সোমবার, ২০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

পবিত্র হজের কথা

তানভীর আহমেদ

পবিত্র হজের কথা

হজের ফরজ ও ওয়াজিব

হজের ফরজ চারটি : এক. হজের নিয়ত করে পোশাক (সেলাইবিহীন দুই প্রস্থ সাদা কাপড় পুরুষের জন্য) পরিধান করা ও তালবিয়া একবার পড়া। এটাকে ইহরাম বলে।

দুই. ৯ জিলহজ আরাফায় অবস্থান করা।

তিন. জিয়ারতের তাওয়াফ বা ফরজ তাওয়াফের প্রথম চার চক্কর ফরজ, বাকি তিন চক্কর ওয়াজিব। এ তাওয়াফ ১০ জিলহজ করতে হয়। ১১-১২ তারিখেও এ তাওয়াফ করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে।

চার. এ ফরজগুলো নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত ক্রমানুসারে আদায় করা।

 

হজের ওয়াজিব ৯টি : এক. সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে দ্রুত চলা। বর্তমানে হাজীদের সুবিধার জন্য এ পথের মাঝে খুব সহজে চোখে পড়ার মতো মাথার ডানে-বামে ও ওপরে সবুজ বাতির দুটি বেষ্টনী আছে। এই দুই বর্ডার লাইনের মধ্যে দৌড়ালেই ওয়াজিব আদায় হবে। এ দ্রুত চলাকে সাঈ বলে।

দুই. মুজদালিফায় অবস্থান করা। ৯ জিলহজ (আরাফাতে অবস্থানের দিন) দিবাগত রাতের যে কোনো সময়ে সেখানে পৌঁছানো এবং সূর্যোদয় পর্যন্ত অবস্থান করা।

তিন. শয়তানের স্তম্ভে (জামারায়) পাথর মারা। এটাকে ‘রামি’ বলে।

চার. মক্কা শরিফের চতুর্দিকে ইহরাম বাঁধার যে নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে, সেই পরিসীমার বাইরে যারা অবস্থান করে তাদের জন্য মক্কা শরিফে প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম খানায়ে কাবার তাওয়াফ করা। বাংলাদেশি হাজীদের জন্য এ তাওয়াফ ওয়াজিব। এ প্রাথমিক তাওয়াফকে ‘তাওয়াফে কুদুম’ বলে।

পাঁচ. বিদায়ী তাওয়াফ করা। খানায়ে কাবা থেকে শেষ বিদায়ের সময় (হজ থেকে ফেরার দিন) তাওয়াফ করা। এটা বহিরাগতদের জন্য ওয়াজিব, কাজেই এ দেশি হাজীদের এ তাওয়াফ ওয়াজিব।

ছয়. পুরুষের মাথা মুড়ানো বা চুল ছাঁটা। হজের আরকান শেষ করার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা অথবা চুল ছাঁটা। ১০ জিলহজ শয়তানের বড় স্তম্ভে (জামারায়ে উকবায়) পাথর মারার পর মাথা মুড়িয়ে ফেলা বা চুল ছোট করা।

সাত. কোরবানি করা। বহিরাগত হাজীদের জন্য এটা ওয়াজিব।

আট. দুই নামাজ একত্রে পড়া।

অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে জোহর-আসর একত্রে এবং মুজদালিফায় মাগরিব-এশা একত্রে পড়া ওয়াজিব।

নয়. পাথর মারা (রামি), কোরবানি ও পুরুষের মাথা মুড়ানো ক্রমানুসারে করা।

 

আরাফাত ময়দানে হাজীদের একদিন

আরাফাত ময়দানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস। আরাফাতের ময়দানেই মিলন ঘটেছিল হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর। বেহেশত থেকে দুনিয়াতে এসে তারা আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় মিলিত হন আরাফাতের ময়দানে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত আরাফাত বিশিষ্ট হয়ে আছে ‘বিদায় হজের ভাষণ’ এর জন্য। মহানবীর সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যে ছিল মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করার, সাম্যের মহাবার্তা। আরাফাতের ময়দান মক্কা থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। জায়গাটি প্রায় সমতল। বছরের অধিকাংশ সময় এই স্থানে লোক সমাগম হয় না। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ হজের দিন হজযাত্রীরা মিনা থেকে এখানে উপস্থিত হন। আরাফাতে অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি। এ সময় এখানে খুতবা পড়া হয় এবং জোহর ও আসরের নামাজ একত্রে পড়া হয়। সন্ধ্যায় হজযাত্রীরা আরাফাত ছেড়ে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হন।

 

জমজমের পানির ফজিলত

পবিত্র হজ পালনের মৌসুমে জমজম কূপের পানি নিয়ে অনেকেই আলোচনা করেন। জমজম কুয়া মক্কায় মসজিদুল হারামের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি কুয়া। এটি কাবা থেকে আনুমানিক ২০ মিটার (৬৬ ফুট) দূরে অবস্থিত। জমজম কুয়া বেশ কয়েকবার সংস্কার করা হয়। প্রথমে এটি পাথর দিয়ে ঘেরা অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে খলিফা আল মনসুরের সময় এর উপর গম্বুজ এবং মার্বেল টাইলস বসানো হয়। পরবর্তীতে খলিফা আল মাহদি এটি আরও সংস্কার করেন। বর্তমানে কুয়া কাবা চত্বরে দেখা যায় না। এটি ভূগর্ভস্থ অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং এখান থেকে পানি পাম্পের সাহায্যে উত্তোলন করা হয়। মসজিদুল হারামের বিভিন্ন স্থানে তা সরবরাহ করা হয়। জমজমের পানি পানের ফজিলত অনেক। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘ভূপৃষ্ঠের সেরা পানি হলো জমজমের পানি। এর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিকর খাদ্য এবং রোগ হতে আরোগ্য।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এটি (জমজমের পানি) বরকতময় পানি।’ প্রতি বছরই হাজীরা হজ পালন শেষে ফেরার পথে বোতলে করে জমজমের পানি নিয়ে আসেন।

 

হজযাত্রীর স্বাস্থ্য সচেতনতা

হজ পালনে শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া দরকার। হজের শুরুতেই তাই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ধীরস্থির থাকতে হবে। অহেতুক ছোটাছুটি এখানে কাম্য নয়।

 

হজের সময় রোদ এড়াতে কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখা যেতে পারে। দরকার হলে মাথায় সাদা ছাতা ব্যবহার করতে হবে। গরমজনিত ঝুঁকি এড়াতে প্রচুর পানি পান করতে হবে। রাতে ভ্রমণ করতে হবে। কিছুটা লবণাক্ত খাবার এ সময়ে দরকার হয়, ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া লবণের ঘাটতি মেটানোর জন্য।

 

শরীরের পানি স্বল্পতা এড়াতে সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে। অতিরিক্ত ঘামের কারণে সৃষ্ট শারীরিক অবসাদ কাটাতে খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা যেতে পারে। এ খাবার স্যালাইন ডায়রিয়া হলেও উপকারে আসে। কাজেই সঙ্গে নিতে পারেন খাবার স্যালাইনও।

 

বেশির ভাগ হাজী গলাব্যথা, কাশি, ঘন ঘন হাঁচি, সর্দি এবং জ্বরে ভুগে থাকেন। হঠাৎ পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য এমনটি হয়ে থাকে।

এসব সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সাধারণ কিছু ওষুধপত্র যেমন— ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল, হাঁচি-সর্দির জন্য ফেক্সোফেনাডিন জাতীয় ওষুধ, কাশির জন্য এডোভাস সিরাপ কিংবা সিনেকড ট্যাবলেট গ্রহণ করা যেতে পারে। অল্প কিছু করে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াই ভালো।

 

হজের দিনগুলোতে সুষম খাবারের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সেই ঘাটতি পূরণে মাল্টিভিটামিন গ্রহণ করা উচিত।

 

যদি কারও অ্যাজমা হাঁপানি থাকে তখন অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে হজব্রত পালনের পথে কীভাবে চলতে হবে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা ও প্রস্তুতি থাকতে হবে।

 

হজের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো

ইহরাম

ইহরাম বাঁধা মূলত হজের নিয়ত করা। পুরুষের জন্য দুইখানা সেলাইবিহীন চাদর পরিধান করা এবং মাথা ও মুখমণ্ডল খোলা রাখা হয়। মহিলাদের জন্য মুখ ও দুই হাতের কবজি পর্যন্ত খোলা রাখতে হয়।

 

সাঈ

সাফা ও মারওয়াহ পাহাড় দুটির মাঝে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে সাঈ বলা হয়।

হাদি

হজের কোরবানি (তামাত্তু ও কেরান আদায়কারীদের ওপর ওয়াজিব)।

 

তাওয়াফ

পবিত্র কাবাঘরকে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে।

 

তাওয়াফে ইফাদা/জিয়ারাহ

হজের ফরজ তাওয়াফ যা আরাফাত, মুজদালিফা ও মিনার প্রথম দিনের কাজ শেষে মক্কায় এসে সম্পন্ন করতে হয়।

বিদায়ী তাওয়াফ

হজ বা ওমরাহর যাবতীয় কাজ শেষে মক্কা ত্যাগের পূর্বের তাওয়াফ।

 

ইজতেবা

পুরুষের ইহরামের চাদরকে ডান বগলের নিচে দিয়ে এনে বাম কাঁধে রেখে ডান কাঁধ খালি রাখা।

 

রমল

মক্কায় পৌঁছে প্রথম তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে পুরুষরা ছোট ছোট পদক্ষেপে সামান্য দৌড়ের ভঙ্গিতে দুই হাত দুলিয়ে চলা।

 

হাতিম

কাবাঘরের রুকনে ইয়ামেনি ও রুকনে শামির মাঝে দেয়াল ঘেরা অর্ধচক্রাকৃতি অংশ যা পূর্বে কাবাঘরের অংশ ছিল।

 

রমি

রমি অর্থ কঙ্কর নিক্ষেপ। হাজী সাহেবগণ ১০ জিলহজ বড় জামারায়, ১১ জিলহজ মেজ জামারায় ও ১২ জিলহজ ছোট জামারায় সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। কঙ্কর নিক্ষেপ করা ওয়াজিব।

 

দম

হজ বা ওমরাহ আদায়ে কোনো ওয়াজিব ছুটে গেলে অথবা ইহরাম নষ্ট হয় এমন কাজ করলে হারাম এলাকার ভিতরে একটি পশু কোরবানি করে গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে হয়।

 

মাবরুর হজ

যে হজে হাজীকে কোনো গোনাহ স্পর্শ করে না এমন হজকে মাবরুর হজ বলে।

 

এক নজরে হজের কার্যক্রম

 ইহরাম বাঁধা

 ৭-৮ জিলহজ মিনায় অবস্থান

 ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পরে মিনা থেকে আরাফাতে অবস্থান এবং সূর্যাস্তের পর মুজদালিফায় যাওয়া

 ৯ জিলহজ মুজদালিফায় রাতযাপন

 ১০ জিলহজ মিনায় বড় জামরায় (শয়তান) কঙ্কর মারা, কোরবানি করা, পুরুষের মাথা মুড়ানো

 ১২ জিলহজের মধ্যে তাওয়াফে জিয়ারত, সাঈ করা

 ১১, ১২ জিলহজ মিনায় জামরায় (শয়তান) কঙ্কর মারা

 বিদায়ী তাওয়াফ

 

মক্কা-মদিনার পবিত্র স্থান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর