শিরোনাম
রবিবার, ৫ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

অবিশ্বাস্য বেঁচে ফেরা

তানভীর আহমেদ ও সাইফ ইমন

অবিশ্বাস্য বেঁচে ফেরা

দুর্ঘটনার পর প্রকৃতির অলৌকিক খেলার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ঘটনা একেবারে কম নয়। পৃথিবীতে যত দুর্ঘটনা হয়েছে তাতে যোগ হয়েছে এমন সৌভাগ্যবান মানুষের নাম যারা ভয়ঙ্কর বিমান দুর্ঘটনার পরও প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরা মানুষকে নিয়ে আজকের রকমারি...

 

অলৌকিক মেয়ের বিস্ময়কর ফেরা

বাহিয়া বাকারি

মিরাকল গার্ল বা অলৌকিক মেয়ে বলে খ্যাতি তার বিশ্বজোড়া। নাম তার বাহিয়া। বিমানে করে ভারত মহাসমুদ্র পাড়ি দিচ্ছিল। ইয়েমেনিয়া ফ্লাইট ৬২৬-এর রুট ছিল সানা, ইয়েমেন থেকে মরনি, কামরুস। এ রুটে অনেক যাত্রী পরিসেবা প্রদানকারী বিমানের চলাচল। অন্যদিনের মতোই আকাশে পাখা মেলেছিল ইয়েমেনিয়া ফ্লাইট। ২০০৯ সালের ঘটনা। এয়ারবাস এ৩১০ উড়ে চলল ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে। হঠাৎ কারণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটির দিকে নেমে আসতে শুরু করে। ঝাঁকুনি বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে বিপদের আতঙ্ক রূপ নেয় মৃত্যুর শঙ্কায়। বিমানটি ঠিকই সমুদ্রে আছড়ে পড়ে। বিস্ফোরণ ঘটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে বিমানটি। যাত্রীদের প্রায় সবাই প্রাণ হারালেও বেঁচে যান অলৌকিকভাবে বাহিয়া বাকারি।

 

১১ দিন বনের গহিনে ছিলেন

জুলিয়ান ডিলার

জুলিয়ান ডিলারের বয়স তখন ১৭ বছর। ১৯৭১ সালের ঘটনা। তার বাবা-মা ছিলেন পরিবেশ বিজ্ঞানী। জুলিয়ান ডিলার যাচ্ছিলেন মায়ের সঙ্গে লেনসা ফ্লাইট ৫০৮ এ করে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। দুর্ঘটনায় পড়ার পর বিমানটি যখন ভূপাতিত হয় তখনই আগুন ধরে বিমানের সব যাত্রী মারা গিয়েছিল। কিন্তু একজন ছাড়া। তিনি এই জুলিয়ান ডিলার। বিমানটি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল তখন অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু আতঙ্কের দৃশ্যগুলো নিজের চোখেই দেখছিল জুলিয়ান ডিলার। বিমানটি মাটিতে পড়েই বিস্ফোরিত হয়ে যায়। বেঁচে ফেরে ১১ দিন একা একা আমাজন বনের গহিন অরণ্যে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছিল তাকে। এ ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে অনেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ নির্মাণ করা হয়েছে।

 

একাই বেঁচে ফেরে ৪ বছরের শিশু

সিসিলিয়া সিসান

সিসিলিয়া সিসান। বয়স তখন মাত্র ৪ বছর। ১৯৮৭ সালের ঘটনা। নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ২৫৫ আকাশে উড়েছিল। বিমানের টেকঅফ থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। ন্যাশনাল সেফটি রীতিগুলো না মেনেই আকাশে উঠতে শুরু করে বিমানটি। এর সঙ্গে যোগ হয় বিমানের ফ্ল্যাপ এবং স্ল্যাটস ঠিকমতো কাজ করছিল। যান্ত্রিক ত্রুটির সঙ্গে যোগ হয় ভুল উড়ান। সব মিলিয়ে টালমাটাল হয়ে পড়ে বিমানটি। আকাশে কোনোভাবেই থিতু হতে পারছিল না। কিন্তু যখন সবাই টের পেল বিমানটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু আতঙ্ক ছেয়ে যায় বিমানে। এ দৃশ্যগুলো নিজের চোখেই দেখছিল সিসিলিয়া। ১৫৪ জন যাত্রী নিয়ে উড়ে চলা বিমানটি মাটিতে পড়েই বিস্ফোরিত হয়ে যায়। এতগুলো মৃত্যুর মধ্যে একাই বেঁচে ফেরে ৪ বছরের সিসিলিয়া।

 

পরিবার নিয়ে ১৭ মাস সমুদ্রে বেঁচে ফেরা

রবার্টসন পরিবার

৩৮ দিনের জন্য গেলেও যাত্রাকাল দাঁড়ায় ১৭ মাসে। রবার্টসনের পরিবার এর মধ্যে সাগরে হারিয়ে ছিল অনেকদিন। রবার্ট ছিলেন একজন ব্রিটিশ ডেইরি চাষি। তিনি চেয়েছিলেন তার পরিবারকে একটি নৌভ্রমণে নিয়ে যেতে। ঘটনাটি ১৯৭১ সালের ২৭ জানুয়ারির। রবার্টসন তার বউ ও চার সন্তানকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৭২ সালের ১৫ জুন গালাপাগোজ দ্বীপে এসে তার পরিবার একদল ঘাতক তিমির হাতে পড়ে। তিমির দলের আক্রমণে রবার্টসনের নৌকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রত্যেকে লাইফবোটে ভাসতে থাকে। এরপর সঙ্গী হয় ছোট ডিঙি নৌকা। এ সময় তাদের হাতে থাকে মাত্র ছয় দিনের খাবার। তারপর তারা বৃষ্টির পানি খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকে। সমুদ্র থেকে কচ্ছপ শিকার করেও খায়। সেই নৌকায় তাদের পুরো পরিবার ধারণ করা ছিল খুবই অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবুও রবার্টসন পরিবার ভাসতে থাকে। এরপর ২৩ জুলাই ১৯৭২ সালে তারা আবিষ্কার করে একটি জাপানি জেলে নৌকা। তখন তাদের মুক্তি মেলে।

 

রানা প্লাজা ধসের পর সেই মেয়েটি

রেশমা বেগম

বাংলাদেশের সাভারে ধসেপড়া রানা প্লাজা থেকে প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন। এত সব দুশ্চিন্তা আর দুঃসংবাদকে পেছনে ফেলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রানা প্লাজা ধসের ১৭ দিনের মাথায় জীবিত উদ্ধার হন রেশমা। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা এরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে জীবিত থাকার ক্ষেত্রে রেশমার এ বেঁচে থাকা বর্তমানে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। তার চেয়ে বেশি সময় আটকে থাকার অভিজ্ঞতা কেবল দুজন মানুষেরই রয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া রেশমার প্রাণ বাঁচিয়েছে পানি। ধংসস্তূপের নিচে ৪১৬ ঘণ্টা আটকে ছিলেন রেশমা। সঙ্গে থাকা যৎসামান্য শুকনা খাবার ফুরিয়ে যায় অনেক আগেই। উদ্ধারকর্মীরা উপর থেকে নানা সময়ে বোতলজাত পানি বিভিন্ন সময় ফুটো দিয়ে ভিতরে পাঠাতেন। সেখান থেকে পানি খেয়েই বেঁচেছিলেন তিনি।

 

প্লেন থেকে বাতাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন

ভেসনা ভালভিক

ভেসনা ভালভিক হলেন পৃথিবীর ইতিহাসে বিমান দুর্ঘটনায় বেঁচে ফেরা অলৌকিক মানুষদের একজন। পেশায় রাজনৈতিক কর্মী, প্রাক্তন বিমানবালা ছিলেন তিনি। গিনেস বুকে তার নাম লেখা হয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকে পতনের পরও জীবিত থাকা মানুষ হিসেবে। ভেসনা ভালভিক ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে বাতাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তবুও তিনি প্রাণে বেঁচেছিলেন। এ অলৌকিক ঘটনা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। তিনি প্যারাসুট ছাড়াই মাটিতে নেমে এসেছিলেন। মাটিতে পড়ামাত্র তার শরীর দুমড়ে-মুচড়ে যায়। মেরুদন্ড ভেঙে যায়। টুকরো টুকরো হয়ে যায় হাড়। তবু শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিমান দুর্ঘটনার ঘটনাটি ঘটে ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি। ৩৩ হাজার ফুট উঁচুতে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারায়।

 

৬২ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার করা হয়

হ্যারিসন ওকান

২০১৩ সালের মে মাসে ডুবে যায় জ্যাকসন-৪ নামে একটি জাহাজ। আটলান্টিক মহাসাগরে ১০০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া সেই জাহাজ থেকে ঘটনার ৬২ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার করা হয় হ্যারিসন ওকানে নামে এক নাইজেরিয়ানকে। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি প্রকাশ পায়নি। কিন্তু পরবর্তীতে ওকানের অলৌকিকভাবে বেঁচে ফেরার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। পরে মার্কিন গণমাধ্যম অ্যাসোসিয়েট প্রেসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অলৌকিক সেই মুহূর্তের বর্ণনা দেন ওকানে। ডুবে যাওয়ার সময়টির কথা স্মরণ করে ওকানে বলেন, ‘জাহাজে থাকা অন্যদের চিৎকার আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম জাহাজটি ডুবে যাচ্ছে। আমি শুনেছিলাম একজন চিৎকার করে বলছেন, জাহাজটা ডুবে যাচ্ছে! অন্যরা মারা গেলেও আমি বেঁচে যাই অলৌকিকভাবে।

 

দুবার বিমান দুর্ঘটনার পরেও

অস্টিন হচ

দুটি বিমান দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মানুষের তালিকায় যার নাম আসবে তিনি অস্টিন হচ। অস্টিন হচ ২০০৩ সালে প্রথমবার এক মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনার পরও প্রাণে বেঁচে যান। মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া সেই ঘটনার বর্ণনা শুনলে সাহসী মানুষেরও বুক কেঁপে উঠবে। তখন সে একেবারে কিশোর বয়সী ছিল। একটি প্রাইভেট প্লেনে চড়ে বসেছিল সে। বিমানটি হঠাৎই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচের দিকে নাক রেখে নেমে আসতে শুরু করে। মাটিতে পড়েই বিস্ফোরিত হয়ে যায়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় অস্টিন ও তার বাবা। কিন্তু এরপর ২০১১ সালে একই রুটে আবারও বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিল অস্টিন। সেবার তার সঙ্গী হয়েছিলেন বাবা ও সৎ মা। আগেরবার মা ও আত্মীয় মারা গিয়েছিল, এবার তাকে হারাতে হলো বাবা ও সৎ মাকে। কিন্তু বেঁচে যান তিনি।

 

গুহার ভিতরে ১৭ দিন আটকে থাকা ১৩ জন

১২ কিশোর ফুটবলার, তাদের কোচ গুহার গভীরে আটকে ছিল ১৭ দিন। অভিযানের শেষ তিন দিন ছিল ভয়াবহ। শ্বাসরুদ্ধকর ৭২ ঘণ্টা অভিযানের পর উদ্ধার করা হয় আটকেপড়া ফুটবলার ও কোচকে। সব শেষে বেরিয়ে আসেন ৩ নেভি সিল এবং এক চিকিৎসক। আর তাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সমগ্র বিশ্ব। শিহরিত এ ঘটনা আসলে কোনো অ্যাডভেঞ্চার মুভির নয়, সম্প্রতি থাইল্যান্ডে ঘটে যাওয়া ঘটনা। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় থাইল্যান্ডের ‘থাম লুয়াং’ গুহার দিকে তাকিয়ে ছিল কোটি কোটি উদ্বিগ্ন ও কৌতূহলী চোখ। দেশ ও জাতি নির্বিশেষে সবাই এক প্রার্থনা করেছিল। সবার চাওয়া ছিল নিষ্পাপ শিশুগুলো যেন নিরাপদে মায়ের কোলে ফিরতে পারে। সৃষ্টিকর্তাও হয়তো এটাই চেয়েছেন। কোনো ক্ষতি ছাড়াই নিরাপদে ফিরে এসেছে আটকেপড়া কিশোর ফুটবলার ও তাদের কোচ। শেষ পর্যন্ত স্বস্তি পেল সবাই। এর আগে থাই আবহাওয়া ক্রুদ্ধ হতে শুরু করে। আশঙ্কা হচ্ছিল প্রবল বৃষ্টির। গুহার ভিতরে পানির উচ্চতা বাড়তে থাকলে উদ্ধার কাজ করা কঠিন হবে এ আশঙ্কায় রবিবারই উদ্ধার অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেই কথা সেই কাজ, প্রথম দিনই চারজনকে উদ্ধার করা হয়। দ্বিতীয় দিন সোমবার আরও চারজন এবং তৃতীয় দিন উদ্ধার করা হয় বাকি চারজন খুদে ফুটবলার এবং তাদের কোচকে। এটি ছিল আন্তর্জাতিক মানের অভিযান। আর এখানে থাই নৌসেনা ছাড়াও ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশের উদ্ধারকারী ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। প্রবল বৃষ্টি আর বন্যার কারণে উদ্ধার কাজ বারংবার ব্যর্থ হচ্ছিল। গুহায় ঠাসা পানিতে হামাগুড়ি দিয়ে সেই পথ পেরোতে বেগ পেতে হচ্ছিল ডুবুরিদের। অভিযান যখন শেষদিকে তখন আটকেপড়া খুদে কিশোরকে নিয়ে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়। মাত্র ১১ বছরের সেই খুদে ফুটবলার ছিল অত্যন্ত দুর্বল। সে কি পারবে ডুবুরির সঙ্গে প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে আলোর দেখা পেতে। অবশেষে উৎকণ্ঠা আশার বাণী নিয়ে আসে শেষ বেলায়। অন্ধকারের বুক চিরে এক উদ্ধারকারী বেরিয়ে এসে বলেন- ‘মিশন সাকসেস’। শ্বাসরুদ্ধকর সেই অভিযানে এক ডুবুরি তো অক্সিজেনের অভাবে প্রাণই হারান। এমতাবস্থায় সবাই শঙ্কায় ছিল যে, আদৌ কিশোর ফুটবলার এবং তাদের কোচকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে কিনা! চেষ্টার কমতি রাখেননি থাই উদ্ধারকারীরা। ২৩ জুন থেকে চলা অভিযান শেষ হয় ১০ জুলাই। পরিকল্পনামাফিক চলছিল উদ্ধারকাজ। অবশেষে রুদ্ধশ্বাস অভিযানে উদ্ধার করা হয় আটকে থাকা ১৩ জনকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর