রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বের কুখ্যাত মাদক মাফিয়ারা

আবদুল কাদের

বিশ্বের কুখ্যাত মাদক মাফিয়ারা

এল চ্যাপো (পিচ্চি)

দুর্ধর্ষ মাদকসম্রাট ও মেক্সিকোর মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান

অনেকেই জ্যাকুলিন আর্কিভালদো গুজমান লোয়েরা নামটির সঙ্গে পরিচিত নন। অন্যদিকে এল চ্যাপোকে (পিচ্চি) অসংখ্যবার সংবাদের শিরোনাম হতে দেখেছেন। গুজমানই মেক্সিকোর মাদকসম্রাট ‘এল চ্যাপো’। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটিকে দেখলে সাদাসিধে বা নিরীহ বলেই মনে হবে! কিন্তু তিনি একজন ভয়ানক খুনিও। যিনি নিজেই ছিলেন সিনালোয়া কার্টেলের রাজা। সূত্রমতে, প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে পাচারকৃত মাদকের বৃহত্তম উৎস এল চ্যাপোর সন্ত্রাসী গ্রুপ। কোকেন, মারিজুয়ানা, মেথামফেটামিন এবং হেরোইন; সবই পাচার করত এই মাদকসম্রাট। তার চাচা ছিলেন মেক্সিকান মাদক চোরাচালানকারীদের একজন। অল্প বয়সে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন গুজমান। ১৯৫৭ সালে গুয়াদালাজারা কার্টেলের সঙ্গে যুক্ত হন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ জগতে তার প্রভাবও বাড়তে থাকে। আশির দশকে তিনি হয়ে ওঠেন মেক্সিকোর মাদক ত্রাস। বলা হয়, ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদকের চালান প্রবেশ করেছিল; যার পেছনে জড়িত ছিলেন গুজম্যান। ২০০৬ সালে কার্টেলে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। জানা গেছে, ৬০ হাজারের বেশি হত্যা আর ১২ হাজারের বেশি অপহরণের সঙ্গে তিনি জড়িত।  ২০০৯ সালে এই মাদকসম্রাট ফোর্বসের সেরা ধনীর তালিকায় উঠে আসেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন এই কুখ্যাত অপরাধী।

 

দাউদ ইব্রাহিম

সাধারণ এক ছেলে থেকে আন্তর্জাতিক মাফিয়া

বিশ্বের শীর্ষ মাফিয়াদের তালিকায় সবার ওপরেই থাকবেন ভারতীয় উপমহাদেশের মাদকসম্রাট কিংবা মাফিয়া দাউদ ইব্রাহিম। তবে অপরাধ জগতে প্রবেশের শুরুটা হয়েছিল ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই দিয়ে। তারপর পকেটমার, পাড়ায় পাড়ায় মারপিট। ধীরে ধীরে অপরাধ জগতের সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। মুম্বাইয়ের কার্ণক বন্দরে এক ব্যাংক ডাকাতির পরেই শহরের সংবাদমাধ্যমের নজরে আসেন এই মাফিয়া ডন। এর আগে ডি-কোম্পানি নামের একটি অপরাধ চক্র গড়ে তোলেন তিনি। জানা গেছে, ৫ হাজারের বেশি সক্রিয় সদস্য রয়েছে এই মাফিয়া চক্রের। মুম্বাইয়ে ১৯৯৩ সালে বোমা বিস্ফোরণ, ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ের বোমা হামলাসহ আরও কয়েকটি বড় হামলার পেছনে দাউদ ইব্রাহিমের হাত ছিল। ১৯৯৩ সাল থেকেই পলাতক তিনি।  যুক্তরাষ্ট্র তাকে ‘গ্লোবাল টেররিস্ট’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ২০০৩ সালে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার সম্পদ ক্রোকের প্রস্তাব দেয় জাতিসংঘ।

 

পাবলো এসকোবার

মাদকসম্রাট থেকে হয়েছিলেন কলম্বিয়ার রবিনহুড

যদি কাউকে কুখ্যাত মাদকসম্রাট এবং পাশাপাশি গরিবের রবিনহুড হিসেবে ধরা হয়, তিনি হবেন পাবলো এসকোবার। আশির দশকের কলম্বিয়ার কুখ্যাত মাদকসম্রাট তিনি। যিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন কোকেন মেডেলিনসহ অনেক মাদকের রাজ্য। পাশাপাশি তাকে ‘কলম্বিয়ান রবিন হুড’ও মানা হতো। কেননা তিনি এক দশক ধরে কলম্বিয়ায় ১২ হাজার দরিদ্র মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধাসহ বাড়ি, স্কুল আর হাসপাতাল  সুবিধা প্রদান করেছিলেন। অন্যদিকে তার কোনো শত্রুই তার হাত থেকে নিস্তার পেত না। কয়েকটি উৎস ধারণা করছে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ মাদক পাচার ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। বলা হয়, প্রতিদিন ১৫ টন মাদক পাচারে জড়িত তার নিয়ন্ত্রিত এসকোবার গ্রুপ। এখানেই শেষ নয়, আশির দশকে কলম্বিয়া সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বিদের নির্মূল ও দুর্নীতিকে উসকে এসকোবার বিশ্বের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তখন তিনি ১০ বিলিয়ন ডলারের মালিক বনে যান। অপরাধ রাজ্যে তিনি ছিলেন ত্রাস। একবার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে হত্যার উদ্দেশ্যে তিনি একটি বিমানে বোমা স্থাপন করেন। যদিও ওই বিমানে সেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন না।  তবে বোমা বিস্ফোরণে ১১০ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। শেষ পর্যন্ত এসকোবারকে ৪ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যার জন্য দায়ী করা হয়। পরে দেশটির সেনাবাহিনীর এক সন্ত্রাসী অভিযানে এসকোবার নিহত হন। সম্প্রতি তাকে নিয়ে নেটফ্লিক্স একটি টিভি সিরিজও প্রকাশ করেছে।

 

গ্রিসেল্ডা ব্লাঙ্কো

গ্রিসেল্ডা সর্বকালের নির্মম মাদকসম্রাজ্ঞী

সব মাদক চোরাচালানির সম্রাট কেবল পুরুষ নন, গ্রিসেল্ডা ব্লাঙ্কোকে সর্বকালের নির্মম মাদকসম্রাজ্ঞী বলা হয়। যার ডাক নাম ছিল ‘লা মাদ্রিনা’ বা ‘গডমাদার’। তিনি ছিলেন মেডিলিন কার্টেলের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব এবং পাবলো এসকোবারের অন্যতম সহযোগী ও পরামর্শদাতা; যদিও শেষ পর্যন্ত তার শত্রুতে পরিণত হন। ২০০৬ সালে কোকেন কাউবয় নামে একটি প্রতিবেদন বের হলে প্রথম দেশের সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন কোকেনের মূল শিকড় এই মাদকসম্রাজ্ঞী। নকশাদার অন্তর্বাসে লুকিয়ে কোকেন পাচারের জন্য তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। অনুমান করা হয়, আশির দশকে প্রতি মাসে তার আয় ছিল ৮০ মিলিয়ন ডলার। অন্য নারী মাফিয়াদের সঙ্গে তার পার্থক্য এখানেই যে, তিনি মৃত্যু পছন্দ করতেন। তার হাতে খুন হয়েছে ২০০ মানুষ। ১১ বছর বয়সে তিনি প্রথম একটি ছেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেন এবং চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে তাকে খুন করেন। শুধু তাই নয়, গ্রিসেল্ডা খুন করেন তার সাবেক স্বামীকেও। অপরাধ জগতে তার নাম দেওয়া হয় ব্ল্যাক উইডো বা কালো বিধবা। এ ছাড়া আড়াই শর বেশি খুনের প্ররোচনায় সম্পৃক্ত ছিলেন গ্রিসেল্ডা। এমনকি তিনি জন এফ কেনেডি জুনিয়রকে অপহরণের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে পুলিশের কাছে ধরা পড়লেও ২০০৪ সালে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। ২০১২ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন এই নারী সম্রাজ্ঞী।

 

মারিয়া লিওন

মাদক চোরাচালান থেকে হত্যা- সবই করতেন

অপরাধ জগতে আরেক নারী সম্রাজ্ঞী মারিয়া লিওন। তৎকালীন লস অ্যাঞ্জেলেসের মাদক চোরাচালানির মূল হোতা ছিলেন এই নারী মাফিয়া। শহরের অলিগলিতে সংঘটিত সব অবৈধ কার্যক্রম আর অপরাধ জগতের কর্তৃত্ব ছিল কেবল তার হাতে। মাদক চোরাচালান থেকে সুপার কিলিং, হিউম্যান ট্রাফিকিং- সব জায়গায় তার নাম নানাভাবে জড়িয়ে আছে। তবে ব্যক্তিজীবনে ১৩ সন্তানের জননী মারিয়া লিওন। ২০০৮ সালে লস অ্যাঞ্জেলেসে পুলিশের গুলিতে মারিয়ার ছেলে ড্যানি নিহত হয়। তখন থেকেই ছেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন মারিয়া। এদিকে প্রশাসনও উঠেপড়ে লাগে মারিয়াকে গ্রেফতার করার জন্য। আর সে কারণেই লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকা মারিয়ার কাছে আর নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। গা ঢাকা দেওয়ার জন্য চলে আসেন মেক্সিকোতে। কিন্তু ছেলের শেষকৃত্যে শামিল হতে গিয়ে ধরা পড়ে যান মারিয়া। আদালতে মারিয়ার আট বছরের সাজা হয়। পরবর্তী সময়ে মারিয়াসহ ওই গ্রুপের অনেক সদস্যই ধরা পড়েন।

 

ক্যারিলো ফুয়েন্তেস

মেক্সিকোর মাদকসম্রাট ‘লর্ড অব দ্য স্কাইস’

যুক্তরাষ্ট্রে কোকেন নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘জেট লাইনার’ ব্যবহার করার কারণে তিনি ‘লর্ড অব দ্য স্কাইস’ নামে পরিচিতি পান। তার আসল নাম আমাদো ক্যারিলো ফুয়েন্তেস। অল্প বয়স পর থেকেই তিনি মাদক চোরাচালানির সঙ্গে জড়িত। ভাবছেন কীভাবে! কারণ তিনি ছিলেন আর্নেস্তো ফনসেকা ক্যারিলো ওরফে ‘ডন নেটো’র ভাগ্নে। যিনি গুয়াদালাজারা কার্টেলের একজন নেতা। ১৯৭০ সালে জুয়ারেজ কার্টেলের অধিপতি বনে যান। তবে এর আগে ক্যারিলো তার বসকে হত্যা করেছিলেন। এরপর জুয়ারেজ কার্টেল দখল করেন, যা পরবর্তীকালে উত্তর মেক্সিকোর প্রধান মাদক পাচারকারী সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। একজন অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ব্যবসায়ীর মতো আচরণ করতেন। আশির দশকের শেষ দিকে দেশটির আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। জীবনের শেষ দিকে এসে এই মাদকসম্রাট মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের নজরে আসেন। তার মাদক পাচার রাজত্ব এতটাই বড় হয়েছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের একজন ড্রাগ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ক্যারিলো একটি গুরুতর ভুল করেছেন। তিনি খুব বড়, খুব কুখ্যাত হয়েছিলেন। গ্রেফতার এড়াতে ক্যারিলো প্লাস্টিক সার্জারিও করিয়েছিলেন। জটিল ওই প্লাস্টিক সার্জারির সময় মারা যান মেক্সিকোর ‘লর্ড অব দ্য স্কাইস’। ক্যারিলোর মৃত্যুর কিছুদিন পর সার্জারিতে অংশ নেওয়া দুই চিকিৎসকের লাশ মেলে হাইওয়েতে। তারা আততায়ীর হাতে খুন হন।

 

ওসিয়েল কার্ডেনাস গুইলেন

গাড়ি মেকানিক থেকে মাদকসম্রাট

ছিলেন গাড়ি মেকানিক; করেছেন পুলিশে কাজ। কিন্তু ১৯৯৯ সালে আকস্মিক মেক্সিকোতে গাল্ফ কার্টেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন ওসিয়েল কার্ডেনাস গুইলেন। রাতারাতি বনে যান মেক্সিকোর অন্যতম মাদকসম্রাট। তবে এর আগে বন্ধু সালভাদর গোমেজকে হত্যা করে ‘মাতা অ্যামিগোজ’ (বন্ধুর হত্যাকারী) হিসেবে পরিচিতি পান। গাল্ফ কার্টেল ওসিয়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালীন টনকে টন কোকেন-মারিজুয়ানা পাচার করেন। এর মাধ্যমে তিনি গড়ে তোলেন বিশাল এক মাদকসাম্রাজ্য। পরবর্তীতে তা বিস্তৃত হয়েছিল দক্ষিণ টেক্সাসের রিও গ্র্যান্ডে উপত্যকা এবং অন্যান্য অঞ্চলে। ২০০১ সালের জুনে আটলান্টায় জব্দ হওয়া মাদক বলে দেয় যে, উপসাগরীয় ওই কার্টেল থেকে কেবল আটলান্টায় সাড়ে তিন মাসে ৪১ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মাদক পাচার হয়েছিল। এখানেই থামেননি ওসিয়েল। মেক্সিকান সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন ‘দ্য জেডস’। এই বাহিনী তার দেহরক্ষীর কাজ করত। ২০০৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে দ্য জেডস উপসাগরীয় কার্টেল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

 

রোসেটা কুটোলো

প্রথমে ছিলেন নিরীহ এবং ধর্মভিরু

কুখ্যাত মাফিয়া রাফায়েল কুটোলোর বোন এই মাদকসম্রাজ্ঞী। তিনি ইতিহাসের কুখ্যাত নারী মাফিয়া রোসেটা কুটোলো। যিনি মাদক জগতে ‘সিস্টার অব রাফায়েল’ নামে পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া ‘আইস অব আইস’ বলা হতো তাকে। প্রথম জীবনে নিরীহ আর ধর্মভীরু ছিলেন রোসেটা। গোলাপ চাষ করে জীবিকানির্বাহ করতেন। তার ভাই রাফায়েলের কারণে পরবর্তীকালে রোসেটা হয়ে ওঠেন ভয়ংকর মাফিয়া। তার ভাই মাদকসম্রাট রাফায়েল জীবনের অধিকাংশ সময় জেলেই বন্দি ছিলেন। জেলবন্দি থাকা অবস্থায় মাদক চোরাচালান ব্যবসার দায়িত্ব নেন রোসেটা। জেল থেকে রাফায়েল যে নির্দেশ এবং পরামর্শ দিতেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন রোসেটা। পথের কাঁটাকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা করতেন না এই নারী। নির্দেশ এবং পরামর্শ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতেন। মাদক চোরাচালানির পাশাপাশি ফুলের চাষও অব্যাহত রেখেছিলেন। ফলে সহজেই পুলিশের চোখ এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন রোসেটা। প্রায় ১৩ বছর পলাতক থেকে ১৯৯৩ সালে নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন দুর্ধর্ষ এই নারী।

সর্বশেষ খবর