বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাগরে নিখোঁজ বেঁচে যাওয়া মানুষেরা

সাইফ ইমন

সাগরে নিখোঁজ বেঁচে যাওয়া মানুষেরা

স্যালভাদর অ্যালভারেঙ্গা

সাগরে সবচেয়ে বেশি সময় ভেসে থেকে বেঁচে থাকার রেকর্ড গড়েন জোসে স্যালভাদর। প্রশান্ত মহাসাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবিতে অনেক প্রাণহানি ঘটে। অবশ্য কেউ কেউ বেঁচে ফিরেও আসেন। কখনো প্রকৃতি সহায় থাকে আবার কখনো সাহস এগিয়ে দিয়ে যায়। ১৩ মাস সাগরে ভেসে বেড়ানোর পর স্যালভাদর অ্যালভারেঙ্গা ফিরে এসেছেন। সবচেয়ে বেশিদিন সাগরে টিকে থাকার এটাই বিশ্বরেকর্ড।

১৩ মাস পর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে বেঁচে ফিরে আসা হাঙরশিকারির অবিশ্বাস্য গল্প শুনে হতবাক হয়ে গেল সবাই। স্যালভাদর থাকতেন মেক্সিকোতে। ভেলারমিনো রডরিগুয়েজ নামের এক মহাজনের নৌকা নিয়ে সাগরে হাঙর শিকার করেন। ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে হাঙর শিকারের জন্য বেড়িয়েছিলেন। সঙ্গে ১৫ বছরের সহকারী ইজাকুয়েল কার্ডোভা। দিনে দিনে হাঙর শিকার করে ফিরে আসবেন। তবে সব ওলটপালট করে দিয়ে হঠাৎ সাগরের বুকে রাক্ষুসে ঝড়। ঝড়ের কবলে দিক হারিয়ে  ফেলে তাদের নৌকা। বিপদ যখন আসে তখন সবদিক দিয়েই আসে। নৌকার মোটরটা বিগড়ে যায়।

এরপর শুরু হয় ১৩ মাসের অপেক্ষা। খাবার ফুরিয়ে যায় অনেক আগেই। কাঁচা কিছু খেতে পারে না বলে প্রথম চার মাস পরেই সঙ্গের সঙ্গী মারা যায়। একসময় আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন।

নৌকাটা এভাবে ভেসে বেড়াল আট হাজার ৯০০ থেকে ১০ হাজার ৮০০ মাইল। এক সন্ধ্যায় দূরে তীর দেখে নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়লেন স্যালভাদর। সাঁতার কেটেই চলে গেলেন দ্বীপে। কোনো রকমে রাত কাটিয়ে দিলেন নারিকেল গাছের নিচে। সেটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে দক্ষিণের ক্ষুদ্র দ্বীপ ইবঅনে। ভোর হতেই চিৎকার শুরু করে স্যালভাদর। আশপাশের লোকজন ছুটে এসে উদ্ধার করে স্যালভাদরকে। ততদিনে তার শতচ্ছিন্ন হাফপ্যান্ট, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। লোকজন দেখেই একটু এগিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যান স্যালভাদর। তাকে উদ্ধার করে হানপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরিবারের লোকজনের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এর তেরো মাস আগে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন পাওয়া যায়নি স্যালভাদরকে, সবাই ধরে নিয়েছিল স্যালভাদর মারা গেছেন।

 

পুন লিমের অবিশ্বাস্য গল্প

পুন লিমের সাগরের বুকে বেঁচে থাকার ঘটনাটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অবিশ্বাস্য। ২৫ বছরের টগবগে যুবক পুন লিম। সময় তখন ১৯৪২। সাগরের বুকে দাপিয়ে বেড়ান তিনি। একটি ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজে  চাকরি করতেন। নভেম্বরের ২৩ তারিখে জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছিল কেপটাউন থেকে। এরপরই জাহাজটি গভীর সমুদ্রে গোলযোগের মুখে পড়ে। একসময় সেটি ডুবতে শুরু করে। অনেকেই আতঙ্কে জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু লাফিয়ে পড়ে যাবে কোথায়! চারদিকে শুধু সাগরের অথৈ পানি। কিন্তু পুন লিম ঝাঁপ দিলেন। একসময় জাহাজটি সম্পূর্ণ ডুবে যায়। বুদ্ধিমান পুন লিম বেঁচে থাকার জন্য জাহাজ থেকে কিছু রসদ সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। যা দিয়ে তিনি একটি ভেলা তৈরি করে তার ওপর ভেসে থাকতে পেরেছিলেন ১৩৩ দিন। আর অবিশ্বাস্য ঘটনাটি সবার সামনে আশার পর গোটা বিশ্ব হতবাক। এই ১৩৩ দিন প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন পুন লিম। সমুদ্রের মাছের রক্ত ছিল তার পানীয়। আর কাঁচা মাছ ছিল তার খাবার। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা সাঁতার ছিল তার নিয়মিত ব্যায়াম। এভাবেই নিজেকে রক্ষা করেছেন পুন লিম।

 

তিন বন্ধু নয় মাস সাগরে 

২০০৬ সালের ৯ আগস্ট একটি মাছ ধরার নৌকা প্রশান্ত মহাসাগরে চলার সময় নৌকার নাবিক একটু দূরে একটি অদ্ভূত জিনিস দেখতে পান। আগ্রহী হয়ে সেখানে যওয়ার পর তিনি যা দেখেন তার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না।

তিনি দেখেন যে, তিনজন লোক সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাও একটি ভাঙাচোরা নৌকায় করে। সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় নৌকার নাবিকের কাছে। উদ্ধার করা হয় তিনজনকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। এদের পরিচয় জানা যায়। এরা হলেন- এসুস ইডুয়ার্ডু ভিডানা, লুসিও র‌্যান্ডন এবং স্যালভাদর অর্দোনেজ। এই তিনজন জানান, মেক্সিকান বন্দর সান ব্লাস থেকে প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার বা ৫,০০০ মাইল দূরে তারা বন্ধুরা মিলে হাঙর-মাছ ধরার উদ্দেশে অভিযান চালান। তাদের নৌকাটি ছিল ৮ মিটার বা ২৭ ফুট। তারা শক্তিশালী ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন। বড় বড় ঢেউ আর বাতাসের কবলে পড়ে তাদের নৌকাটিকে ঠিকভাবে ধরে রাখতে পারছিলেন না। গভীর সমুদ্রের দিকে চলে গিয়েছিলেন তারা। একসময় নৌকার জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। স্রোতের ধাক্কায় নৌকাটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। কোনোমতে এটি সাগরের বুকে ভেসেছিল।  এরপর শুরু হয় তিন বন্ধুর জীবনযুদ্ধ। বেঁচে থাকার জন্য কাঁচা মাছ, পাখি ও বৃষ্টির পানি খেয়ে থাকতেন তারা। তাদের নৌকার তিনজন ক্রুকে তারা হত্যা করেছিলেন। কারণ যেন খাবারে ভাগ বেশি পাওয়া যায়। তাদের মৃতদেহ সমুদ্রে  ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই তিন বন্ধুকে যথেস্ট সুস্থ মনে হচ্ছিল। তাই উদ্ধার করা নৌকার নাবিক কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করে। তারা হয়তো পাচারকারী দলের সদস্য। কিন্তু এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তারা। স্বাস্থ্য ভালো থাকার কারণ হিসেবে তারা টুনা মাছ খেতেন বলে জানান।

 

অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় ওরা

২০১৭ সালের এপ্রিলে ঘটে যায় এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সাগরে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনজন। উত্তাল সাগর মোহনায় তিন ঘণ্টা নৌকার মাত্র কয়েক ইঞ্চি ফাঁকায় টিকে থেকে নিজেদের জীবন রক্ষা করেন তিন যুবক। এদের সবাই চট্টগ্রামের। সন্দ্বীপের গুপ্তচর ঘাট এলাকায় নৌকাডুবির ঘটনার তিন ঘণ্টা পর উত্তাল সাগরে উল্টে যাওয়া বোটের নিচ  থেকে কাকতালীয়ভাবে তিনজনকে উদ্ধার করেছিল কোস্টগার্ড।

এই তিনজনের একজন চট্টগ্রামের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করা মোহাম্মদ নাফিজ উদ্দিন (শান্ত)। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে দেওয়া তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তাদের সম্পর্কে। তিনি শোনান, জীবন-মৃত্যুর বিভীষিকাময় ঘুটঘুটে অন্ধকারে সাগরজলে যুদ্ধ করা তিন ঘণ্টার এক রোমহর্ষক কাহিনী। ৪০-৫০ জন যাত্রীর সঙ্গে ছিলেন তারা। মাঝির একগুঁয়েমিতে দ্বিগুণ যাত্রী  তোলা হয়েছিল। তারা ছিলেন তিন বন্ধু। অপর এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে  যোগ দিতে সন্দ্বীপ যাচ্ছিলেন। নৌকাটি যখন অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে এবং তীব্র বাতাস ও ঢেউয়ের আঘাত সইতে না পেরে উল্টে যায় তখন নাফিজসহ  মোট চারজন উল্টে যাওয়া নৌকার তলে আটকে যান। মাথার ওপর উল্টে যাওয়া  নৌকা আর কয়েক ইঞ্চি ব্যবধানেই সাগরের পানি। মুহূর্তে মুহূর্তেই পানি নাকে-মুখে ঢুকছে। আরও অবিশ্বাস্য হলো যে, একজন সাঁতার জানেন না। কোনোভাবে শরীরটা উল্টানো ইঞ্জিন নৌকার ফাঁকে আটকে গিয়েছিল। নৌকার সামান্য একটি ভাঁজ কোনোভাবে আঁকড়েও ধরেছিলেন তিনি। তিন ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর নৌকার তলা থেকে তাদের উদ্ধার করেছিলেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা। নৌকার তলানি থেকে ঢেউ আর বাতাসের শব্দে তাদের ডাক প্রথমে শুনতে পায়নি উদ্ধারকারীরা। ওই ঘটনায় ১৭ জন প্রাণ হারান।

 

৪৯ দিন পর জীবিত ফেরা

সাগরে ভেসে বেঁচে যাওয়া মানুষের তালিকায় যোগ হওয়া সর্বশেষ নামটি আলদির। ইন্দোনেশিয়ার এই তরুণ গভীর সাগরে ভেসেছিলেন টানা ৪৯ দিন। এরপর তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এই তরুণ বেঁচেছিলেন সমুদ্রের নোনা পানি এবং তার ভেলায় লাফিয়ে ওঠা মাছ খেয়ে। আলদির পুরো নাম আলদি নোভেল আদিলাং।

এই তরুণের বয়স ১৮ বছর। ইন্দোনেশিয়ায় কাঠ দিয়ে মাছ ধরার নৌকা বানানো হয়। এই নৌকা দিয়ে মাছ ধরার পদ্ধতিকে বলা হয় রমপং। এরকমই একটি নৌকায় থাকা অবস্থায় এই তরুণ ঝড়ে পড়ে ভেসে গিয়েছিলেন সাগরে। রমপং পদ্ধতিতে কাঠ দিয়ে একটি ভেলা তৈরি করার পর তার ওপর কুঁড়েঘরের মতো একটি ছোট কক্ষ বানানো হয়।  সেখানে একজন বা দুজন মানুষ থাকতে পারেন।

যে এই ভেলায় আলো জ্বলিয়ে রাখেন। যখন পানিতে  ঢেউয়ের তালে ভেলার সঙ্গে আলো দুলতে থাকে তখন সেই ভেলার ওপর মাছ লাফিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সেই মাছ ধরে সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পোস্ট পত্রিকার খবর অনুযায়ী সুলাবেসি দ্বীপের বাসিন্দা আলদি নোভেল আদিলাংয়ের কাজ ছিল রমপং বা ভেলায় আলো জ্বালানো। আদিলকে নিয়ে ভেলাটি ইন্দোনেশিয়ার উপকূল থেকে সাগরের ১২৫ কিলোমিটার গভীরে বাঁধা ছিল। এ ধরনের ভেলায় কোনো ইঞ্জিন বা বৈঠা ব্যবহার করা হয় না। অন্য নৌযান দিয়ে ভেলাটিকে গভীর সমুদ্রে নেওয়া হয়। গত ১৪ জুলাই সমুদ্রে প্রচণ্ড ঝড় হয়। সেই ঝড়ে ভেলাটির দড়ি ছিঁড়ে ভেসে যায়। ভেলাটি সমুদ্রের কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে ছিটকে যায়। অতিবাহিত হয় ৪৯টি দিন। 

সাগরে ৪৯ দিন ভেলায় করে আলদির সময় কেটেছে শঙ্কায় আর আতঙ্কে। এই তরুণ যে ভেলায় থাকতেন সেখানে প্রতি সপ্তাহে তাকে নিয়ম করে খাবার পৌঁছে দেওয়া হতো। ফলে তার সঙ্গে থাকা খাবার এবং পানি ফুরিয়ে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে সাগরের নোনা পানিই তাকে পান করতে হয়েছে। আর ভেলায় মাছ লাফিয়ে উঠলে সেটি ধরে খেতে হতো আলদির।

ভেলাটি সমুদ্রের কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে পাড়ি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ অঞ্চল গুয়ামের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে পানামার একটি জাহাজ ওই তরুণ আলদি নোভেল আদিলাংকে দেখতে পেয়ে তাকে

উদ্ধার করে। আলদিকে উদ্ধারের পর তাকে প্রথমে জাপানে  নেওয়ার অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছিল।

এই রমপং পদ্ধতি হচ্ছে মাছ ধরতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া আলদিকে উদ্ধারের পর জাহাজে তাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে গত ৬ সেপ্টেম্বর আলদি জাপানে পৌঁছয়।

সর্বশেষ খবর