রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্বকাপে শেষ ষোলোর যত ঘটনা

তানভীর আহমেদ

১৯৯৪ বিশ্বকাপে ২৪টি দল অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ থেকেই ৩২ দলের বিশ্বকাপ সাজানোর নিয়ম শুরু হয়। প্রথম পর্বের পর শেষ ষোলো দলের লড়াই বাধে এখন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের আগে বলা হতো ‘লাস্ট সিক্সটিন’ বা শেষ ষোলোর লড়াই। বর্তমান নিয়মে আট গ্রুপে প্রথম পর্বের খেলায় ১৬ দল বাদ পড়ে যায়। দ্বিতীয় পর্বে কাটা যাবে ৮ দল।  কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ যাবে আরও চার দল। শেষ চার থেকেই ফাইনালের মঞ্চে যাবে দুই দল—

 

কোস্টারিকা-গ্রিসের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই

২০১৪ বিশ্বকাপের অন্যতম আলোচিত লড়াই দেখা যায় দ্বিতীয় পর্বে। কোস্টারিকা গ্রিসের মুখোমুখি হয় শেষ ষোলোয়। প্রথমার্ধ গোলশূন্য কাটলেও দ্বিতীয়ার্ধের ৫২ মিনিটে কোস্টারিকা প্রথম গোলের দেখা পায়। এরপরই শুরু হয় উত্তেজনা। মেরে খেলতে থাকায় বার বার হলুদ কার্ড দেখাতে থাকেন রেফারি। তবু খেলোয়াড়দের মাঝে লড়াকু মনোভাব আটকে থাকেনি। দ্বিতীয় হলুদ কার্ড পাওয়া কোস্টারিকার ডিফেন্ডার দুরাতে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। ৯০ মিনিট পেরিয়ে এক্সট্রা সময় যোগ হয় এক মিনিট। সেই এক মিনিটেই গ্রিস গোল শোধ করে বসে! আরও ৩০ মিনিট খেলার পর টাইব্রেকারে গড়ায় ম্যাচটি। টানটান উত্তেজনার সেই খেলায় ৫-৩ গোলে গ্রিসকে হারায় কোস্টারিকা।

 

ডেভিড বেকহ্যামের লাল কার্ড

বাঁচা-মরার লড়াইয়ে তারকা খেলোয়াড়ের ওপর নজর থাকে সবার। এখন যেমন মেসি, নেইমার বা রোনালদোর ওপর সবার চোখ। ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যাম ছিলেন তেমনই একজন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড বিশ্বজয়ের স্বপ্ন বুনছিল তাকে ঘিরে। বেকহ্যাম মাঠে থাকা মানেই পকেটে মারণাস্ত্র নিয়ে ঘোরা। ক্রেসপো, ভেরন আর বাতিস্তুতার আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হওয়া মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হন ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যাম। একের পর এক গোলে মাঠে তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। খেলার ৪৭ মিনিটে আর্জেন্টিনার দিয়েগো সায়মনের সঙ্গে তর্ক বাধিয়ে বসেন। দুজনের তর্কে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন বেকহ্যাম। রাগের মাথায় সজোরে লাথি মেরে মাটিতে শুইয়ে ফেলেন সায়মনকে। রেফারি কোনোমতে বেকহ্যামকে সামলে নিয়ে লাল কার্ড দেখিয়ে তাকে মাঠ থেকে বের করে দেন। এ ধকল আর সামলাতে পারেনি ইংল্যান্ড। আর্জেন্টিনার কাছে পরাজয়ের পর বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় ইংল্যান্ড। ইংলিশ পত্রিকাগুলো বেকহ্যামকে ভিলেন বানিয়ে ছাড়ে। লন্ডনে তার ছবি ‘ক্রিমিনাল’ শিরোনামে সাঁটিয়ে রাখেন ইংল্যান্ড ভক্তরা। এক লাল কার্ডেই হিরো থেকে জিরো বনে যান বেকহ্যাম।

 

মাঠেই আতশবাজির আগুনে রক্তাক্ত গোলকিপার 

সবই নাটক!

১৯৯০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মুখোমুখি হয়েছিল চিলি। খেলার মাঝে চিলির গোলকিপার হুট করে জ্বলে-পুড়ে উঠলেন আতশবাজির আগুনে! কে ছুড়েছে কেউ জানে না। সতীর্থরা তাকে উদ্ধার করে দেখলেন গাল কেটে রক্তের স্রোত বইছে। এই ঘটনার তদন্তে ফিফা পেল অন্য ঘটনা। এসবই চিলির সাজানো নাটক ছিল। গোলকিপার রোজেসের হ্যান্ড গ্লাভসেই লুকানো ছিল ব্লেড। এই নাটকের জেরেই নিষিদ্ধ হন, ক্যারিয়ার শেষ হয় রোজেসের। বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ হয় চিলি।

 

ইংল্যান্ডের ভরাডুবি

ইতালি আর উরুগুয়ের সঙ্গে হেরে ২০১০ বিশ্বকাপে নিজেদের ভরাডুবির গল্প লিখতে শুরু করেছিল ইংল্যান্ড। তারপর কোস্টারিকার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র। শেষ ষোলোয় ইংল্যান্ডকে পড়তে হয় পাওয়ার ফুটবলের ওস্তাদ জার্মানির সামনে। জার্মানি ইংল্যান্ডকে নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা শুরু করে। বল ছুঁতেই পারছিল না ইংল্যান্ডের কেউ। ওয়েইন রুনিও নিষ্প্রভ ছিলেন। প্রথমার্ধেই দুই গোল খেয়ে মাত্র একটি ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল ইংল্যান্ড। জার্মানির ক্লোসা, পোদলস্কি আর থমাস মুলার ইংল্যান্ডের ডি-বক্স ঘিরে ছিলেন পুরোটা সময়। যার ফলাফল দ্বিতীয়ার্ধে আরও দুটি গোল। ৪-১ গোলে ইংল্যান্ডের বিদায় নিশ্চিত হয় সেই বিশ্বকাপ থেকে। ইংল্যান্ডের এমন পতন সবাইকে হতবাক করে দেয়।

 

টাইব্রেকারে আসল নাটক

১৯৯৮ বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর লড়াইয়ে টাইব্রেকার নাটক জমে ওঠে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে। ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যাম আর আর্জেন্টিনার গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার মতো তারকাদের লড়াইয়ে খেলার ৯০ মিনিটেই ৪ গোলের দেখা মেলে। ২-২ গোলে ৯০ মিনিটের খেলার ৪৭ মিনিটেই লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন বেকহ্যাম। ইংল্যান্ডকে এই ধাক্কা সামলাতে হয় টাইব্রেকারে গিয়ে। টাইব্রেকারে ইংল্যান্ড ও আর্জেন্টিনার নেওয়া দ্বিতীয় শট দুটিই আটকে যায় গোলকিপারের সামনে। আর্জেন্টিনার ক্রেসপোর শটে গোল না হওয়ায় গ্যালারিতে আর্জেন্টাইন ভক্তরা কাঁদতে শুরু করেন। তবে সে কান্নামুখ হাসির দেখা পায় শেষদিকে। ৩-৪ গোলে টাইব্রেকারে ইংল্যান্ড হেরে বসে।

 

রেফারির কাণ্ড

একজনকেই ৩ হলুদ কার্ড!

বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। ২০০৬ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়া বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে এক খেলোয়াড়কেই তিনবার হলুদ কার্ড দেখান মাঠের রেফারি। রেফারির এই অদ্ভুত কাণ্ড সবাইকে বিস্মিত করে। রেফারিকে নিয়ে নানা সমালোচনা আর বিতর্কের বিশ্বকাপ  ২০০৬ এমনিতেই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। লাল কার্ডের ছড়াছড়িতে বিরক্ত হয়ে পড়েন মাঠের খেলোয়াড়রা। এমনকি দর্শকরাও রেফারিদের কড়াকড়ি দেখে ধুয়োধ্বনি দিতে থাকেন খেলার মাঝে। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সিমুনিককে তিনবার হলুদ কার্ড দেখানোর এই বিরল ঘটনা ছিল একটু বেশি বিদঘুটে। খেলার ৬১ মিনিটে প্রথম হলুদ কার্ড দেখেন সিমুনিক। ৯০ মিনিটের মাথায় দ্বিতীয় হলুদ কার্ড পেলেও রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখাননি। যোগ করা সময়ে, খেলার ৯৩ মিনিটে আবার তাকে হলুদ কার্ড দেখান। অবশেষে রেফারির মনে পড়ে এবার বুঝি তাকে লাল কার্ড দেখানো যায়! অবশেষে তিন হলুদ কার্ডের পর লাল কার্ড পকেট থেকে বের করেন রেফারি। এই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটানো রেফারির নাম গ্রাহাম পোল।

 

তারকাদের ট্যাটু

নেইমার

শরীরজুড়ে ট্যাটু আঁকানোয় জুড়ি নেই ব্রাজিলের ফুটবল তারকা নেইমারের। অন্যান্য ট্যাটুর সঙ্গে নিজের ডান হাতে এঁকে নিয়েছেন বোন রাফায়েলার ছবি। বাঁ হাতে ইতালিয়ান ভাষায় সোরেলা বা বোন লেখা ট্যাটু। ছোটবেলার দিন মনে করে তার পায়েও আছে দারুণ একটি ট্যাটু।

 

মেসি

ফুটবলপ্রেমীদের কাছে মেসির নাম উচ্চারিত হয় সম্মান ও ভালোবাসার সঙ্গে। তবে তার শরীরের বিশেষ একটি ট্যাটু হয়তো ভক্তদের কিছুটা ঘাবড়ে দেবে। কারণ উল্কিটি যে একটি লাস্যময়ী ঠোঁটের। তবে উৎকণ্ঠার কারণ নেই, এটি মেসির প্রিয়তমা স্ত্রীরই লাল ঠোঁটের ছবি।

 

আর্টুর বুরক

পোলিশ পেশাদার ফুটবলার আর্টুর বুরক। তিনিও কম রসিক নন। নিজের নাভিতে একটি বানরের ছবি দিয়ে উল্কি করেছেন। তাও আবার বানরের পেছনের দিক দেখা যাচ্ছে উল্কিতে। কিন্তু আসলেই কি এটি হাস্যকর অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে? উত্তর আসবে ‘না’। কারণ বানরের ছবিটি তিনি পবিত্র লক্ষণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাই এই উল্কির গুরুত্ব মোটেই কম নয়।

 

মাওরো ইকার্দি

আর্জেন্টিনা ফুটবল শিবিরের অন্যতম নাম মাওরো ইকার্দি। ক্লাবে নিজের নাম ফোটান গোলের পর গোল দিয়ে। এরই সুবাদে জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয় দলে। খেলার নৈপুণ্যে তিনি যেন দুর্দান্ত সিংহ। শরীরেও তার প্রমাণ রেখেছেন। এই ফুটবলারের পুরো শরীর ঢাকা দৈত্যাকার সিংহের উল্কিতে। বুকের ওপর ও পেটের কাছে রয়েছে দুই মেয়ের নাম। বৃহদাকার এই উল্কি আঁকতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগেছে।

জন স্টোনস

স্টোনসের ঊরুতে একজন চশমা পরা মধ্যবয়সী লোকের ছবির ট্যাটু। ট্যাটুর এই মানুষটি বার্নসলির লিজেন্ড নরম্যান রিমিংটন, যিনি ৯০ বছর বয়সে মারা যান। তার মতো একজন লিজেন্ডের ট্যাটু নিজের শরীরে ধারণ করাটা অবশ্যই একটি শ্রদ্ধাশীল অনুভূতির জোগান দেয়।

 

সার্জিও রামোস

রিয়াল মাদ্রিদ ক্যাপ্টেন ও স্পেন ইন্টারন্যাশনালের তারকা ফুটবলার সার্জিও রামোস। তার শরীরে আছে অর্থপূর্ণ বেশ কিছু ট্যাটু। হাতের ওপর এঁকেছেন প্রতীকী ট্যাটু। হাতের ওপর ৩৫, ৯০+, ৩২ ও ১৯ সংখ্যাগুলো নাকি তার হৃদয়ের খুব কাছের।

 

ডেমিন ডিলানি

আয়ারল্যান্ড শিবিরের ডেমিন ডিলানির শরীরে আঁকা ট্যাটুগুলো হয়তো সবচেয়ে বেশি হাস্যকর। হাতে আছে একটি ক্লাউনের ট্যাটু। পায়েও আছে চশমা পরা বন্ধুকধারী এক উল্লুকের ছবি। যাই হোক, এসব উল্কি উদ্বিগ্ন ট্রেন্ডকে নির্দেশ দেয়।

 

চোখ ধাঁধানো ৪ গোল

৩২ দল নিয়ে শুরু হয়েছিল রাশিয়া বিশ্বকাপ। গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়েছে ১৬ দল। গ্রুপ পর্বের লড়াইয়ের পর এখন চলছে নকআউট পর্ব। কাটা পড়তে শুরু করেছে ফেবারিট দলগুলো। গ্রুপ পর্বে কাটা পড়া দলগুলোর কাছ থেকে দেখা গেছে দুর্দান্ত কিছু গোল। সার্বিয়ার বিপক্ষে সুইজারল্যান্ডের গ্রানিথ শাকার গোল ছাড়াও আরও ৪টি গোল দর্শকদের মনে থাকবে বহুদিন...

 

টনি ক্রোজ

তারকাসমৃদ্ধ জার্মানি বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্বেই। নাজুক অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে সুইডেনের সঙ্গে মরিয়া হয়ে লড়ছিল জার্মানি। গোল পোস্টের চারপাশ ঘিরে রেখেও গোল পাচ্ছিলেন না জার্মান ফরোয়ার্ডরা। একে একে ৯ জন সুইডেনের ডি-বক্সের বাইরে ঘিরে থাকলেও কাজের কাজ গোল হচ্ছিল না। হাল ধরলেন টনি ক্রোজ। ডি-বক্সের বাইরে থেকে তিনি বাঁকানো ফ্রি-কিকে গোল করে জার্মান শিবিরে স্বস্তি এনে দেন।

 

সন হিউং মিন

জার্মান বধের দল দক্ষিণ কোরিয়ার সন হিউং মিনের পা থেকে অসাধারণ এক গোলের দেখা পাওয়া যায় মেক্সিকোর বিপক্ষে।

তার দূরপাল্লার দুর্দান্ত শটে গোলকিপারের কিছুই করার ছিল না। গতি আর ঘূর্ণনে গোলটি ছিল দেখার মতো।

 

আহমেদ মুসা

আইসল্যান্ড গ্রুপ ডি-এর সমীকরণ ছিল সবচেয়ে কঠিন। আইসল্যান্ড, নাইজেরিয়া ও আর্জেন্টিনার মধ্য থেকে এক দল পাবে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকিট। নাইজেরিয়ার সামনে পড়ে আইসল্যান্ড। জয় ছাড়া পথ খোলা নেই। গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচে জ্বলে ওঠেন আহমেদ মুসা। সুপার ঈগলদের হয়ে সে ম্যাচে দুই গোল করেন। প্রথম গোলটি ছিল দুর্দান্ত। শুরুতে বল রিসিভ করে নিজের পায়ে রেখে, সামনে ঠেলে ফিনিশিং টাচ দেন। রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা গোলগুলোর এটি একটি।

 

আলেক্সান্ডার কোলারভ

সার্বিয়া বনাম কোস্টারিকার খেলায় আলেক্সান্ডার কোলারভের পা থেকে অবিশ্বাস্য এক গোলের দেখা মেলে। ২৫ গজ দূর থেকে তার বাঁ পায়ের শট চোখের পলকে গোল পোস্টে ঢুকে যায়। বলের বাঁক এতটাই অকল্পনীয় ছিল যে গোলকিপারের কিছুই করার ছিল না।

সর্বশেষ খবর