শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বৈচিত্র্যের নববর্ষ

বৈচিত্র্যের নববর্ষ

বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠার একটিই উৎসব, আর তা হলো পয়লা বৈশাখ। যুগের সঙ্গে অনেক কিছুই এগিয়েছে। আমাদের সমাজ সংস্কৃতিও সে অর্থে পিছিয়ে নেই। তবুও প্রতি বছর এই নাগরিক জীবনে স্বাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে পয়লা বৈশাখ। এই একটি দিনে অন্তত সবার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস মেলে। বাংলা নববর্ষের আদ্যোপান্ত নিয়ে নিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

বাংলা নববর্ষের শুরু যেভাবে

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনে প্রচলন ঘটে নববর্ষ উদযাপনের। তখন নতুন বছর শুরু হতো বসন্তকালের প্রথম চাঁদ দেখা সাপেক্ষে। বসন্তকালকে তারা পুনর্জীবন, নতুন ফসল এবং ফুল ফোটার প্রতীক হিসেবে গণ্য করত। এগারো দিন ধরে চলত নববর্ষ উৎসব। রোমানরা তাদের বর্ষ গণনা শুরু করত মার্চ মাসের শেষ থেকে। তবে রোমান সম্রাটের শাসনামল পরিবর্তিত হলে এই রীতিও বদলে যেত। রোমান সিনেটররা খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সালে ঘোষণা করে জানুয়ারির এক তারিখই হবে বছরের প্রথম দিন। কিন্তু তারপরও খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সাল পর্যন্ত সিদ্ধান্তের বারবার পরিবর্তন ঘটে। তারপর সম্রাট জুলিয়াস সিজার এক তারিখকেই আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এ কারণে ইংরেজি বছরকে ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ও বলা হয়। পরে ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করে নতুন একটি বর্ষপঞ্জি ঘোষণা করেন। তারপর থেকে তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বা গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি হিসেবে পরিচিত। এই সৌর ক্যালেন্ডারই বর্তমানের ইংরেজি বর্ষপঞ্জি।

এবার আসা যাক, বাংলা নববর্ষ প্রচলনের ইতিহাসে। অংকের হিসেবে ইংরেজি ৫৯৩ সালে বাংলা সালের যাত্রা শুরু। এদিকে সম্রাট আকবর ক্ষমতায় আসেন ইংরেজি ১৫৫৬ সালে। অর্থাৎ বাংলা ৯৬৩ সনে তার সিংহাসন লাভ হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও ইতিহাস বলে, মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনামলে ফসলের জন্য ঋতুভিত্তিক সৌরসনের প্রয়োজন পড়ে। তখন প্রচলিত হিজরি সনকে ‘ফসলি’ সন হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু রাজ্যের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের ধর্মীয় ও অন্যান্য কাজে হিজরি সন ব্যবহারে আপত্তি জানান। সম্রাট আকবর বিষয়টি বিবেচনায় এনে হিজরি সন থেকে কিছু বছর বাদ দিয়ে বাংলা সন হিসেবে নতুন সৌরপঞ্জির প্রবর্তন করেন। তাই বলা যায় হিজরি সনের সিঁড়ি বেয়েই বাংলা সনের জন্মলাভ। পরবর্তীতে এই পঞ্জিকার হিসাবে তখনকার বার্ষিক কর, ভূমিকর, কৃষিকর, জলকর ইত্যাদি আদায় শুরু হয়। তথ্য অস্পষ্টতার জন্য অনেকে মনে করেন, সম্রাট আকবরের হাতেই বাংলা সনের গণনা শুরু। কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো সম্রাটের হাতে হিজরি সনকে রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলা সনের প্রবর্তন ঘটে। দিনে দিনে এই বাংলা বছর গণনায়ও এসেছে নানা পরিবর্তন। শুরুতে বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস ছিল অগ্রহায়ণ। বিভিন্ন সময়ে বঙ্গাব্দের দিন ও তারিখ নির্ধারণে জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। এসব জটিলতা নিরসনে প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বঙ্গাব্দের বেশ কিছু সংস্কার করেন। যেমন গণনার সুবিধার্থে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দিনের সংখ্যা প্রতি মাসে ৩১ করা হয় এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৩০ দিন গণনার বিধান করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্কার কাজের স্বীকৃতি প্রদান করেন।

 

বিদেশে বাংলা নববর্ষ

বিভিন্ন দেশে নিজস্ব রীতিতেই পালন করা হয় নববর্ষ। খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে নববর্ষ উদযাপিত হয়। কিন্তু দেশ ভেদে নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের ভিত্তিতে এই খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেও বহু জাতি নববর্ষ উদযাপন করে। সেখানে দেখা যায় ব্যতিক্রমী রীতিনীতি ও আয়োজন। এই হিসাবে ১৪ এপ্রিলে বাংলা পয়লা বৈশাখ পালন করা হয়। বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মহাসমারোহে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভ পয়লা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনা দেখা যায় পশ্চিম বাংলায়। বর্ষবরণ অনুষ্ঠান চলে দিনব্যাপী। গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। এই মেলায় অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই এদিন হালখাতার আয়োজন করে। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। মেলায় বাচ্চাদের জন্য পাবেন খেলনা, মণ্ডা-মিঠাই, নাগরদোলাসহ আরও কত কি। বড়দের জন্যও থাকে বাহারি সব আয়োজন। ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে-গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের ওপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে যেমন : সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরায় বৈশাখী মেলার মাধ্যমে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নাচ-গান-ফ্যাশন শো-খাবারের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির এ ধারাকে আনন্দময় করে তোলে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আগে বার্নউড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলেও ২০০৬ সাল থেকে সিডনি অলিম্পিক পার্কে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় বিপুল পরিমাণ লোকের সমাগম ঘটে এবং প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এটি একটি আনন্দঘন দিন। সুইডেনেও বিপুল উৎসাহের সঙ্গে পয়লা বৈশাখ উদযাপিত হয়। ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী প্রবাসী বাঙালিরা স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল (পথ উৎসব) পালন করে। এই উৎসবটি লন্ডনে করা হয়। ইউরোপে অনুষ্ঠিত সর্ববৃহৎ এশীয় উৎসব এটি এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সর্ববৃহৎ বাঙালি উৎসব।

 

বাংলা পঞ্জিকার শুরু

সন শব্দটি আরবি থেকে আগত। অর্থ-বর্ষ, বর্ষপঞ্জি-বছরের দিনক্ষণের বিবরণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার ভেদে রয়েছে নিজস্ব এমন পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার। তেমনি বাংলা সনের হিসাব রাখতেও আছে নিজস্ব নিয়ম-নীতির পঞ্জিকা।

সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৯) নির্দেশে এবং বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী ও পণ্ডিত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর গবেষণার ফলে বাংলা সনের উৎপত্তি। তখন খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনের পরিবর্তে ঋতুভিত্তিক সৌরসনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। তখনকার প্রচলিত হিজরি সনকে ‘ফসলি সন’ হিসেবে চালু করার মাধ্যমে বর্তমান বাংলা সন বঙ্গাব্দের জন্ম হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন অব্দের উদ্ভব হয়। বাংলায় বিভিন্ন সময়ে আমরা বিভিন্ন অব্দের প্রচলন লক্ষ্য করেছি। যেমন- মল্লাব্দ, শকান্দ, লক্ষণাব্দ, পালাব্দ, নশরত, শাহী সন, চৈতন্যাব্দ ইত্যাদি লক্ষণীয় বিষয়। এসব অব্দ প্রচলনের পেছনে রাজ-রাজড়ার নাম জড়িত রয়েছে। কিন্তু বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন প্রচলনের  পেছনে যারই অবদান থাকুক না কেন, এ নামের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে বাঙালি জাতির নাম। সুতরাং বাংলা সন হচ্ছে বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ। নিজস্ব আবেগ-অনুভূতি জড়িয়ে আছে এখানে। এটি শুধু বাংলা বর্ষকেই নির্দেশ করে। এখন পঞ্জিকায় বর্ষফল, মাসফল, রাশিফল প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। বাংলায় পঞ্জিকা প্রকাশের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয় রঘুনন্দন প্রথম পঞ্জিকা গণনা করেন। এরপর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পঞ্জিকা গণনা আরও প্রসারিত হয়। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা প্রথম মুদ্রিত হয়। এরপর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে পঞ্জিকা সংস্কার করে মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা। ১৯৫৭ সালে ভারত সরকারের অধীনে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে পঞ্জিকার সংস্কার হয় এবং এই সংস্কারপ্রাপ্ত পঞ্জিকা বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই ভারতের রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হয়।

 

ছায়ানটে বর্ষবরণ

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা চর্চা, ধারণ ও লালনে ছায়ানটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষবরণে ছায়ানট বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে এ দিনটিকে করে তোলে উৎসবমুখর। ছায়ানট বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন। ১৯৬১ সালে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসব পালন করা ছাড়াও এই সংগঠন বাদ্যযন্ত্র, সংগীত, নৃত্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনা করে থাকে। পয়লা বৈশাখের অন্যতম আকর্ষণ রমনার বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উত্যাপনের পর একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন কয়েকজন সংগঠক। তাদের মধ্যে মোখলেসুর রহমান (সিধু ভাই নামে পরিচিত), শামসুন্নাহার রহমান, সুফিয়া কামাল, ওয়াহিদুল হক অন্যতম। সাঈদুল হাসানের প্রস্তাবে সংঠনটির নামকরণ করা হয় ছায়ানট। সুফিয়া কামালকে সভাপতি আর ফরিদা হাসানকে সম্পাদক করে প্রথম কমিটি গঠিত হয়। ওই বছর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ছায়ানটের প্রথম অনুষ্ঠান পুরনো গানের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে বাংলা একাডেমির বারান্দায় সংগীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। প্রাথমিক কার্যক্রম ইংলিশ প্রিপারোটরি স্কুলে শুরু হয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত লেক সার্কাস গার্লস স্কুলে ছায়ানট আশ্রয় নেয়। স্বাধীনতার পর গভ. ল্যাবরেটরি স্কুলের অধ্যক্ষ ড. নূরুন নাহার ফয়জুন্নেসা তার স্কুলে ছায়ানটকে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেন। বিষয়টি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী অনুমোদন করেন। ১ বৈশাখ, ১৩৭০ বঙ্গাব্দে ওস্তাদ আয়েত আলী খান এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন। ইংরেজি ১৯৬৪ সাল, বাংলা ১৩৭১ সনের ১ বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানট বাংলা নববর্ষ পালন শুরু করে। কালক্রমে এই নববর্ষ পালন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়ে। এ ছাড়াও ছায়ানট ২৫ বৈশাখ, ২২ শ্রাবণ, শারদোৎসব ও বসন্তোৎসব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে।

 

চারুকলা ও মঙ্গল শোভাযাত্রা

মঙ্গল শোভাযাত্রা ছাড়া বৈশাখী উৎসবের কথা ভাবাই যায় না। ঢাকার বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রা এনে দেয় সার্বজনীন উৎসবের স্বাদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখ সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়। বর্ণিল এই শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে প্রাণবন্ত করে তোলে শহুরে আবহাওয়া। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ঠিকানা খুঁজে নেয় চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন অনুসঙ্গের উপস্থাপনায়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় সব শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সবার কাছে বৈশাখী উৎসবের অন্যতম একটি আকর্ষণ হয়ে আছে। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একই সঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। সে বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। পরের বছর চারুশিল্পী সংসদ নববর্ষের সকালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে। শোভাযাত্রার অন্যতম আকর্ষণ বিশালাকার চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমির ও ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ ও সাজ-সজ্জাসহ বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালাকার হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে-গানে উত্ফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ ধারা অব্যাহত রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থী। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে। তবে বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও কয়েক বছরের পুরনো। ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায়ও ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরনো বাদ্যসহ আরও অনেক শিল্পকর্ম।

 

বর্ষবরণে যত আয়োজন

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি

বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুসঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বর্ষবরণের এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে মানবতার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় ঐতিহ্য সুরক্ষাবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটির ১১তম অধিবেশনে এই স্বীকৃতি মেলে। বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউনেস্কোও মঙ্গল শোভাযাত্রার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে। ইউনেস্কো কমিটি বলেছে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভের বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণকেও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয় ইউনেস্কো কমিটি।

 

বটতলার মেলা

পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গ্রামের মেলা শৈশবের একটি আকর্ষণীয় অধ্যায়। এখনো গ্রাম এলাকা সবচেয়ে বড় বটগাছটির তলায় বা নদীর ধারে উঁচু ঢিবিতে বসে বৈশাখী মেলা। স্থানীয় কুমারের হাতে তৈরি মাটির খেলনা, মণ্ডা-মিঠাই, চরকি, বেলুন, ভেঁপু, বাঁশি আর ভাজাপোড়া খাবার-দাবার মেলার প্রধান আকর্ষণ। বাড়ির পাশের এই মেলায় ছেলে-বুড়ো সবার উপস্থিতি সমান। এ মেলা যেন গ্রামবাসীর আদি উৎসবের ডাক দিয়ে যায়। বাচ্চারা বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকে মেলায় যাওয়ার জন্য।

 

বৈসাবি

চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শনিবার ভোরে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। পুরনো বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় কিশোরী ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ফুল তুলে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে নদী-খালে ভাসিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই উৎসব। চাকমা সম্প্রদায় ফুল বিজু পালন করে। এর পরদিন মূল বিজু আর পয়লা বৈশাখ পালন করে। ওইদিন ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। ত্রিপুরা সম্প্রদায় হারিবৈসু, বিযুমা, বিচিকাতাল এবং মারমারা পেইংচোয়ে, আক্যে ও আদাদা পালন করে। মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি উৎসব করে।

 

হালখাতা

বাংলা নববর্ষ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হালখাতা। ক্রেতা-বিক্রেতার রসায়ন আরও মধুর করতে উৎসবের অন্যরকম রূপ-মাধুর্য এনে দেয়। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এদিন হিসাবের নতুন খাতা খুলেন। এ জন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরনো দেনা শোধ করে দেন। হিসাবের খাতা হালনাগাদ করা থেকে হালখাতার উদ্ভব। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছোট-বড় মাঝারি যে কোনো দোকানেই হালখাতার উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়। মূলত পঁচিশে বৈশাখের সকালে সনাতন ধর্মাবলম্বী দোকানি ও ব্যবসায়ীরা সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বিত্তের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন এই কামনায় যে, তাদের সারা বছর যেন ব্যবসা ভালো যায়। এই দিন ক্রেতাদের আনন্দদানের জন্য মিষ্টান্ন, ঠাণ্ডা পানীয় প্রভৃতির ব্যবস্থা করে থাকেন ব্যবসায়ীরা।

 

কলকাতায় এক দিন পর নববর্ষ

ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে ধর্মের ভিন্নতা ও নাগরিকত্বের ভিন্নতা। কিন্তু জাতিতে আমরা বাঙালি। অথচ বাংলা বর্ষবরণের তারিখ নিয়েও দুই বাংলার মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। বাংলাদেশিরা খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে আর ওপারের বাঙালিরা পালন করে ১৫ এপ্রিল। এর কারণ হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়েছে। ফলে এখানে হয়েছে নতুন পঞ্জিকা, যা পশ্চিমবঙ্গের পঞ্জিকা থেকে একটু এগিয়ে গেছে। এ ছাড়াও ১৯৫২ সালে বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতিপদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহা ভারতে প্রচলিত প্রাচীন বর্ষপঞ্জির আমূল সংস্কার করেন। সেই অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ হওয়ার কথা। ড. মেঘনাদ সাহাকে সমর্থন করেন বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কিন্তু সনাতনপন্থি পঞ্জিকাকারেরা তার প্রস্তাব গ্রহণ না করায় দুই দেশের বাঙালিদের মধ্যে একই উৎসব ভিন্ন দিনে পালন করা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর