সোমবার, ১৫ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়ংকর পর্যটন কেন্দ্র

আবদুল কাদের

ভয়ংকর পর্যটন কেন্দ্র

অ্যালনউইক গার্ডেন [ইংল্যান্ড]

‘আমাদের আশপাশে এমনও স্থান রয়েছে যা সবুজায়নে ভরপুর। তবুও অভিযাত্রীদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ এক বাগান তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়’- বলেন ইংল্যান্ডের নার্থাম্বারল্যান্ড রাজ্যের ডাচপত্নী জেন পার্সি। অ্যালনউইক প্রাসাদের বাগানটি বিশাক্ত তিনি তা নিশ্চিত করেন। ডাচ রাজার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাগানটিকে পার্সি প্রথমে তুচ্ছভাবে নেন। সত্যিকার অর্থে বাগানের কিছু অংশ যে বিষাক্ত, তা তার চিন্তার বাইরে ছিল। বাগানের জমির কিছু অংশ ব্যক্তিগত চিকিৎসক বা আরোগ্যকারীর সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখান থেকে মূলত চিকিৎসার জন্য ওষুধ তৈরির গাছগাছালি সংগ্রহ করা হতো। পার্সি বুঝতে পারেন এই বাগানে মূলত অবসর সময় কাটানোর জন্য নয়, কারণ এটা বিষক্রিয়ায় পরিপূর্ণ একটি বাগান। অ্যালনউইক প্রাসাদের বাগানের অংশটুকু একটি বিষাক্ত বাগান হিসেবেই পরিচিত। এ জন্য এখানে আসা দর্শনার্থীদের সম্পূর্ণ সতর্কীকরণ করে বাগানের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাগান থেকে একধরনের বিষাক্ত গ্যাস বের হয়, যা কারও নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলেই জমদূত হাজির। এই অভিশপ্ত স্থানটিতে ভ্রমণ করতে আসা অনেক দর্শনার্থীই জীব-উদ্ভিদের বিষ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অনেকেই দুর্বল হয়ে পড়েন। ইতিহাসে এমন কিছু অদ্ভুত স্থানের সন্ধান পাওয়া যায়, যা কি না বিধাতার তুরুপের তাস হিসেবে বলা হয়। আজব হলেও সত্য, এ বাগানটি বিষক্রিয়া হওয়ার আগে এখানে সারিবদ্ধ অনেক গাছ ছিল। ডাচ-রানির অন্য সব জমির মধ্যে ওই জমিটি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখানে নারিকেল ও ক্যানাবিস নামের গাছ রোপণ করা হয়। বাগানটির সৌন্দর্য় বাড়ানোর জন্য এখানে কিছু খেলার সরঞ্জাম ও শিক্ষণীয় বস্তু স্থাপন করা হয়। স্কুলগামী বাচ্চারা এখানে খেলা করতে আসত। কিন্তু অনেক বাচ্চা অত্যন্ত বিরক্ত ও অসুস্থ হয়ে যেত।

 

হাওয়াই ভলকানো [যুক্তরাষ্ট্র]

ভলকানোর মতো পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণের আকর্ষণ সবারই থাকে। হাওয়াই ভলকানো হচ্ছে আগ্নেয়গিরির পাশে অবস্থিত পার্ক। তবে এর প্রতিটি পরতে পরতে মৃত্যু রেকর্ড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এ ছাড়া ভলকানো ন্যাশনাল পার্কটি অস্থায়ী বাইসাইকেল ভ্রমণের স্থান। ২০০৭ সালে উদ্বোধনের পর থেকে তিনটি নিহত ও রেকর্ড সংখ্যক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পর্যটকরা এখানে বাইসাইকেল চালাতে আসেন। রাস্তাগুলো সরু-খাড়া-নিচু প্রকৃতির। মৃত্যু তখনই হাতছানি দেয় যখন বাইসাইকেল নিচু রাস্তার দিকে ধাবিত হয়। অনেকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এটাই যে একমাত্র বাধা তা কিন্তু নয়! ১৯৯২ থেকে ২০০২, এই ১০ বছরে পার্কের রেকর্ড রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৪০টি নিহত ও ৫০টিরও বেশি গুরুতর আহত হয়। ভলকানো মূলত কিলাওয়োর দ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত, প্রায় ১৯৩৮ সালের শেষদিকে এর উদ্ভাবন। এটি অনেক ভ্রমণপিপাসুর কাছে মূল আকর্ষণ। এটাকে জিওট্যুরিজম বলা হয়। এটা একটি আগ্নেয়গিরি। এর লাভায় দুর্ঘটনার সম্ভাব্যতা বেশি থাকে। অনেকেই কাছ থেকে দেখার জন্য যান আর এতেই ঘটে যায় জীবনের সমাপ্তি। এই লাভার গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পরিবেশও দূষণ করে। আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। লাভার ধোঁয়ায় রয়েছে ক্ষতিকর বাষ্পীয় মেঘ। যা কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সমন্বয়ে গঠিত ক্ষতিকর গ্যাস। এই গ্যাস মানবদেহের অস্থি ও হৃৎপিন্ডের ক্ষতি করে। এ ছাড়া রয়েছে এখানে বিশুদ্ধ পানির অভাব।

 

দ্য ক্লিফ অব মোহর [আয়ারল্যান্ড]

আয়ারল্যান্ডের দ্য ক্লিফ অব মোহর বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক ও হৃদয়স্পর্শী পর্যটন কেন্দ্র। মোটামুটি আটলান্টিক সাগরের পাশেই এর অবস্থান। পার্কিং লটও এখান থেকে বেশি দূরে নয়। পাশেই বাঁধানো হাঁটার রাস্তা, পাথরের ধাপ এমনকি কোমর সমান পাথরের দেয়াল পর্যটন স্থানটিতে দিয়েছে আলাদা স্বতন্ত্রতা। তবে এখানকার দেয়ালে পর্যটকদের বেশি সময় থাকা ঠিক নয়। আর হাঁটার রাস্তাটি চলে গেছে ক্লিফের শীর্ষ উচ্চতায়। এখান থেকেই মৃত্যুর পথ শুরু। অধিক উচ্চতা, অসহনীয় বাতাসের পরিমাণ, কখনো অধিক উষ্ণতা ও অতিরিক্ত বৃষ্টি ক্লিফের পথকে করে তোলে বিভীষিকাময়। পাথরের সুড়কি আর মসৃণ পাথরের এই হাঁটার পথটি সাধারণ পথের মতো নয়। পার্কটির এই পথে মৃত্যুর হাতছানিই বেশি। ২০০৬ সালে এক মহিলা একা হাঁটছিল। পাহাড়ের ওপরে উঠার সময় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান। মহিলাটির মৃত্যু হয়। অন্য দুর্ঘটনাগুলো প্রায় একই ধরনের। ২০০৭ সালের ঘটনা, ২৬ বছর বয়সী এক মা তার চার বছরের সন্তানকে নিয়ে ১৮০ মিটার (প্রায় ৬০০ ফুট) ক্লিফের ওপর থেকে লাফ দেন। এসব ঘটনার পর থেকে সেখানে পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর সতর্কতা জারি করা হয়। তখন থেকেই এই সুন্দর ক্লিফ মোহরকে বিপজ্জনক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।  নানাজনে নানা মত, একধরনের রহস্যের ধূম্রজাল তৈরি হয় এই ক্লিফ মোহরকে নিয়ে। ধারণা করা হয়, মানুষ আত্মহত্যার উদ্দেশে এখানে আসে। ২০১০ সালে প্রাকৃতিক বিপজ্জনক এলাকা হিসেবে একে চিহ্নিত করা হয়।

 

হালফ ডোম [যুক্তরাষ্ট্র]

হালফ ডোম, ভয়ংকর এক পর্যটন কেন্দ্র। যা এখন পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে ৬০ জনের প্রাণ। মূলত পাহাড়-উপত্যকা উপভোগ করতে গিয়ে ঘটেছে এমন প্রাণহানি। হালফ ডোমের উচ্চতা এতটাই বেশি যে, আগত দর্শনার্থীদের পাহাড়ে চড়তে সারা দিন কেটে যায়। এর উচ্চতা ১৫০০ মিটার (প্রায় ৫০০০ ফুট)। আর ভয়ংকর রকম খাড়া পাহাড় হালফ ডোম। এর শেষ ১২০ মিটার (প্রায় ৪০০ ফুট) চড়ার জন্য পর্যটকদের জন্য রয়েছে মেটাল ক্যাবল। বিপত্তি শুরু এখান থেকেই। অনেক বেশি উচ্চতা ও মেঘলা পরিবেশ হওয়ার কারণে অনেক আরোহণকারী অনুৎসাহী হয়ে পড়েন। কারণ ক্যাবলটি তখন পিচ্ছিল হয়ে যায়। এতে অনেকেই নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। ক্যাবলের নিচে মৃত্যুপুরী ভার্নাল জলপ্রপাত। ২০১২ সালের ঘটনা, এক ব্যক্তি হালফ ডোমের ক্যাবলে আরোহণ করে দুর্ঘটনায় পড়েন, শত চেষ্টা করেও তিনি পাহাড় আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেননি। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১১ সালে তিনজন আরোহী নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে পার হতে গিয়ে জলপ্রপাতে পড়ে যান। এদের মধ্যে দুজন জলপ্রপাতে ভেসে যান ও অন্য একজন ১৮০ মিটার (প্রায় ৬০০ ফুট) ওপর থেকে ছিটকে পড়ে মারা যান। পাহাড়ের এমনও স্থান রয়েছে যেখানে আলোর ব্যবস্থাও নেই। এখানকার ৬০ ভাগ উদ্ধারকর্মীই প্রতিনিয়ত বিপদগ্রস্ত আরোহীদের উদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন। হেলিকপ্টারে করে চলে উদ্ধার তৎপরতা ও প্রাথমিক চিকিৎসা।

 

ক্যামিনিটো দেল রে [স্পেন]

স্প্যানিস রাজা আলফোনসো ১৩-এর শাসনামলে দারুণ এক পর্যটন স্থানের সন্ধান মেলে। কিন্তু সেই নান্দনিক স্থানটি এখন ভয়ংকর মৃত্যুপুরী। পরবর্তীতে গেনটানিস জর্জ এখানে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেন। এই মানুষটি পাহাড়ের মধ্যে পথটি স্থাপন করেন, যার দৈর্ঘ্য মাত্র ১ মিটার (৩ ফুট)। বর্তমানেও একই অবস্থায় আছে অসাধারণ পথটি। পথটি নিছক ক্লিফের মতো লম্বায় ১০০ মিটার (৩০০ ফিট)। এটাকে টেকনিক্যালি জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এখানে পাঁচটি নিহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রতি বছর আগ্রহী অনেক অভিযাত্রীর জন্য এটাকে বন্ধ করা যায়নি। প্রতি বছরই এখানে পাহাড়ের পথ পার হওয়ার সময় পড়ে গিয়ে ভগ্নদশা তৈরি হয়। অর্থাৎ কারও হাত ভাঙে, কারও পা, আবার কারও কারও জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করে নিতে হয়। আগ্রহী আরোহণকারীরা তা বুঝতে চান না। দুঃসাহসিকতার জন্য এই ভয়ানক ৩ ফুটের রাস্তা পার হতে যান অনেক আরোহণকারী। সরু পথটি ক্যামিনিটো দেল কে কলঙ্কিত করেছে। অনেক বিপজ্জনক হলেও পাহাড়ি পথটি দেখতে সুন্দর, পরিষ্কার কাঠের তৈরি পুলের মতো। অনেকেই মরীচিকার এই পথটিকে সমর্থন করেন আরোহণ করার জন্য। আরোহণকারীদের অন্য কোনো পছন্দ নেই, তবে সাবধানে আরোহণ করতে হয়। পথটিতে একজনের বেশি একসঙ্গে চলতে পারবে না।  এমনকি পথটি পাহাড়ের গা ঘেঁষে হওয়ায় পাহাড়ের অনেক গর্ত রয়েছে। সঙ্গে উচ্চতার ভয় তো আছেই। পথটিতে আরোহণ করার সময় নিচে তাকালে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।

 

কোকোডা ট্রাইল [পাপুয়া নিউগিনি]

কোকোডা ট্রাইলের পাশে ১০০ কিলোমিটার (৬০ মিটার) পর্যন্ত এলাকা গরম, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। পাপুয়া নিউগিনির পর্যটন স্থানটি ভয়ংকর সব বিপদে পরিপূর্ণ। সবুজে ঘেরা কোকোডায় আছে চিকিৎসার হরেক রকম গাছগাছালি। এখানকার রেইন ফরেস্টে বহিরাগত পশুপাখি, বন্যপ্রাণী, পরিষ্কার পানি এবং স্থানীয় জনসাধারণ যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে বসবাস করে আসছেন। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জনপ্রিয় স্থান যেখানে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সৈন্যরা অবস্থান করত। প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক এখানে ভ্রমণে আসেন। এর মধ্যে বিপজ্জনক কিছু পরিখা রয়েছে, যেখানে পা রাখলেই মৃত্যু। অনেকেই আবার হাড় ভাঙেন, অনেকে পা ভাঙেন, অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। এই বনের মধ্যে হাঁটার ব্যবস্থা, পাহাড়ে আরোহণের ব্যবস্থা, এমনকি নদীতে সাঁতারের ব্যবস্থাও রয়েছে। হাঁটার সময় খেয়াল থাকে না যে, এখানে গর্ত থাকতে পারে। পর্যটকরা এখানে আসার জন্য যা যা দরকার সবই নিয়ে আসেন। পাহাড়গুলো দেখতে কয়েক মাইল লম্বা মনে হয়। আশপাশে পড়ে থাকা যুদ্ধের সরঞ্জামগুলো দেখার জন্য অনেক পর্যটকই আগ্রহভরে এখানে আসেন। অনেক সময় ভ্রমণে আসা পর্যটকরা মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। পর্যটকদের পর্যটন গাইড অনুসরণ করতে হয়। অনেক স্থানে যুদ্ধের অনেক পরিত্যক্ত সরঞ্জামের দেখা মিলবে। ২০১৩ সালে একদল পর্যটক দল এখানে বেড়াতে এসে স্থানীয় দস্যুদের আক্রমণের শিকার হন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর