রবিবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

নোবেল পুরস্কার ২০২২

নোবেল পুরস্কার ২০২২

নোবেল পুরস্কারের প্রচলন শুরু ১৯০১ সালে। চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে পুরস্কারগুলো সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামে ও তাঁর রেখে যাওয়া অর্থে প্রদান করা হয়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিভাগে ঘোষিত হয়েছে ২০২২ সালের নোবেল বিজয়ীদের নাম। এবার ছয়টি বিষয়ের ওপর দুই প্রতিষ্ঠানসহ সর্বমোট ১২ জন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।  সদ্য ঘোষিত ২০২২ সালের নোবেল জয়ীদের নিয়ে আজকের রকমারি। লিখেছেন- আবদুল কাদের

 

নোবেল জয়ের পরিসংখ্যান

অক্টোবর মানেই নোবেল পুরস্কারের মৌসুম। সুইডেন এবং নরওয়ের নোবেল কমিটি ছয় দিনে বিশ্বজুড়ে ছয়টি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে। একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে একজন বা একাধিক ব্যক্তি বা সংস্থার যুগান্তকারী অবদানের স্বীকৃতি দেয়। বিজয়ীরা একটি ডিপ্লোমা এবং একটি পদক পান। প্রতি বিজয়ীকে ১ কোটি সুইডিশ ক্রোনার (৯ লাখ ডলার) প্রদান করা হয়; যা একাধিক বিজয়ী হলে তাঁদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানী, লেখক, অর্থনীতিবিদ এবং মানবাধিকার নেতাদের বিশ্বের সবচেয়ে অভিজাত পুরস্কারের তালিকায় যুক্ত হন নতুন মুখ।

চলতি বছরের অক্টোবরের প্রথম সোমবার চিকিৎসাশাস্ত্রে পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় নোবেল পুরস্কার। তার পরে প্রতিদিনের নিরিখে মঙ্গলবার পদার্থবিদ্যা, বুধবার রসায়ন এবং বৃহস্পতিবার সাহিত্যে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালের শান্তিতে অবদানের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় গেল শুক্রবার এবং ১০ অক্টোবর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ২০২২ সালের নোবেল পুরস্কারের বিশদ কার্যক্রম। ১৯০১ সাল থেকে ২০২২ সাল; শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এভাবেই বিশ্বের এই পুরস্কারটির ঘোষণা দিয়ে আসছে নোবেল কমিটি।

নোবেল শান্তি পুরস্কার; যা অনেকের কাছেই বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত। ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্বের অসংখ্য বিজ্ঞানী, লেখক, অর্থনীতিবিদ এবং মানবাধিকার নেতাদের মধ্য থেকে সেরাদের সেরা নির্বাচিত করা হয়। আসুন জেনে নিই কতজন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, কতবার মহিলা বিজয়ী তাঁদের কাজের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং বিজয়ীরা কোন দেশ থেকে এসেছেন?

আল-জাজিরা গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রচলনের পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নোবেল বিজয়ী এসেছে ইউরোপ অঞ্চল থেকে। অভিজাত পুরস্কারটি ১২০ বছরের ইতিহাসে ৫২ শতাংশ নোবেল বিজয়ীর দেখা মিলেছে ইউরোপে। অঞ্চলটির বিজয়ী দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্স। এর পরের অবস্থানটি উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের। ৩২ শতাংশ নোবেল বিজয়ীর দেখা মিলেছে উত্তর আমেরিকা অঞ্চলগুলোয়। সেখানকার বিজয়ী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকো। এশিয়ার অঞ্চলগুলো থেকে এখন পর্যন্ত ৭ শতাংশ নোবেল বিজয়ীর দেখা মিলেছে। মহাদেশটির শীর্ষ বিজয়ী দেশগুলোর শীর্ষে আছে জাপান, চায়না ও ভারত। ৩ শতাংশ নোবেল বিজয়ীর দেখা মিলেছে আফ্রিকা মহাদেশগুলো থেকে। যেখানকার শীর্ষ বিজয়ী দেশের তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর এবং লাইবেরিয়া। ওশেনিয়া অঞ্চল থেকে ২ শতাংশ নোবেল বিজয়ী এসেছে। অঞ্চলটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি নোবেল বিজয়ীর দেখা মিলেছে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং পূর্ব তিমুরে। মাত্র ১ শতাংশ নোবেল বিজয়ীদের দেখা পাওয়া গেছে দক্ষিণ আমেরিকার অঞ্চলগুলোয়। সেখানকার বিজয়ী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চিলি ও কলোম্বিয়া।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, আলফ্রেড নোবেলের ইতিহাসে ১৯০১ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ক্ষেত্রবিশেষ এবং অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে ৬১৫ বার ৯৮৯ ব্যক্তি এবং সংস্থাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে ৯৫৪ জন এবং ২৭টি সংগঠন নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ একাধিকবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন পাঁচ ব্যক্তি এবং দুটি প্রতিষ্ঠান। ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৫১ জন নারী স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন; যেখানে পুরুষদের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংখ্যা ৮০৭ জন।

 

 

শান্তিতে নোবেল পেলেন বিয়ালিয়াৎস্কি এবং দুই দেশের দুই সংগঠন

এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে একজন ব্যক্তি ও দুই সংস্থাকে। বেলারুশের মানবাধিকার আইনজীবী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি এই পুরস্কার পেলেন রাশিয়ার মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল এবং ইউক্রেনীয় মানবাধিকার সংস্থা সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজের সঙ্গে।

নোবেল অ্যাসেম্বলি জানিয়েছে, পুরস্কারজয়ী ব্যক্তি ও সংগঠন নিজেদের দেশে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সংরক্ষণে কাজ করছেন। একই সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকাদের সমালোচানার পাশাপাশি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কাজ করছেন তারা। এতে বলা হয়, শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য নাগরিক সমাজের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন নোবেল জয়ী ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে নথি তৈরিতে তাঁরা দেখিয়েছেন অসাধারণ কর্মদক্ষতা। অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কির সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি ৮০-এর দশকের মাঝামাঝি বেলারুশে গণতন্ত্র আন্দোলনের সূচনাকারীদের একজন। বিয়ালিয়াৎস্কি তাঁর দেশে গণতন্ত্রের প্রচার ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়নে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু বেলারুশ কর্তৃপক্ষ বারবার তাঁর মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। রুশ মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়ালের বিষয়ে বলা হয়েছে, চেচেন যুদ্ধের সময় জনগণের বিরুদ্ধে রুশ ও রুশপন্থি বাহিনীর অত্যাচার এবং যুদ্ধাপরাধের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করেছে সংস্থাটি। ইউক্রেনীয় মানবাধিকার সংস্থা সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর সংস্থাটি ইউক্রেনের জনসাধারণের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ শনাক্ত ও নথিভুক্ত করায় নিযুক্ত হয়। এটি অপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।

 

সবাইকে চমকে সাহিত্যে নোবেল অ্যানি এর্নোর

এ বছরের সম্ভাব্য প্রতিযোগীদের মধ্যে ‘ফেভারিট’ তালিকায় ছিলেন আ্যনি এর্নো। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদি, কেনিয়ার লেখক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো, জাপানের হারুকি মুরাকামি ও নরওয়ের জন ফোসের মতো লেখক ও সাহিত্যিকদের হারিয়ে পুরস্কার জিতে নিয়েছেন এর্নো।

নোবেল অ্যাসেম্বলি জানিয়েছে, ‘সাহস ও পর্যবেক্ষণগত তীক্ষèতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্মৃতির সমষ্টিগত সংযম, বিচ্ছিন্নতাবোধ ও শিকড় অনাবৃত করার জন্য এর্নোকে পুরস্কৃত করা হয়েছে।’ ৮২ বছর বয়সী এ নারী নোবেল বিজয়ীর সাহিত্যকর্মগুলো অনেকাংশেই আত্মজীবনীমূলক। একই সঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে তাঁর লেখার ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। এর্নোকে পুরস্কৃত করার বিষয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘লিঙ্গ, ভাষা ও শ্রেণি সম্পর্কিত শক্তিশালী বৈষম্য দিয়ে চিহ্নিত জীবন তিনি ধারাবাহিকভাবে ও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে নিরীক্ষণ করেছেন। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘লে আরমোয়ার বিড’ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। ২০০৮ সালে ‘লে অ্যানি’ প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান এর্নো। এটি ২০১৭ সালে ‘দ্য ইয়ার্স’ নামে ভাষান্তরিত হয়। তাঁর লেখা নারী এবং শ্রমজীবী মানুষের জীবন থেকে উঠে এসেছে। যা সাহিত্যে খুব কমই চিত্রিত হয়েছে।

 

আর্থিক সংকট মোকাবিলা বাতলে নোবেল পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন বিজ্ঞানী

চলতি বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন অর্থনীতিবিদ। তাঁরা হলেন- বেন বার্নাঙ্কে, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ।

নোবেল অ্যাসেম্বলি জানিয়েছে, বেন বার্নাঙ্কে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ফিলিপ এইচ ডিবভিগ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নোবেল প্রাইজ ডট অর্গের ওয়েবসাইটে তাঁদের পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ব্যাংকিংবিষয়ক আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, সংকটের সময় ব্যাংকব্যবস্থা কীভাবে সুরক্ষিত রাখতে হয়। আবার ব্যাংক ধসে পড়লে কীভাবে আর্থিক সংকট ঘনীভূত হয়, তা-ও দেখা গেছে গবেষণায়। আর ১৯৮০-এর দশকে এসব গবেষণার সূত্রপাত করেন এই তিন অর্থনীতিবিদ। সঞ্চয়কারীরা তাৎক্ষণিকভাবে সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে চান। কিন্তু ব্যবসায়ী ও বাড়ির মালিকরা মেয়াদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা চান, অর্থাৎ তাঁদের মেয়াদের আগেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে না, সেই নিশ্চয়তা। ডায়মন্ড ও ডিবভিগ দেখিয়েছেন, ব্যাংক কীভাবে এই সমস্যার সেরা সমাধান দিতে পারে। অন্যদিকে ডায়মন্ড দেখিয়েছেন, সঞ্চয়কারী ও আমানতকারীর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে ঋণগ্রহীতার ঋণ যোগ্যতা নিরূপণে ব্যাংকের অবস্থান সবচেয়ে সুবিধাজনক। বেন বার্নাঙ্কে দেখিয়েছেন, বিপুলসংখ্যক আমানতকারী একসঙ্গে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার (ব্যাংক রান) কারণে কীভাবে অর্থনৈতিক সংকট গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। ব্যাংক ধসে পড়লে ঋণগ্রহীতাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি হারিয়ে যায় এবং শিগগিরই তা পুনরুদ্ধার করা যায়নি। সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে রূপান্তরের সক্ষমতা ব্যাহত হয়।

 

রসায়নে তিন বিজ্ঞানী

এ বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন তিন বিজ্ঞানী। রসায়ন বিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল জিতে নিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী ক্যারোলিন আর বার্তোজ্জি, কে ব্যারি শার্পলেস ও ডেনমার্কের মার্টেন মেলডাল।

নোবেল অ্যাসেম্বলি জানিয়েছে, ব্যারি শার্পলেস ২০০১ সালেও রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ২০০০ সালের দিকে ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’র ধারণাটি তৈরি করেন। এটি একটি সহজ ও নির্ভরযোগ্য রসায়ন, যেখানে রাসায়নিক প্রক্রিয়া বেশ দ্রুত ঘটে এবং অবাঞ্ছিত উপজাতগুলো এড়ানো সম্ভব। এর কিছুদিনের মধ্যে মার্টেন মেলডাল এবং ব্যারি শার্পলেস স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে এমন এক প্রক্রিয়া উপস্থাপন করেন যাকে ক্লিক কেমিস্ট্রির ‘মুকুট রত্ন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম দ্য কপার ক্যাটালাইজড অ্যাজাইড-অ্যালকাইন সাইক্লোঅ্যাডিশন। মার্জিত ও দক্ষ এই রাসায়নিক প্রক্রিয়া এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। ওষুধের উন্নয়ন, ডিএনএ মানচিত্র তৈরিসহ বিভিন্ন উপকরণ তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্যদিকে ক্যারোলিন আর বার্তোজ্জি ক্লিক কেমিস্ট্রিকে একটি নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন। কোষপৃষ্ঠের গুরুত্বপূর্ণ অথচ অধরা জৈব অণু গ্লাইক্যানসের মানচিত্র তৈরিতে তিনি জীবন্ত প্রাণীর অভ্যন্তরে কাজ করতে সক্ষম ক্লিক রিঅ্যাকশন তৈরি করেন। কোষের স্বাভাবিক রসায়ন ব্যাহত না করেই তার বায়োঅর্থোগোনাল রিঅ্যাকশনটি কাজ করে। এই রাসায়নিক প্রক্রিয়া এখন কোষের প্রকৃতি অন্বেষণ এবং জৈবিক প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হচ্ছে। বায়োঅর্থোগোনাল রিঅ্যাকশন প্রয়োগ করে গবেষকরা ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে ওষুধের মান উন্নয়ন করেছেন, যেগুলোর এখন ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা গেছে, রসায়নবিদরা দীর্ঘদিন ধরে ক্রমবর্ধমান জটিল অণু তৈরির চেষ্টা করছিলেন। ফার্মাসিউটিক্যালস গবেষণায়, প্রায়শই কৃত্রিমভাবে ঔষধি গুণাবলিসহ প্রাকৃতিক অণুগুলোকে পুনরুৎপাদন করা হয়। এই কাজটি প্রশংসনীয় হলেও সাধারণত সময়সাপেক্ষ এবং খুবই ব্যয়বহুল।

বুধবার (৫ অক্টোবর) এই পুরস্কারের জন্য যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ডেনমার্কের তিন বিজ্ঞানীর নাম ঘোষণা করে দ্য রয়েল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস।

 

চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল সুইডেনের সাভান্তের

চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শরীরতত্ত্বে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডেনের ড. সাভান্তে পাবো। নিয়ান্ডারথাল মানুষের জিন বিন্যাসের যে ‘অসম্ভব’ কাজের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল অর্জন করেন তিনি। সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট চিকিৎসাবিজ্ঞানে চলতি বছর বিজয়ী হিসেবে পাবোর নাম ঘোষণা করে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা গেছে, সুইডিশ বিজ্ঞানী সাভান্তে পাবো বর্ণনা করেছেন, নিয়ান্ডারথাল যুগের মানুষের বিলুপ্তির হাজার হাজার বছর পর তার ডিএনএর গঠন নকশা নতুন করে তৈরি করতে গিয়ে তিনি কী কঠিন সমস্যায় পড়েছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রাক-হোমো স্যাপিয়েন্স যুগের মানুষের সম্ভাব্য অবশেষের ক্ষয়, শত শত বছর ধরে ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সঙ্গে বসবাস এবং আধুনিক মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নিয়ান্ডারথাল মানুষের ডিএনএকে আবার এক জায়গায় জড়ো করার কাজটি হয়ে উঠেছিল প্রায় অসম্ভব। এই গবেষণার মাধ্যমে তিনি শুধু নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ-এর বিন্যাসই আবিষ্কার করেননি; তিনি একই সঙ্গে এর জিনোম এবং আধুনিক মানুষের মধ্যে সংযোগও খুঁজে পেয়েছেন। এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, হোমো স্যাপিয়েন্সের সঙ্গে নিয়ান্ডারথালদের যৌন সম্পর্ক ছিল এবং নিয়ান্ডারথালদের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটেছিল। এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবেই এই সুইডিশ গবেষককে বিশ্বের অসামান্য এই আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে।

 

পদার্থবিজ্ঞানে তিন বিজ্ঞানী

আলোর একক কণা ফোটন নিয়ে গবেষণায় বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে এবারের নোবেল পুরস্কার জয় করেছেন তিন দেশের তিন বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন ফরাসি বিজ্ঞানী অ্যালেইন অ্যাসপেক্ট, মার্কিন বিজ্ঞানী জন এফ ক্লসার ও অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী অ্যান্টন জেলিঞ্জার।

নোবেল অ্যাসেম্বলি জানিয়েছে, বেল ইনেকুয়ালিটির পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ ও কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট গবেষণায় অবদানের জন্য তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়। এই তিন বিজ্ঞানী বিজড়িত কোয়ান্টাম পর্যায়কে ব্যবহার করে যুগান্তকারী পরীক্ষা চালিয়েছেন, যেখানে দুটি ফোটন কণা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও একক কণার মতো আচরণ করে। এই বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন কোয়ান্টাম ইনফরমেশনের ওপর ভিত্তি করে নতুন প্রযুক্তি তৈরির পথ খুলে দিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা গেছে, অ্যালেইন অ্যাসপেক্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা দূর করার ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন। ফোটনের একটি যুক্ত কণার জোড়া তার উৎস থেকে নির্গত হওয়ার পরে তিনি পরিমাপক ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করতে সক্ষম হন, ফলে কণা দুটির নির্গত হওয়ার সময়কার যে অবস্থা বিদ্যমান ছিল তা পরবর্তী ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে না। জন এফ ক্লসার এমন একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন যা একটি ফিল্টারের দিকে দুটি যুক্ত ফোটনকে একযোগে ছুড়ে দিতে পারে, আর সেই ফিল্টারটি কণা দুটির মেরুকরণ পরীক্ষা করে। এর মাধ্যমে পাওয়া ফলাফল বেল অসমতার (বেল ইনইক্যুয়ালিটি) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং কোয়ান্টামবিদ্যার ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর সঙ্গে মানানসই। অ্যান্টন জেলিঞ্জার গবেষণা করেছেন বিযুক্ত কোয়ান্টাম অবস্থা নিয়ে। তাঁর গবেষণা দল কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন নামে একটি বিশেষ অবস্থা দেখিয়েছেন, যেখানে একটি কণা থেকে দূরের আরেক কণায় কোয়ান্টাম অবস্থার স্থানান্তর ঘটানো সম্ভব। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট বা জড়িত অবস্থা হলো এমন একটি ভৌত ঘটনা, যখন কণাগুলোর একটি একক গ্রুপ তৈরি হয়। এরা স্থানিক নৈকট্যকে পরস্পরের মাঝে সমান ভাগ করে নেয়। ফলে প্রতিটি কণার কোয়ান্টাম অবস্থা অন্য কণা থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় না। এনট্যাঙ্গলমেন্ট কোয়ান্টামবিদ্যার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য যা ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সে নেই।

 

যেভাবে আসে নোবেলের প্রচলন

১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়। বর্তমান পৃথিবীতে এটিই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। ১৯০১ সাল থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সফল এবং অনন্য সাধারণ গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক তুলনারহিত কর্মকাণ্ডের জন্য এ পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। মোট ছয়টি বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বিষয়গুলো হলো- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, অর্থনীতি, সাহিত্য এবং শান্তি। সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ১৮৯৫ সালে করে যাওয়া একটি উইলের মর্মানুসারে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয়। নোবেল মৃত্যুর আগে উইলের মাধ্যমে এ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে যান। শুধু শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় অসলো, নরওয়ে থেকে। বাকি ক্ষেত্রে স্টকহোম, সুইডেনে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। অর্থনীতি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোতে ১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে ১৯৬৯ সালে। আলফ্রেড নোবেল তাঁর উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। প্রতিবছর পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেককে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ ও নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক কিছু পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা। নোবেল পুরস্কার মৃত কাউকে দেওয়া হয় না। লরিয়েটকে অবশ্যই পুরস্কার প্রদানের সময় জীবিত থাকতে হবে। আলফ্রেড নোবেল, নোবেল পুরস্কারের প্রবক্তা। আলফ্রেড নোবেল ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে একটি প্রকৌশল পরিবারে জš§গ্রহণ করেন। তিনি একাধারে রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও একজন উদ্ভাবক ছিলেন। ১৮৯৪ সালে তিনি একটি লোহা ও ইস্পাত কারখানা ক্রয় করেন, যা পরে একটি অন্যতম অস্ত্র তৈরির কারখানায় পরিণত করেন। তিনি ব্যালাস্টিক উদ্ভাবন করেন, যা বিশ্বব্যাপী ধোঁয়াবিহীন সামরিক বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহƒত হয়। ৩৫৫টি উদ্ভাবনের মাধ্যমে তিনি জীবদ্দশায় প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক হন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ডিনামাইট। ১৮৮৮ সালে তিনি মৃতদের তালিকা দেখে বিস্মিত হন, যা একটি ফরাসি পত্রিকায় এ মার্চেন্ট অব ডেথ হু ডেড প্রকাশিত হয়। নোবেলের ভাই লুডভিগ মারা যান। এ নিবন্ধটি তাকে ভাবিয়ে তোলে এবং খুব সহজেই বুঝতে পারেন যে, ইতিহাসে তিনি কীভাবে স্মরণীয় হতে চান, যা তাঁকে তাঁর উইলটি পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত করে। ১০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে আলফ্রেড নোবেল তাঁর নিজ গ্রাম স্যান রিমো, ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। নোবেল তাঁর জীবদ্দশায় অনেক উইল লিখে গিয়েছিলেন। সর্বশেষটা লেখা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে ২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫ সালে প্যারিসে অবস্থিত সুইডিশ-নরওয়ে ক্লাবে। বিস্ময় ছড়িয়ে যায়, নোবেল তাঁর সর্বশেষ উইলে উল্লেখ করেন যে, তাঁর সব সম্পদ পুরস্কার আকারে দেওয়া হবে- যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে কাজ করবেন। নোবেল তাঁর মোট সম্পদের (৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা) ৯৪ শতাংশ এ পাঁচটি পুরস্কারের জন্য উইল করেন। ২৬ এপ্রিল, ১৮৯৭-এর আগ পর্যন্ত সন্দেহপ্রবণতার জন্য নরওয়ে থেকে এই উইল অনুমোদন করা হয়নি। নোবেলের উইলের সমন্বয়কারী রগনার সোলম্যান ও রুডলফ লিলজেকুইস্ট নোবেল ফাউন্ডেশন তৈরি করেন, যার কাজ তাঁর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। নোবেল পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়ার জন্য তাঁর মোট সম্পত্তির শতকরা ৯৪ ভাগ দান করে যান। এর মোট পরিমাণ ৩১ মিলিয়ন এসইকে (৩.৪ মিলিয়ন ইউরো, ৪.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর