সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীদের পদত্যাগ কাহিনি

► দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পদত্যাগে বাধ্য হন ১২ প্রধানমন্ত্রী ► স্ক্যান্ডাল নয়তো জনপ্রিয়তা হারানোয় বেজেছে বিদায় ঘণ্টা ► দলীয় প্রধানের পদও ছাড়তে হয়েছে

তানভীর আহমেদ

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীদের পদত্যাগ কাহিনি

১০ নম্বর ডাউনিং ছাড়তে হবে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে

এ যেন অতিথি ভবন!

লন্ডনের ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। গত ছয় বছরের ব্যবধানে চার প্রধানমন্ত্রী এলেন আর গেলেন।  লোকে রসিকতা করে বলছে, ‘এখন এ যেন অতিথি ভবন!’

ব্রেক্সিটের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে টিকতে পারেননি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ২০১৬ সালে পদত্যাগ করেন। তার জায়গায় আসেন তেরেসা মে। ব্রেক্সিট বিলে সই করা নিয়ে সংকটে জড়িয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। তেরেসা মে সরে যাওয়ার পর বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ব্রেক্সিট বিলে সই করে হইচই ফেলে দেন। কিন্তু করোনা মহামারি সামলাতে না পারা, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা হ্রাস ও নানা ধরনের স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে বিদায় ঘণ্টা বাজে তারও। পদত্যাগ করেন তিনি। তার জায়গায় তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে আসেন লিজ ট্রাস। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার অঙ্গীকার নিয়ে এসে ভরাডুবি ঘটে তার। ভুলের খেসারত দিতে নিজ অর্থমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তাতেও কুল রক্ষা হয়নি। সমালোচনার তোড়ে পদত্যাগ করেন। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দরজা দিয়ে বছর বছর এভাবেই প্রধানমন্ত্রী আসছেন আর বিদায় নিচ্ছেন। ছয় বছরের ব্যবধানে পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী খুঁজছে যুক্তরাজ্য।

 

৪৫ দিনের প্রধানমন্ত্রী

ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে লিজ ট্রাস হচ্ছেন সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতায় ছিলেন ৪৫ দিন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় তার প্রথম অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেংকে যে মিনি বাজেট দেন তাতে ব্যাপক কর ছাঁটাইয়ের কথা ছিল। কিন্তু এর জন্য অর্থসংস্থান করতে সরকারকে হাজার হাজার কোটি পাউন্ড ঋণ নিতে হতো। এ বাজেট ঘোষিত হওয়ার পরপরই তা অর্থ খাতে নজিরবিহীন সংকট সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের দর পড়ে যায়, তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া-এসব যুক্ত হয়ে ব্রিটেনের অর্থনীতির সংকট মাত্র অল্প কয়েক দিনের মধ্যে এক গুরুতর চেহারা নেয়। পদত্যাগ করেন তার অর্থমন্ত্রী। ট্রাসের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এর পর থেকেই কনজারভেটিভ এমপিরা এক-দুজন করে লিজ ট্রাসের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করতে থাকেন, উঠতে থাকে তার পদত্যাগের দাবি। তার নিজ দলের এমপিদের মধ্যে আস্থা ও সমর্থন হারিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন।

 

 

ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তারা

এ পর্যন্ত অনাস্থা ভোটে বিদায় নিয়েছেন ১১ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। বিশ শতকে ১২ জন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।  সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় টিকলেন মাত্র ৪৫ দিন...

নেভিল ক্যামবারলেইন (কনজারভেটিভ) : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার পর পদত্যাগ করে গা-বাঁচান তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিন বছর  (১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সাল) ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।

উইনস্টন চার্চিল (কনজারভেটিভ) : দ্বিতীয় দফা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন চার্চিল। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন ৩ বছর ১৬২ দিন।

অ্যান্থনি এডেন (কনজারভেটিভ) : ১৯৫৭ সালে সুয়েজ সংকটে পড়ে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিলেন মাত্র ১ বছর ২৭৯ দিন।

হ্যারল্ড ম্যাকমিলান (কনজারভেটিভ) : ১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন তিনি। সমালোচিত প্রোফিউমো স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ৬ বছর ২৮২ দিন ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিলেন তিনি।

মার্গারেট থ্যাচার (কনজারভেটিভ) : ১৯৯০ সালের নভেম্বরে বিদায় ঘণ্টা বাজে শক্তিশালী রাজনীতিবিদ ও আয়রন লেডি-খ্যাত প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের। নিজ দলে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ভোটাভুটিতে ভরাডুবি হয় তার। ১১ বছর ২০৯ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।

জন মেজর (কনজারভেটিভ) : সাত বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। কিন্তু জনপ্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী টনি ব্লেয়ারের কাছে সাধারণ ভোটে হেরে বসেন। ১৯৯৭ সালের ২ মে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।

টনি ব্লেয়ার (লেবার) : কনজারভেটিভ প্রার্থীকে হারিয়ে আলোচনায় আসেন টনি ব্লেয়ার। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় ছিলেন লেবার পার্টির প্রধান। এমন শক্তিশালী অবস্থানে থাকা অবস্থাতেও কপাল পোড়ে তার। ইরাক হামলায় যুক্তরাজ্যের অংশগ্রণের কারণে তার জনপ্রিয়তার পারদ নেমে যায়। সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করতে হয় তাকে। ১০ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।

গর্ডন ব্রাউন (লেবার) : দুই বছর ৩১৯ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনে হেরে বসেন। তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দলীয় প্রধানের পদ- দুটো থেকে পদত্যাগ করতে হয় তাকে।

ডেভিড ক্যামেরন (কনজারভেটিভ) : ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসতে চায় ব্রিটেন। ব্রেক্সিট নিয়ে তখন আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। ব্রেক্সিটে নাম লেখাবেন না ক্যামেরন  কিন্তু গণভোট পড়ে ব্রেক্সিটের পক্ষে। ছয় বছর ৬৪ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু ব্রেক্সিট ইস্যু আর সামলাতে পারেননি। ২০১৬ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।

তেরেসা মে (কনজারভেটিভ) : ব্রেক্সিট থেকে বের হয়ে আসতে চায় ব্রিটেন। এ নিয়ে টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়েন এই প্রধানমন্ত্রী। ‘ব্রেক্সিট উইথড্রয়াল এগ্রিমেন্ট’ বিল পাস করতে ব্যর্থ হন তিনি। বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় তার। তিন বছর ১২ দিন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন তিনি। তারপরই পদত্যাগ করতে হয় তাকে।

বরিস জনসন (কনজারভেটিভ) : একের পর এক স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েছিলেন বরিস জনসন। এ কারণে দলের ভিতরেই সমালোচিত হন তিনি। নিজ দলেরই সাপোর্ট হারিয়ে বসেন এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। ২০২২ সালের ৭ জুলাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিলেন ৩ বছর ৪৫ দিন।

লিজ ট্রাস (কনজারভেটিভ) : কথা দিয়েছিলেন অর্থনৈতিক মন্দা থেকে ব্রিটিশদের বাঁচাবেন। কিন্তু অর্থপরিকল্পনায় তার সিদ্ধান্তে পরিস্থিতি হয়ে উঠল আরও কঠিন। আস্থা ও জনপ্রিয়তা হারালেন দ্রুত। মাত্র ৪৫ দিন ক্ষমতায় টিকতে পারলেন লিজ ট্রাস। তারপর পদত্যাগ করেন।

সর্বশেষ খবর