বুধবার, ১০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিদায় সমরেশ মজুমদার

শামছুল হক রাসেল

বিদায় সমরেশ মজুমদার

না-ফেরার দেশে চলে গেছেন সমরেশ মজুমদার। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল দুই বাংলার জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের। নিয়মিত লিখেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের ঈদসংখ্যা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ বিশেষ বিশেষ আয়োজনে।  ঢাকায় এলেই আসতেন বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয়ে। বিভিন্ন সময় আড্ডা-সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাঁর ব্যক্তিজীবন, সাহিত্যজীবন, সমাজদর্শন ও নানা ভাবনা। প্রিয় লেখকের বিদায়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের এ বিশেষ আয়োজন।

 

কথার কারখানার মূল উপাদান মানুষ

সমরেশ মজুমদারের জন্মকালে বাতাসে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদের গন্ধ। উপমহাদেশও উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউয়ে। এমন কঠিন একটি সময়ে বড় হওয়া, উত্তরবঙ্গকে দেখা, জিলা স্কুল, কলকাতায় আসা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা- সামগ্রিকভাবে সমরেশ মজুমদারের মনন ও কথন একটি আলাদা জগৎ তৈরি করেছিল। কথিত সেই জগতে তাঁর ভৌগোলিক সীমা ছিল উত্তরবঙ্গ ও কলকাতায়। যেখানে ডুয়ার্সের জঙ্গল অবলীলায় ভেসে উঠত। ভেসে উঠত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়ার গল্প। একটা সময় উত্তরবঙ্গ-কলকাতা পেরিয়ে বাংলাদেশ এমনকি রাজধানী ঢাকার অনেক চিত্র পাওয়া যেত তাঁর লেখায়। বলতে গেলে ভৌগোলিক কোনো সীমা নয়, বরং সমরেশের কথার কারখানার মূল উপাদান মানুষ। সেই মানুষকে দেখার ক্ষেত্রে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল দারুণ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সমরেশ বসুদের পরবর্তী সময়ের লেখক সমরেশ মজুমদারের প্রথম গল্প ‘দৌড়’ ১৯৭৫ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর পরের দশকে সমরেশ মজুমদার একের পর এক স্মরণীয় ছোটগল্প, বড় গল্প, উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। তবে সমরেশ মজুমদারকে বাঙালি পাঠক বেশি মনে রাখবে তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’- এর জন্য।

সমরেশ মজুমদারের ছেলেবেলা ও ব্যক্তিজীবনের অনেক ঘটনা প্রভাব ফেলেছে তাঁর লেখায়। তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় প্রত্যেকের ছেলেবেলা কমবেশি একই রকম কাটে। যারা খুব অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে বড় হয়েছে আর যারা অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সুবিধার মধ্যে বড় হয়েছে তাদের জীবন আলাদা। তবে অধিকাংশ সাধারণ মানুষের জীবন একই রকম। আমার ছেলেবেলায় দুঃখ-কষ্ট খুব বেশি বুঝতে পারিনি। আমার মায়ের হয়তো বছরে আটটি দামি শাড়ি কেনার কথা কিন্তু সন্তানদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে দেখা গেল তিনি দুটি শাড়ি কিনেছেন। এটা বুঝতে পারি যখন আমি আয় করতে শিখি তখন। কিন্তু তখন কিছুই করার ছিল না। তত দিনে আমার বাবা-মা প্রয়াত। তখন অদ্ভুত একটা পাপবোধ আসে। ওদের জন্য এখন আফসোস হয়। আমি তাদের কাছ থেকে কেবলই নিয়েছি দিতে পারেনি কিছুই।’

 

মিল আছে অনিমেষের ভাবনায়

অনেকেই বলে থাকেন উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষের অনেক চরিত্রের সঙ্গে মিল আছে সমরেশ মজুমদারের জীবনের। সত্যিই মিল আছে কি? একটা উপন্যাসের সঙ্গে মিল আছে। সেটা বোধহয় খুব আলোচিত হয় না। উপন্যাসটির নাম ‘এখনো সময় আছে’। একজন লেখককে নিয়ে কাহিনি। তার সঙ্গে সমরেশের খুব মিল আছে কারণ নায়কের মানসিক কথা ফুটে উঠেছিল সেখানে। ওই উপন্যাসের মূল চরিত্র শহর থেকে দূরে চলে গিয়েছিল সমুদ্রের ধারে এক বাংলো কিনে। একা থাকতেন। তার কাছে একটি মেয়ে এলো। আশ্রয় মানে একটা রাতের আশ্রয়, পরদিন চলে যাবে। ওখানে কোনো হোটেল নেই। ভদ্রলোক মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নাম কি। মেয়েটি বলেছিল আমি যে নামই বলব আপনি সেটাকেই বিশ্বাস করবেন। আপনার না মেনে কোনো উপায় নেই। প্রশ্ন করা হয়েছিল, তোমার ঠিকানা কি? বলেছিল উত্তরে, আমি যা বলব তাই আপনি বিশ্বাস করবেন। আমাকে জায়গা দিন। আমার অতীতটাকে নিয়ে কেন টানছেন... এই মিলের গল্পটা সমরেশ মজুমদার নিজেই বলেছিলেন। এ ছাড়া যারা বলে অনিমেষের সঙ্গে তাঁর মিল আছে, বলতে পারেন অনিমেষের ভাবনার সঙ্গে তাঁর মিল আছে। তাই তো এক আড্ডায় সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, ‘অনিমেষের জীবনযাপনের সঙ্গে কোনো মিল নেই। ভাবনার মিল আছে।’

 

একটা জনপ্রিয়, অন্যটা গুরুগুম্ভীর

সমরেশ মজুমদার প্রায়ই বলতেন, ‘আগে সাহিত্য ও সাংবাদিকতা দুটো আলাদা জগৎ ছিল। সাহিত্যে কখনো সাংবাদিকতা আসত না এবং সাংবাদিকতাও কখনো সাহিত্যে মিশত না। ধীরে ধীরে বিষয়টা এমন পর্যায়ে চলে এলো যেখানে সাংবাদিকতা সাহিত্যে চলে এলো এবং সাহিত্যও সাংবাদিকতায় চলে এলো। এখন নাটকীয় ভাষায় সাংবাদিকতার চর্চা হচ্ছে। একটা গল্প গল্প ভাব চলে এসেছে। সাংবাদিকতায় সাহিত্য জুড়ে বসেছে। আগে ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হতো সরাসরি। লেখালেখির নান্দনিক সৌকর্যের জায়গাটা, কলাকৌশলের জায়গাটাও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তন তো হচ্ছেই।’ উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি আরেকটু বিশদ বললেন। বললেন,  ‘৫০-৬০ দশকে আমরা যে আধুনিক বাংলা গান শুনতাম, শ্যামল, সুধীন আর মান্না দে... মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনত। এখন ওদের জায়গায় যারা রয়েছেন তাদের গান হয়তো কিছু তরুণ ছেলে শোনে, কিন্তু তাদের রেকর্ড বিক্রি হয় না। সব দিক দিয়ে একটা পরিবর্তন, আমি খারাপ ভাষায় বলব না, একটা নিম্নমুখী হচ্ছে। পরিবর্তন তো ভাষার ক্ষেত্রেও হচ্ছে। একসময় সাধু ভাষায় সাহিত্য রচিত হতো, বঙ্কিম বাবু লিখতেন। তারপর শরৎচন্দ্র লিখতে আরম্ভ করলেন, লোকে গালাগাল করত, বলত ওরা সাহিত্যকে একদম ঠাকুর ঘর থেকে বের করে বাইরের ঘরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই গালাগাল টিকেনি। রবীন্দ্রনাথ আমাদের চলতি ভাষায় সাহিত্য লিখেছেন। একসময় তিনি কিন্তু বঙ্কিমী ভাষায় লিখেছেন। তারপর বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর যে পরিবর্তনটা করলেন সেটা কথ্য ভাষা। কিন্তু কথ্য ভাষা হলেও সেটা কিন্তু সংবাদপত্রের ভাষা না। আমরা সেই দৃষ্টান্তটাই বহন করে চলেছি। গত তিন-চার দশকে দুটি ধারার কথা যদি আমরা বলি, একটা জনপ্রিয় লেখার ধারা, অন্য ধারাটা গুরুগুম্ভীর।

 

রাজনৈতিক দর্শন

ঊনসত্তর, সত্তরের অস্থির রাজনৈতিক সময় কালবেলা লিখেছিলেন সমরেশ মজুমদার। কেউ কেউ এ উপন্যাসে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ খোঁজার চেষ্টা করেন। তিনি কখনো সরাসরি অস্বীকার করেননি এ বিষয়টা। বিষয়টাকে তিনি রাগ বা জেদের মতো ভাবতেন। তাই তো তিনি বলেছিলেন, দেখুন, সে রকম একটা বয়স হয়তো সবারই ওপর দিয়ে গেছে। আমারও ছিল। যারা এস্টাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে, একটা জেদ, একটা রাগ প্রকাশের প্রবণতা থাকে। আর সেই এস্টাব্লিশমেন্টটা যদি আমাদের ঠিকঠাক সাহায্য না করে রাগটা আরও বেড়ে যায়। এটা বোধ হয় আজকের আঠারো, বাইশ, তেইশ বছরের ছেলেমেয়ের মধ্যেও আছে। আমি কখনো রাস্তায় নেমে উঁচু কণ্ঠে স্লোগান দিইনি। সেটা ছিল ১৯৭৯-৮৪ সময়কাল। তখন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাধর। সেই সময় আমি যখন লিখলাম- সিপিএম নকশাল আন্দোলনের পেছনে ছুরি মেরেছে। লেখাটা কিন্তু বেরোলো আনন্দবাজারে, দেশ পত্রিকায়। লক্ষ লোক এই পত্রিকা পড়ে। এই লেখাটা লেখার সময় কিন্তু ভয় আসেনি মনের মধ্যে যে এটা লেখার পরের দিন আমাকে কেউ মারতে আসবে বা সরকার আমাকে জেলে পুরবে। এভাবেই তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর মতামত।

 

কফির লোভে লেখালেখি

লেখার জগতে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই নাকি প্রবেশ করেছিলেন সমরেশ মজুমদার। ঢাকায় এলে একাধিক আড্ডায় তিনি খুব জোরালোভাবে কথাটি বলতেন। এমনি এক আড্ডায় সমরেশ মজুমদার বললেন, আমার বয়স তখন ২২ কি ২৩ বছর, স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ি। আমি থিয়েটার করতাম। আমাদের গ্রুপের জন্য একবার একটা স্ক্রিপ্টের প্রয়োজন পড়ল। তখন আমার এক বন্ধু বলল, ‘তুই লেখ, চেষ্টা করলে ভালো কিছু করতে পারবি।’ বন্ধুর কথায় সায় দিয়ে নাটক লিখলাম। কিন্তু সেটা মনঃপূত না হওয়ায় আমাকে গল্প লিখতে বলল। আমি নাটকটিকে গল্পে রূপান্তর করলাম। প্রথমে দেশ পত্রিকায় পাঠালাম। কিন্তু ছাপানো হয়নি। আমার লেখা না ছাপানোর কারণে সেই বন্ধু ওই পত্রিকার সম্পাদকের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করল। অবশেষে কাগজে ছাপালাম। সেখান থেকে আমাকে ১৫ টাকা দেওয়া হলো। আমি তো মহাখুশি। বন্ধুরাও পারে তো আমাকে মাথায় তুলে নাচে। ওই টাকা নিয়ে সবাই মিলে গেলাম কফি হাউসে। বন্ধুরাও বলল, ‘তুই আবার লেখ, তাহলে আবার টাকা পাবি।’ আমিও কফি খাওয়ার লোভে আবার লিখলাম। এবার দেওয়া হলো ৫০ টাকা। সেখান থেকে ২৫ টাকা খরচ করে কফির সঙ্গে জলখাবারও খেলাম।

বলতে পারেন কফির দাম মেটাতেই লেখালেখি শুরু করি।’

 

রবীন্দ্রজয়ন্তীতেই প্রয়াণ

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই সঙ্গে ছিলেন সমরেশ মজুমদার। একসময় প্রায় নিয়মিত কলাম লিখেছেন এই দৈনিকে। শরীর আগের মতো সবল না থাকায় মাঝে নিয়মিত লেখায় ছেদ পড়েছিল। তবে ঈদসংখ্যায় লিখে গেছেন নিয়মিত। পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ আয়োজনেও লিখে গেছেন। এবারের বাংলাদেশ প্রতিদিন ঈদসংখ্যায় যে লেখাটি তিনি দিয়েছিলেন, এটি ছিল সমরেশ মজুমদারের সর্বশেষ লেখা। কথা ছিল উপন্যাস লিখবেন। শরীর সায় না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত গল্পই পাঠাতে পেরেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা সব ঠিক থাকলে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় থাকার কথা ছিল সমরেশ মজুমদারের। রোজার মধ্যেই পরিকল্পনা ছিল মে মাসের শুরুর দিকে ঢাকায় আসবেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম দেশের বাইরে থাকায় পরিকল্পনায় বদল আসে কিছুটা। এর মধ্যেই অসুস্থতা বেড়ে যায় তাঁর। তাঁর কথানুযায়ী, ঢাকা ক্লাবের গেস্ট হাউসে জানিয়ে রাখা হয়। ঢাকায় এলে এখানেই থাকতেন তিনি। ঢাকা ক্লাব গেস্ট হাউসের কর্মীদের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্র্ক। সমরেশ মজুমদার সকালের নাশতায় অল্প দুধ দিয়ে কর্নফ্লেক্স খেতেন। তিনি যখন গেস্ট হাউসের রেস্টুরেন্টে সকালে নামতেন, দেখতেন অর্ডারের আগেই তাঁর কর্নফ্লেক্স রেডি।

একবার এক আড্ডায় সমরেশ মজুমদার জানিয়েছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরম ভক্ত। কিন্তু তিনি সেটা খুব বেশি প্রকাশ করতেন না। জানতে দিতেন না। কিন্তু কেন? তাঁর ভাষায়- ‘এগুলো বলার কি আছে? একটা সময় আমার বিছানার তোশক এবং বালিশের নিচেও রবীন্দ্রনাথের বই থাকত। প্রচুর পড়তাম। তাই এই ভালোবাসা অন্যরকম। সব ভালোবাসা ঢোল পিটিয়ে বলতে হয় না।’ এমন রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষটির নিয়তি রবীন্দ্রজয়ন্তীকেই বেছে নিল তাঁর অন্তিমযাত্রায়। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন সমরেশ মজুমদার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর