বুধবার, ১০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
স্মৃতির পাতা থেকে...

‘সেই বাবলু আর আমার মধ্যে বিস্তর ফারাক

‘সেই বাবলু আর আমার মধ্যে বিস্তর ফারাক

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে অনেকবারই কথা বলেছেন সমরেশ মজুমদার। একান্ত সাক্ষাৎকারের সেসব কথোপকথন এখন শুধুই স্মৃতি। সমগ্র জীবনের অর্জন থেকে শুরু করে লেখালেখি, বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন টানা চার দশকের বেশি সময় লিখে যাওয়ার গল্প।  সেসব সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ নিয়েই এ আয়োজন- স্মৃতির পাতা থেকে।  ছবি : জয়ীতা রায়

 

চার দশকের বেশি সময় জুড়ে লেখালেখি...

লেখালেখি করছি প্রায় ৫০ বছর ধরে। এ তো আর কম সময় নয়। এটা এ রকম একটা ব্যাপার, আপনাকে একটা ঘোড়ার ওপর উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘোড়াটা দৌড়াচ্ছে, আপনাকে লাগামটা ধরে রাখতে হবে। আপনি যদি না পারেন, যদি আলস্য এসে যায়, তাহলে আপনি পড়ে যাবেন। বলে না, বাঘের পিঠে চাপা সহজ, কিন্তু নামা সহজ নয় এ রকমই একটি অবস্থা। ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম পাঁচ বছর বাদ দিলে থাকে ৪৫ বছর, ওই ৪৫ বছর ধরে আমার একটা মান রেখে লিখে যেতে হচ্ছে। সেটা ধরে রাখা অত্যন্ত ক্লান্তিকর।

 

কালজয়ী সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় মৌষলকাল...

আসলে ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ আমার লেখালেখি জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। এই উপন্যাসত্রয়ীর জনপ্রিয়তা ও পাঠকদের ভালোবাসা মাথায় রেখে ‘মৌষলকাল’ লিখেছিলাম...। এখানে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের পর যে প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল তা তুলে ধরেছি। আরেকভাবে বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সমস্যা ও রাজনৈতিক বেড়াজাল তুলে ধরেছিলাম এখানে।

 

নিজের প্রিয় উপন্যাস কোনটি? উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, সাতকাহন না অন্যটি?

বলা খুব মুশকিল। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমার মা বেশি প্রিয়, আমার স্ত্রী বেশি প্রিয়, আমার বড় পিসিমা যিনি আমাকে মানুষ করেছেন তিনি বেশি প্রিয়? নাকি আমার দুই কন্যা বেশি প্রিয়? আমি কি জবাব দিতে পারব?

 

তাহলে মাধবীলতা বা দীপাবলি এটার মধ্যেও কি ভেদাভেদ করতে পারেন না?

সব একই শেড। মাধবীলতা সকালবেলার চা খায়, বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, দীপাবলি বিকালে অফিস থেকে ফিরে এসে রান্নাবান্না করে, খাবার দিয়ে বলে খাও, পার্থক্য নেই।

 

ছোটবেলার সমরেশের গল্প...

আমরা যখন ছোট, এই যেমন ৮ বছর ১০ বছর বয়স, ফুটবল খেলতাম। ফুটবল অনেক সময় পেতাম না। জাম্বুুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম। চেনেন জাম্বুরা? আমরা বাতাবি লেবু বলতাম। সেই ফুটবল খেলার মাঠে দু-একজন দর্শক থাকত। তখন আমার ডাক নাম ছিল বাবলু। সেদিনের সেই বাবলু আর আজকের আমার মধ্যে বিস্তর ফারাক।

 

আপনার জীবনে রবীন্দ্রনাথ...

আমার কোনো ঈশ্বর নেই। আমি জন্মসূত্রে হিন্দু। কিন্তু কেন হিন্দু আমার বাবা তা ব্যাখ্যা করতে পারেনি, আমার পিতামহ ব্যাখ্যা করেননি। আমি ঘুম থেকে ওঠে ঘুমাতে যাওয়া অব্দি সময়টার মধ্যে কোনো ধর্মাচরণ করতে দেখিনি বাবাকে। এই ভাবতে ভাবতে আমি জানলাম- আমার একজন ঈশ্বর আছেন, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ। এসব কথা সেভাবে কোথাও বলি না। তিনি প্রতি মুহূর্তে আমাকে বাঁচার রসদ জোগান। যখনই দুঃখ পাই, আমি গীতবিতান খুলি, যখন সুখ পাই তখনো গীতবিতান খুলি এবং আমি উজ্জীবিত হয়ে উঠি। লহ, লহ, আরও লহ। রবীন্দ্রনাথ সামনে আছেন, আমি নিই। আমি কেন, অনেকেই নেন। 

 

বর্তমান প্রজন্মের লেখা কেমন লাগে?

আমি খুঁজে খুঁজে তরুণদের লেখা পড়ি। তাদের লেখার সঙ্গে ভাবনা বিনিময় করি। তরুণদের লেখায় সাধারণ মানুষের ঘামের গন্ধ পাই। চারপাশের মানুষের কথা জানতে চাই। তবে তথ্যমূলক সাহিত্য আমাকে প্রভাবিত করে না এবং তাতে আমার আসক্তিও নেই। তরুণদের লেখায় আমি নানা বৈচিত্র্য খুঁজে পাই। তাদের লেখায় খুঁজে পাই ছন্দ। তাদের বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ দেখে আমার ভালো লাগে। এ আগ্রহের মাত্রাকে বাড়াতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, তরুণদের হাত ধরে আমাদের সাহিত্য অনেক এগিয়ে যাবে।

 

বাংলাদেশের লেখকদের লেখা...

এখানে আমার অনেক প্রিয়জন রয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক এদের লেখা নিয়মিত পড়ি। প্রয়াতদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক আমার প্রিয়। অন্যদিকে আজও আমি ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘খোয়াবনামা’ কিংবা ‘জীবন আমার বোন’ মন দিয়ে পড়ি। এসব লেখা আজীবন থাকবে। হুমায়ূনের হঠাৎ প্রয়াণ আমাদের বিশেষ ক্ষতি করল। শামসুর রাহমান আমার প্রিয় বন্ধু ছিল। তাঁর লেখা আজীবন মানুষ পড়বে। আমি বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদের কথাও বলতে চাই। সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ এঁরা বাংলা সাহিত্যকে অনেক দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।

 

অনেক পুরস্কার-সম্মাননা পেয়েছেন, নিজেকে সার্থক মনে করেন?

পুরস্কার পেলে আমার হাসি পায়। মনে হয় আমি এর যোগ্যই নই। আমাকে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকেও পুরস্কৃত করা হয়েছে। আমার বোধ হলো যে, আমি কী লিখেছি যে পুরস্কৃত করা হবে! বরং রফিক আজাদ আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল, চলে গেছে। ওকে যে পুরস্কৃত করা হয়েছে লাইফ টাইম হিসেবে আমি খুব গর্ব অনুভব করেছি। কারণ রফিক তো আর লিখবে না, লেখার কথাও না। ও যা লিখেছে তার জন্য ওকে সম্মান জানানো উচিত। আমি এমন কিছুই লিখিনি যে, পুরস্কৃত হব, হওয়ার কথা বা উচিত।

সর্বশেষ খবর