রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

অভিযাত্রীদের কত কাহিনী

তানিয়া তুষ্টি

অভিযাত্রীদের কত কাহিনী

যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক বিশ্বের বহু প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। ধারণ করেছেন সেখানকার সংস্কৃতি, জীবনাচরণের ভিন্নতা আর অনুকূল প্রতিকূলতার অভিজ্ঞতা। কখনো কখনো  অন্য জায়গা থেকে অর্জন করা অভিজ্ঞতার আলোকে তারা নতুনের রচনা করেছেন কোথাও কোথাও। সেতুবন্ধন গড়েছেন পৃথিবীর এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের খোঁজ পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে তাদের মতোই মনুষ্য বসতি আছে তা জেনেছেন এসব পরিব্রাজকের মাধ্যমে। সেসব নিয়ে আজকের আয়োজন।

 

তাদের চোখে বাংলা

ইবনে বতুতার বর্ণনায় পাওয়া যায় মাত্র এক দিরহাম দিয়ে তখন বাংলাদেশে আটটি স্বাস্থ্যবান মুরগি পাওয়া যেত, এ ছাড়াও এক দিরহামে পনেরোটা কবুতর, দুই দিরহামে একটি ভেড়া এবং এক স্বর্ণমুদ্রারও কম মূল্যে দাস-দাসী কিনতে পাওয়া যেত। যখন ইবনে বতুতা বর্তমান বাংলাদেশে এসে পৌঁছান তখন এখানকার সুলতান ছিলেন ফখর-উদ-দিন। ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মহান দরবেশ শেখ জালাল-উদ-দিনের (হযরত শাহ জালাল রঃ) সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। অথচ কেউ কারও পরিচিত ছিল না কিংবা আগমনের খবরও দেননি। এখান থেকেই ইবনে বতুতা শেখ জালাল-উদ-দিনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ব্যাপারে ইঙ্গিত পান। হযরত শাহজালালের (রঃ) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফেরার পথে ইবনে বতুতা একটি ছাগলের পশমের কোট উপহার পান। ইবনে বতুতার বর্ণনা মতে শেখ জালাল-উদ-দিন একটি পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতেন যেখানে তারা ছাগল পুষতেন দুধ এবং মাখনের জন্য। তার সহযোগীরা প্রত্যেকেই সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন এবং কেউই এ দেশীয় ছিলেন না। অবশেষে শেখ জালাল-উদ-দিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হন।

ফা হিয়েনের বর্ণনা থেকে জানা গেছে, উপমহাদেশ এক অপূর্ব শান্তির দেশ! রাজার শাসনের কঠোরতার চেয়ে উদারতাই বেশি। কোনো স্থানেই শাস্তির দণ্ড খুব কঠোর নয়। সে সময় অপরাধীদের প্রাণদণ্ড দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল।  তবে রাজদ্রোহ হলে শাস্তির মাত্রা কিছুটা কঠিন ছিল। সেক্ষেত্রে অপরাধীর ডান হাত কেটে নেওয়া হতো। অন্যান্য ক্ষেত্রে ছিল শুধু অর্থদণ্ড। প্রজারা ছিল পরিপূর্ণ স্বাধীন। অনুমতি পাস ছাড়াই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতে পারত। অপরাধের পরিমাণ ছিল খুব কম তাই বিচারের জন্যে আদালতে যেতে হতো না। রাতের বেলা  ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘুমানো যেত। শহরে ধনীর সংখ্যা প্রচুর। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত কে কত ভালো কাজ করতে পারে। রাজপথের ধারে ধারে সরাইখানা। দাতব্য চিকিৎসালয়ে দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা করতে টাকা লাগত না বরং বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান করা হতো।

হিউয়েন সাং ৬৩৮ সালে বাংলায় আসেন। পুণ্ডবর্ধনের রাজধানী পুণ্ডনগরে তার আগমন ঘটে। পুণ্ডনগর হলো বর্তমানে বাংলাদেশের মহাস্থানগড়। এরপরে তিনি নওগাঁর সোমপুর বিহার পরিদর্শন করেন। তার বিবরণী থেকে জানা যায় সে সময় দেশটির পরিসীমা ছিল প্রায় ৪০০০ লি (ছয় লিতে এক মাইল) এবং এ রাজ্যের রাজধানীর পরিসীমা হলো ৩০ লি। তিনি বর্ণনা করেন দেশটি ঘনবসতিপূর্ণ হলেও খাদ্যশস্যে সমৃদ্ধ। বাংলা ভ্রমণ শেষে তিনি তৎকালীন কামরুপের রাজা ভাস্করবর্মণের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে ৯০০ লি প্রশস্ত নদী পার হয়ে কামরুপের রাজধানী প্রাগজ্যোতিষপুরে গমন করেন। ৯০০ লি প্রশস্ত নদীটি ধারণা করা হয় করতোয়া। সেখান থেকে ১৩০০ লি দক্ষিণে সমতট যান। তার বর্ণনা মতে, এ দেশটির পরিসীমা ৩০০০ লি এবং রাজধানীর পরিসীমা ২০ লি।  এটি বিশাল সাগরতটে অবস্থিত। হিউয়েন-সাং-এর বিবরণ অনুযায়ী নিম্নভূমির এ দেশটি সমৃদ্ধ। আবহাওয়া নমনীয় এবং অধিবাসীদের আচরণ অমায়িক। এরা প্রকৃতিগতভাবে পরিশ্রমী, খাটো আকৃতির এবং এদের গাত্রবর্ণ কালো। তারা জ্ঞানচর্চায় অনুরাগী।

 

আমেরিকা আবিষ্কার

[ক্রিস্টোফার কলম্বাস]

প্রাচীনকালে চীন থেকে সিল্ক, চীনামাটির চমৎকার সব জিনিসপত্র আর ভারত থেকে মসলা, সুতি কাপড়, সোনারুপার নানারকম গয়না যেত ইউরোপে। এসব পণ্যের বণিক ছিলেন মোঙ্গল, অটোমান তুর্ক ও আরবরা। কিন্তু নিজেরা যদি সরাসরি সওদা করা যায় তবে লাভ বেশি হবে ভেবে ইউরোপীয়রাও চেষ্টা চালাতে লাগল। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ছিলেন ইতালির জেনোয়া শহরের এক সাহসী নাবিক। তিনিও চেয়েছিলেন নিজের জাহাজে দামি দামি সব পণ্য বোঝাই করে দেশে গিয়ে রমরমা ব্যবসা পাতবেন। আনুমানিক ১৪৫১ সালে জন্ম নেওয়া এই নাবিক ২২ বছর বয়সে যোগ দেন এক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে। তার ধারণা হলো আটলান্টিক মহাসাগর দিয়ে ক্রমাগত জাহাজ চালিয়ে গেলে ভারতের পশ্চিম উপকূল বা জাপানের কাছাকাছি কোথাও পৌঁছানো যাবে। মূল জাহাজ সান্তা মারিয়া ও অন্য দুটি জাহাজ নিনা ও পিন্টা নিয়ে ১৪৯২ সালের ৩ আগস্ট কলম্বাস যাত্রা শুরু করেন। অক্টোবর মাসের ১২ তারিখ আমেরিকা মহাদেশে পদচিহ্ন ফেলেন কলম্বাস। তিনি ও তার সঙ্গীরা তখনো জানতেন, ভারতের কোন দ্বীপে পৌঁছেছেন। কলম্বাস এর নামও দেন ‘সান সালভাদর’। এরপর মোট চারবার স্পেন থেকে আমেরিকা মহাদেশে অভিযান চালান তিনি। মহাদেশের মূল ভূখণ্ডেও তিনি পৌঁছান। অথচ তখনো জানতেন না তারা নতুন এক মহাদেশে পৌঁছেছেন। সে কথাটি বের করেন আমেরিগো ভেসপুচি নামে আরেক নাবিক। তার নাম অনুসারেই হয় আমেরিকার নাম। কলম্বাস সত্যিই ছিলেন দুর্ভাগা। মহাদেশের প্রথম আবিষ্কারক হয়েও তার নামে এটির নামকরণ হলো না।

 

উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু সব তার জানা

[স্যার এডমন্ড পার্সিভাল হিলারি]

বিশ্ব ভ্রমণের শখ অনেকের মাঝেই থাকে। জীবনের অধিকাংশ সময় ভ্রমণ করেই তারা কাটিয়ে দেন। অর্জন করেন বিরল অভিজ্ঞতা ও সম্মাননা। কিন্তু একই সঙ্গে যদি কারও উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু এবং সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ জয় করার গৌরব থাকে তবে তা নিঃসন্দেহে বিরল অর্জন। পৃথিবীর এমন গর্বিত মানুষটি হলেন স্যার এডমন্ড পার্সিভাল হিলারি। তিনি নিউজিল্যান্ডের একজন পর্বতারোহী এবং অভিযাত্রী ছিলেন। ১৯১৯ সালের ২০ জুলাই জন্ম গ্রহণ করা এই পর্বতারোহী ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মে তিনি ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলের অংশ হিসেবে নেপালী পর্বতারোহী শেরপা তেনজিং নোরগের সঙ্গে মাউন্ট এভারেস্ট শৃঙ্গ আরোহণ করেন। কমনওয়েলথ ট্রান্স-আটলান্টিক অভিযানের অংশ হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ মেরু পৌঁছান। পরবর্তীকালে তিনি উত্তর মেরু অভিযান করলে বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবীর দুই মেরু ও সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পদার্পণের দুর্লভ কৃতিত্ব অর্জন করেন।

 

মহাকাশ ভ্রমণে সর্বপ্রথম ব্যক্তি

[ইউরি আলেক্সিভিচ গ্যাগারিন]

সোভিয়েত বৈমানিক এবং মহাকাশচারী ইউরি আলেক্সিভিচ গ্যাগারিন (মার্চ ৯ ১৯৩৪-মার্চ ২৭ ১৯৬৮) সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি মহাকাশ ভ্রমণ করেন। তিনি ভস্টক নভোযানে করে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল পৃথিবীর কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেন।

কৈশোরেই গ্যাগারিন মহাকাশ এবং গ্রহ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার মহাকাশ যাত্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন।

গ্যাগারিন লম্বা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি ছিলেন, যা ছোট ভস্টক ককপিটে তার জন্য সুবিধাজনক ছিল। পৃথিবী থেকে ১৭৭ কিলোমিটার দূরের মহাকাশে একাকী গ্যাগারিনের ১০৮ মিনিটের কক্ষপথ ভ্রমণ ছিল চরম দুর্দশাপূর্ণ। তার তৃতীয় প্রজন্মের ‘ভস্টক-১’ রকেটের ন্যাভিগেশানাল নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত ছিল না। চরম সাহসের সঙ্গে তিনি সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন।

মহাকাশ ভ্রমণের জন্য ২৭ বছর বয়সেই গ্যাগারিন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নায়কে পরিণত হন এবং দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কার এবং পদক লাভ করেন।

 

প্রথম ইউরোপীয়র ভারত আবিষ্কার

[ভাস্কো দা গামা]

ভাস্কো দা গামা একজন পর্তুগিজ অনুসন্ধানী ও পর্যটক। পঞ্চদশ শতাব্দীতে সমুদ্রপথে তিনি ইউরোপ থেকে ভারতে আসেন। তিনিই প্রথম ইউরোপীয় সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ভারতে এসে উপস্থিত হন। এ ভ্রমণের মাধ্যমেই পর্তুগিজদের এশিয়া মহাদেশে দীর্ঘকালীন উপনিবেশ স্থাপনের পথ সুগম হয়েছিল। ভাস্কো দা গামা জন্মগ্রহণ করেছিলেন পর্তুগালের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে সিনেস নামক একটি জায়গায় ১৪৬০ কিংবা ১৪৬৯ সালে। ১৪৯৭ সালে লিসবনের উদ্দেশে সমুদ্রযাত্রা শুরু করে। ১৪৯৮ সালের ২ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত মোজাম্বিক দ্বীপের কাছে সময় অতিবাহিত করেন। এরপর ৭ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে মোম্বাসা বন্দরের পরিচয় পায়। ২৪ এপ্রিল দা গামা দলবলসহ মালিন্দি থেকে ভারত অভিমুখে রওনা হন। সেই বছরই ২০ মে ভাস্কো দা গামা নৌবহরসহ ভারতের কালিকটের নিকটবর্তী কাপ্পাডুতে এসে উপস্থিত হন। কালিকটের রাজা সামুদিরি (জামরিন) কমপক্ষে তিন হাজার সশস্ত্র নায়ের বাহিনীর শোভাযাত্রার মাধ্যমে জাহাজের নাবিকদের অভ্যর্থনা জানান।

 

৬ হাজার ঘণ্টা পানির নিচে

[সিলভিয়া আর্লে]

সিলভিয়া আর্লে শুধু প্রথম শ্রেণির সমুদ্র বিশারদই নন, দীর্ঘ ৬ হাজার ঘণ্টা সমুদ্রের নিচে অবস্থান করে রেকর্ড গড়েছেন তিনি। নাম সিলভিয়া আর্লে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ৩০ আগস্ট। কর্মজীবনে তিনি একাধারে মেরিন বায়োলজিস্ট, লেখক ও প্রভাষক। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে একটি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এক্সপ্লোরার এর সঙ্গে কাজ করছেন। আর্লে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ওষুধ ও এটমোজফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভের প্রথম নারী বিজ্ঞানী। ১৯৯৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনে প্রথম হিরো হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তিনি বন্য প্রাণী ও সমুদ্র রক্ষা গ্রুপে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেন। সমুদ্রের ৩৮০ মিটার গভীরে থেকে নিমিষেই আমেরিকার দৈনিক পত্রিকায় জায়গা করে নেন এই দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযাত্রী। ৭৬ বছর বয়সী আর্লে বর্তমানে সমুদ্র সংরক্ষণ অধিদফতরের স্টুয়ার্ড হিসেবে বহাল আছেন। এ ছাড়াও তিনি সমুদ্র গবেষণায় ব্যবহৃত সাবমেরিন তৈরি ও ডিজাইন কোম্পানির মালিক।

 

৬৫৭টি গ্রন্থ অনুবাদ

[হিউয়েন সাং]

হিউয়েন সাং ৬৫৭টি সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থ সংগ্রহ ও অনুবাদ করেন। তৎকালীন ভারতের বৌদ্ধ শাস্ত্রের ওপর সর্বোত্কৃষ্ট শিক্ষাই তিনি লাভ করেন। চীনা এই পরিব্রাজক অমায়িক ও বন্ধুত্ব সুলভ একজন ব্যক্তি। তিনি ইয়ানজি ও কুচা হয়ে কিরজিকিস্তানের রাজা তুর্ক খানের সঙ্গে দেখা করেন। অথচ তুর্কদের সঙ্গে তখনো তাদের যুদ্ধ চলছে। কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, সমরখন্দসহ আরও পশ্চিমে আমু দরিয়া এবং তিরমিজে পৌঁছান। সেখানে তিনি প্রায় এক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৬৩৮ সালে তিনি এই বাংলায় আসেন। বাংলাদেশের মহাস্থানগড় থেকে নওগাঁর সোমপুর বিহার পরিদর্শন করেন। তার বিবরণী থেকে জানা যায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ছিল প্রধানত কর্ণসুবর্ণের নিকটবর্তী  রক্তমৃত্তিকা, পুন্ড্রনগর ও এর সংলগ্ন এলাকা, সমতট ও  তাম্রলিপ্তি। তার বিবরণ বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ব্যাপক সহায়তা করে। কোথাও কোথাও তার বিবরণ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট হলেও সাত শতকের বাংলার ইতিহাস, বিশেষ করে শশাঙ্কের শাসনাধীন গৌড় রাজ্য সম্বন্ধে আলোকপাত করেন।

 

৭৫ হাজার মাইল পাড়ি

[ইবনে বতুতা]

একুশ বছর বয়স থেকে শুরু করে পরবর্তী ৩০ বছরে প্রায় ৭৫ হাজার মাইল পথ পাড়ি দেন মুহাম্মদ ইবনে বতুতা। তিনি সুন্নি মুসলিম পর্যটক, চিন্তাবিদ, বিচারক এবং সুন্নি ইসলামের মালিকি মাজহাবে বিশ্বাসী একজন ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৩০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। সারা জীবন তিনি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরেছেন।  তিনিই একমাত্র পরিব্রাজক যিনি তার সময়কার সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন এবং সুলতানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বর্তমান পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। ভ্রমণকালে তিনি এই উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সুফি, সুলতান, কাজি এবং আলেমদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৩০ বছরে প্রায় ৪০টি দেশ ভ্রমণ করে নিজ দেশে ফিরলে তখনকার সুলতান আবু ইনান ফারিস তার ভ্রমণকাহিনী লিপিবদ্ধ করার জন্য কবি নিয়োগ করেন।

 

বিনয় পিটক সংগ্রাহক

[ফা-হিয়েন]

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে বিখ্যাত চীন দেশীয় পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারত ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল বৌ" ধর্মপুস্তক ‘বিনয় পিটক’-এর মূল রচনা সংগ্রহ করা। এ ছাড়া ভারতে বৌদ্ধ তীর্থস্থান পরিদর্শন ও বৌদ্ধদের অবস্থা জানার ইচ্ছাও তার ছিল। ফা-হিয়েন গোবি মরুভূমির মধ্য দিয়ে প্রথমে খোটানের পার্বত্য অঞ্চলে উপস্থিত হন। সেখান থেকে তিনি পামির পর্বতমালা অতিক্রম করে সোয়াত ও গান্ধার প্রদেশ করে ভারতে পৌঁছেন। ভারতে তিনি পেশোয়ার, মথুরা, কনৌজ, শ্রাবন্তী, কাশি, কপিলাবস্তু, কুশীনগর, বৈশালী, পাটলিপুত্র এবং তাম্রলিপ্তে দুই বছর অতিবাহিত করেন। ভ্রমণ শেষ হলে তিনি তাম্রলিপ্ত বন্দর (বর্তমান তমলুক) থেকে সমুদ্রপথে সিংহল, মালয় এবং যবদ্বীপ থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ফা-হিয়েন এ দেশে তার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে একটি বিবরণ রেখে যান। ফা-হিয়েনের বিবরণ অনুযায়ী পাটলিপুত্র নগর ছিল সুরম্য অট্টালিকাগুলোতে সুসজ্জিত। জনসাধারণ ধনসম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। রোগীর চিকিৎসার দাতব্য চিকিৎসা ও বিনা পয়সায় ওষুধপত্র দেওয়া হতো।

 

হেঁটে বাগদাদ শহরে                        

[মার্কো পোলো]

একসময় হেঁটে হেঁটে বাগদাদ শহরে এলেন মার্কো পোলো। সে সময় বাগদাদই ছিল বিশ্বের সেরা নগরী। সঙ্গে ছিলেন তার বাবা-চাচা। ১২৫৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভেনিসে জন্মগ্রহণ করা মার্কো পোলোকে ইতিহাসের সেরা পরিব্রাজক হিসেবে সম্বোধন করা হয়।  তার জন্ম হয়েছিল কনস্টান্টিনোপলে। মার্কো পোলোর বয়স যখন সতেরো বছর তখন থেকেই মার্কো বাবার দুঃসাহসিক যাত্রার সঙ্গী হন। এখান থেকেই মার্কো পোলোর পৃথিবী ভ্রমণের যাত্রা শুরু হয়। এই শুরুর মাধ্যমেই মার্কো পোলো পরবর্তীকালে পৃথিবীর সেরা পর্যটকে পরিণত হন। অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তারা পৌঁছান আকর বন্দরে। তখন স্থলপথে যান্ত্রিক কোনো বাহন ছিল না। হেঁটে, খচ্চর বা উটের পিঠে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে পথ চলতে হতো। দূর ভ্রমণে পথিকদের ঘুমাতে হতো খোলা আকাশের নিচে। সে অভিজ্ঞতা অবশ্যই কষ্টকর। তবে মার্কোর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। রুক্ষতার মাঝেও ফুলেল সৌন্দর্য খুঁজে নিতে পারতেন তিনি। যে এলাকা ভ্রমণ করতেন তার সবকিছু ডায়েরিতে লিখে রাখতেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর