৫ ভাগের এক ভাগ। বিশ্বে মোট উৎপাদিত ফুলের ১০ শতাংশ উৎপাদন করে জার্মানি ও কলম্বিয়া, ৬ শতাংশ উৎপাদন করে ইসরায়েল ও ইকুয়েডর। থাইল্যান্ড, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও আরও কিছু দেশ মিলে বাকি ফুল উৎপাদন করে।

থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া প্রতি বছর ১০ মিলিয়ন ডলারের ফুল রপ্তানি করে থাকে। থাইল্যান্ড তো অর্কিড চাষকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। প্রতি বছর বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশে তারা ২০০ কোটি টাকার অর্কিড রপবতানি করে থাকে। (তথ্যসূত্র : বিভিন্ন ওয়েবসাইট, এ ব্রিফ হিস্টোরি অব কাট-ফ্লাওয়ার প্রোডাকশন)।

 

সামনে অপার সম্ভাবনা

ফুলের রাজ্য গদখালীতে একটি ফুল গবেষণা কেন্দ্র করার দাবি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছিলেন ফুলচাষিরা। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম জানান, সরকার ইতিমধ্যেই তাদের এ দাবি মেনে এর জন্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। গদখালীর রজনীগন্ধা কোল্ড স্টোরেজের পাশে ৫০ একর জমিও বাছাই করা হয়েছে এ জন্য। তাড়াতাড়িই এর কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ফুল ও ফুলবীজ সংরক্ষণের জন্য স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের যে দাবিও তারা করে আসছিলেন, সেখানেও সাড়া দিয়েছে সরকার। গদখালীর পানিসারা গ্রামে ফ্লাওয়ার প্রসেসিং ইউনিট অ্যান্ড মার্কেট নামে একটি প্রকল্প পাশ হয়েছে। এ জন্য এক একর জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছে। টেন্ডারও হয়ে গেছে। আবদুর রহিম বলেন, এগুলো হয়ে গেলে এ অঞ্চলে ফুল চাষে অভাবনীয় অগ্রগতি হবে।

 

ফুলের রাজধানী গদখালী

যশোর শহর থেকে ঐতিহাসিক যশোর রোড (যশোর-বেনাপোল হাইওয়ে) ধরে বেনাপোলের দিকে ১৮ কিলোমিটার গেলেই গদখালী বাজার। পানিসারা, হাড়িয়া, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া, মাটিকুমড়া, বাইসা, কাউরা, ফুলিয়াসহ অসংখ্য গ্রামের মাঠজুড়ে চোখে পড়বে কেবলই ফুলের বাগান। রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, রথস্টিক, জিপসি, গ্যালেডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ দেশি-বিদেশি নানারকম ফুল। ১৯৮২ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার এই গদখালী থেকেই শুরু হয়েছিল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষ। এখন ফুল চাষ ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের শার্শা, মণিরামপুর, কেশবপুর উপজেলার অসংখ্য গ্রামে। এই গ্রামগুলোতে আধুনিক পদ্ধতিতে সারা বছরই নানা জাতের ফুল উৎপাদন করা হলেও সবচেয়ে ভালো মানের ফুল পাওয়া যায় ডিসেম্বর জানুয়ারিতে। আর সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয় ফেব্রুয়ারিতে। দেশে তাজা ফুলের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগই যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় ৫২টি জেলায় যায় গদখালীর ফুল। সীমিত আকারে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় সাড়ে ১৬০০ হেক্টর জমিতে ফুল চাষ করছেন প্রায় ছয় হাজার চাষি। যশোর জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী এখানে প্রতি বছর ১২০ কোটি পিস ফুল উৎপাদন হয়ে থাকে। ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী এ চাষের সঙ্গে এখন দেশের ৫০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত।

 

প্লাস্টিকের ফুলে সর্বনাশ

রাজধানীর চকবাজারে আমদানি করা প্লাস্টিক ফুলের বাজার গড়ে উঠেছে এবং প্লাস্টিক ফুলের আমদানি ও ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কের মধ্যে আছেন গদখালীর ফুলচাষিরা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাজা ফুলের পরিবর্তে প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। কারণ প্লাস্টিকের ফুল বেশ কয়েকবার ব্যবহার করা যায়, দামেও কম। এমনকি সরকারি অনেক প্রোগ্রামেও প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার হচ্ছে। আর সে কারণেই হুমকির মুখে পড়েছে দেশের উদীয়মান এই ফুল সেক্টর। প্লাস্টিকের ফুল আমদানি বন্ধের দাবিতে ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার ফুলচাষি গদখালীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। ফ্লাওয়ার সোসাইটির পক্ষ থেকেও বিষয়টি কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো সরকারি নির্দেশনা আসেনি।

 

দরকার নীতিমালা

ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, গদখালীতে উৎপাদিত রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা ফুল আন্তর্জাতিকমানের। গ্লাডিওলাস ও রজনীগন্ধার মান ভারতের চেয়ে উন্নত। এখানকার জারবেরার মান চায়নার চেয়ে ভালো। সৌদিআরব, কাতার, দুবাই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ আরও বেশকিছু দেশে এসব ফুল রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এখন সবজি ও পানের সঙ্গে অল্পকিছু ফুল রপ্তানি হয়।

এভাবে খুব বেশি ফুল বাইরে পাঠানো যায় না। শুধু ফুল রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকার যদি আলাদা নীতিমালা করে তাহলে ফুল রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। এ জন্য যেসব দেশে ফুলের চাহিদা রয়েছে সেসব দেশের বাজারের সঙ্গে ফুলচাষিদের সংযোগ করিয়ে দিতে হবে। এ জন্য দূতাবাসগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। ফুল রপ্তানির বিষয়ে আলাদা নীতিমালা করা হলে এই বিষয়গুলোর সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে। আবদুর রহিম বলেন, দেশের মধ্যে ফুল পরিবহন নিয়েও সমস্যা রয়েছে। এখনো সেই আগের মতোই বাসের ছাদে, ট্রাকে কিংবা পিকআপে গদখালী থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুল পাঠানো হয়। এতে অনেক ফুল নষ্ট হয়ে যায়। ফুলের জন্য আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা করা গেলে ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।

 

এবারের নতুনত্ব লং স্টিক রোজ

প্রতি বছরই নতুন নতুন ফুল অথবা পুরনো ফুলের নতুন কোনো জাতের চাষ শুরু করেন গদখালীর চাষিরা। এবার এখানে নতুন চাষ করা হয়েছে বিশেষ ধরনের গোলাপ লং স্টিক রোজ। কেবল গদখালীতেই নয়, বাংলাদেশেই এই প্রথমবারের মতো গোলাপের এ জাতটির চাষ শুরু করেছেন গদখালী এলাকার ইমামুল হোসেন, যা ইতিমধ্যেই বাজারে উঠতে শুরু করেছে। ইমামুল জানান, ভারতের পুনে থেকে চারা এনে ৪০ শতক জমিতে তিনি লং স্টিক রোজের চাষ করেছেন। চারা কেনা, শেড তৈরি, পরিচর্যাসহ এ পর্যন্ত এই খেতের পেছনে তার ব্যয় হয়েছে সাড়ে দশ লাখ টাকা। এরই মধ্যে কয়েকদফা ফুল বাজারে বিক্রি করেছেন। এ ফুল বিক্রি করে এক বছরের মধ্যেই তার সব বিনিয়োগ উঠে আসবে বলে জানান তিনি। ঠিকমতো পরিচর্যা করলে এই খেত থেকে একটানা ১০ বছর ফুল পাওয়া যাবে। এই জাতের গোলাপের বিশেষত্ব সম্পর্কে ইমামুল বলেন, অন্য জাতের গোলাপ ফুল গাছ থেকে তোলার পর যেখানে ৪-৫ দিনের বেশি রাখা যায় না, সেখানে লং স্টিক গোলাপ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত রাখা যায়। এর স্টিক বেশ শক্ত এবং লম্বা হয়, ফলে সহজে ভেঙে যায় না। ফুলের পাপড়িগুলোও বেশ শক্ত। এসব কারণে অন্য জাতের গোলাপ যেখানে ৩ থেকে ৪ টাকায় বিক্রি হয়, সেখানে লং স্টিক রোজ বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়।

কার্নিশন নামে নতুন আরেকটি ফুলের চাষ গদখালীতে শুরুর চেষ্টা করছেন কয়েকজন চাষি। ভারত ও চায়নায় এ ফুলের চাষ আছে। এ ফুলটির চাহিদা রয়েছে সারা বিশ্বেই। ফুলচাষি শের আলী বলেন, লিলিয়াম নামের সুন্দর একটি ফুলের চাষ কয়েকবছর আগে তিনি শুরু করেছিলেন। কিন্তু লিলিয়ামের ওই জাতটি টেকসই ছিল না। পরে হল্যান্ড থেকে লিলিয়ামের একটি ভালো জাতের বীজ আনা হয়েছে। টিস্যু কালচারের জন্য ল্যাবে ওই বীজ দেওয়া হয়েছে।

 

ফুল চাষে জড়াচ্ছেন নারীরাও

পুরুষের পাশাপাশি গদখালী এলাকায় ফুল চাষে এগিয়ে আসছেন নারীরাও। সফলতার উদাহরণও তৈরি করছেন তারা। এমনই একজন হাফিজা খাতুন হ্যাপি। ১৯৯৫ সালে গদখালীর পানিসারা গ্রামের ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। স্বামীর সংসারে এসেই দেখেন অভাব আর অভাব। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস হওয়ায় চাকরি-বাকরির চেষ্টা করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেষমেশ ২০০১ সালে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কাঠা জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এখন তিনি ১০ বিঘা জমিতে নানারকম ফুলের চাষ করছেন। পাশাপাশি করেছেন কমলালেবুর বাগান আর দেশি মুরগির খামার। জমি কিনে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি তৈরি করেছেন। ভারত ও কম্বোডিয়া থেকে ফুল চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, গদখালী এলাকায় হ্যাপির মতো শতাধিক নারী এখন সরাসরি ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ফুল প্যাকেজিং, গ্রেডিং ও মালা গাঁথার সঙ্গে আরও তিন শতাধিক নারী কাজ করছেন। ফুল চাষে আরও বেশি উৎসাহিত করতে নারীদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার বলে মনে করেন আবদুর রহিম। ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস বলেন, ফুল চাষে সংশ্লিষ্ট নারীদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রেও নারীদের বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

 

সময়মতো বীজ লাগানোয় ৬ মাস পর রজনীগন্ধার হাসিতে ভরে ওঠে শের আলীর খেত। কিছু ফুল নিয়ে ছুটলেন ঢাকায়। হাই কোর্ট মাজারের বটতলায় সেগুলো ২০০ টাকায় বিক্রি করেন। শের আলীর মুখে হাসি ফোটে। বাড়াতে থাকেন ফুল চাষ...

গদখালীর শের

নাম তার শের আলী সরদার। তবে যশোরসহ সারা দেশে তিনি শের আলী নামে পরিচিত। ভদ্রতা দেখিয়ে নিজে যদিও স্বীকার করেন না, কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষের পথিকৃৎ তিনিই।

বাবা আবদুর রহমান সরদারের ছিল নার্সারি ব্যবসা। ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামের ‘সরদার নার্সারির’ মালিক। তিন যুগের ব্যবসা। একপর্যায়ে বাবার এ ব্যবসার হাল ধরেন শের আলী। ফলদ ও বনজ বৃক্ষের চারা উৎপাদন করে সুনাম কুড়ান। নার্সারি ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করেন। যশোর-বেনাপোল সড়কের গদখালীতে তৈরি করেন আরও একটি নার্সারি। স্মৃতি রোমন্থন করে শের আলী বলেন, ১৯৮৩ সালের অক্টোবরের কোনো এক দিন তিনি বসেছিলেন এ নার্সারিতে। এরশাদ সরকারের শাসনামলের সেই দিনটিতে ছিল হরতাল। ভারত থেকে বেনাপোল হয়ে দেশে ফেরেন যশোরের নূর ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। হরতাল থাকায় বেনাপোল থেকে তিনি রিকশায় রওনা হন যশোরের পথে। গদখালীতে সরদার নার্সারির সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে শের আলীর কাছে পানি খেতে চান তিনি। ভদ্রলোকের হাতে ছিল গামছায় মোড়ানো ২-৩শ রজনীগন্ধার স্টিক। পানি খাওয়ানোর ফাঁকে কথায় কথায় নূর ইসলাম শের আলীকে বলেন, ‘আপনি তো নার্সারি ব্যবসা করেন। এর পাশাপাশি এই ফুলের চাষ করুন, ভালো লাভ হবে। এসব ফুল আর ভারত থেকে আনতে হবে না। আমিই ভারত থেকে বীজ এনে দেব’। কথা অনুযায়ী নূর ইসলাম এক দিন ২-৩ হাজার টাকায় আড়াই মণ ওজনের এক বস্তা রজনীগন্ধার বীজ এনে দেন শের আলীকে। সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো লাগিয়ে ফেলেন তিনি। কিন্তু শীতকালে বীজ লাগানোয় প্রথম দফায় হতাশ হতে হয় তাকে। পরেরবার সময়মতো বীজ লাগানোয় ৬ মাস পর রজনীগন্ধার হাসিতে ভরে ওঠে শের আলীর খেত। কিছু ফুল নিয়ে ছুটলেন ঢাকায়। হাই কোর্ট মাজারের বটতলায় সেগুলো ২০০ টাকায় বিক্রি করেন।

শের আলীর মুখে হাসি ফোটে। বাড়াতে থাকেন ফুল চাষ। সিঙ্গেল স্টিক রজনীগন্ধার পর নিয়ে আসেন ডাবল স্টিক রজনীগন্ধা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, গাঁদা, লিলিয়াম। তার দেখাদেখি গদখালীর অনেক চাষিই ঝুঁকে পড়তে থাকেন ফুল চাষের দিকে। শের আলীও তাদের সবরকম সহযোগিতা দিতে থাকেন অকাতরে। ফুল চাষ ছড়িয়ে পড়ে ঝিকরগাছার গ্রামে গ্রামে। এক শের আলী থেকে তৈরি হয় কয়েক হাজার শের আলী। ছোট্ট নার্সারি ব্যবসা থেকে কেবল ফুল চাষের মাধ্যমে শের আলী এখন কোটিপতি চাষি। সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে তার লাভ থাকে ২০ লক্ষাধিক টাকা। ফুল চাষের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে ঘুরেছেন বিশ্বের ১৮টি দেশ। দেশ-বিদেশের আরও নতুন নতুন ফুলের জাত এনে দেশে ফুল চাষের ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে চান তিনি। দেশের ফুল সম্রাজ্যের শের হয়েই থাকতে চান আমৃত্যু।

দুই বিঘা জমির ওপর শের আলীর জারবেরা শেড। খেত পরিচর্যা করতে করতে তিনি বলেন, জারবেরা ফুল চাষের জন্য শেড নির্মাণ, চারা ক্রয়, সার, সেচ, পরিচর্যায় প্রতি বিঘায় খরচ হয় ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। তিন মাস পর থেকেই ফুল বিক্রি শুরু করা যায়। তবে ৪ থেকে ৬ মাস পর ভালো ফলন শুরু হয়। এক বিঘা জারবেরা খেত থেকে প্রথম বছরই ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করা যায়। পরের বছর থেকে আয় আরও বাড়ে। শের আলী বলেন, ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে এক বিঘার একটি শেড থেকে একটানা ৫ বছর ফুল পাওয়া সম্ভব।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর