রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

নতুন যুগে টাটা সাম্রাজ্য

আবদুল কাদের

নতুন যুগে টাটা সাম্রাজ্য

টাটা গ্রুপের পরের প্রজন্মের নেতৃত্ব দেওয়া কর্তাদের মধ্যে অন্যতম লিয়া টাটা। তিনি সম্পর্কে রতনের ভাইঝি। রতন টাটার ভাই নোয়েল টাটার জ্যেষ্ঠ কন্যা

ব্যবসা চালাচ্ছেন রতন টাটার ভাইঝি

ভারতের বাণিজ্যে টাটাদের সুনাম সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে রতন টাটার সাফল্য যে কারও কাছেই অনুপ্রেরণা। সেই প্রেরণাকে পাথেয় করে এগোচ্ছেন নতুন প্রজন্মের কর্ণধার লিয়া ও মায়া...

২০২২ সালে লিয়া টাটা ও মায়া টাটা এবং নেভিল টাটাকে চেয়ারম্যান করে রতন টাটার অধীনে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে লিয়া টাটা এবং মায়া টাটার হাতে আসতে যাচ্ছে টাটা গ্রুপের দায়িত্ব...

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারতের সাফল্যের সিংহভাগই এসেছে একটি গ্রুপের হাত ধরে। নাম- টাটা সন্স। গ্রুপ অব কোম্পানিটি টাটা গ্রুপ নামে বেশি পরিচিত। সংস্থাটির বর্তমান চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখরন। তবে ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৭ সাল অবধি রতন টাটা ছিলেন টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যন। তার আমলেই টাটা সন্সে সাফল্যের তালিকা দীর্ঘ। আর পরবর্তী প্রজন্মে টাটার দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন লিয়া টাটা ও মায়া টাটা। লিয়া সম্পর্কে রতন টাটার ভাই নোয়েল টাটার জ্যেষ্ঠ কন্যা। লিয়ার বোন মায়াও গোষ্ঠীটির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। লিয়ার এক ভাইও রয়েছেন এই তালিকায়। নাম নেভিল টাটা। ভারতীয় বণিক মহলে এদের সরব উপস্থিতি জানান দিচ্ছে যে ভবিষ্যতের টাটার নেতৃত্ব কেমন হবে। নোয়েল টাটা এবং আলো মিস্ত্রির কন্যা লিয়া। বাবা-মা দুজনই সফল ব্যবসায়ী। তাদের দেখানো পথেই হেঁটেছেন লিয়া। তিনি পড়াশোনা করেছেন স্পেনের বিজনেস স্কুলে। মাদ্রিদের আইই বিজনেস স্কুলে মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করেন লিয়া। ২০১০ সালে বিখ্যাত ফ্যাশন সংস্থা লুই ভিতোঁয় তিন মাসের ইন্টার্নশিপ করেন তিনি। গত ১০ বছরেও ভারতের হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতে বিভিন্ন দায়িত্ব সামলেছেন লিয়া। ২০০৬ সালে তাজ হোটেলস রিসোর্টস অ্যান্ড প্যালেসেসের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেলস ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন লিয়া। পরে টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গেও যুক্ত হন। টাটা মেডিকেল সেন্টার ট্রাস্টের একজন ট্রাস্টি লিয়া টাটা। এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, টাটা ডিজিটালের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন লিয়া টাটার বোন মায়া টাটাও। অন্যদিকে টাটা সন্সের রিটেইল সংস্থা ট্রেন্ট সামলাচ্ছেন ভাই নেভিল টাটা। অর্থাৎ টাটা পরিবারের নতুন প্রজন্মও ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তবে টাটাদের পরের প্রজন্মের লিয়া, মায়া, নেভিলরা অনেকটা প্রচারবিমুখ। বরাবরই প্রচারের আড়ালে থাকেন তিন ভাই বোন। নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই এগোচ্ছে টাটা গ্রুপ। আজকের দিনে টাটা গ্রুপের ব্যবসায়ী উত্থান কিংবা টাটা গ্রুপের স্বর্ণযুগের অন্যতম কর্ণধার রতন টাটা। তবে ‘টাটা’র গল্প শুরু হয় সেই ব্রিটিশ শাসনের সময়। দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে টাটা গ্রুপ আজকের দিনে ভারতের অন্যতম শীর্ষ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। ১৮৬৮ সালে প্রথম শুরু হয় টাটা গ্রুপের পথচলা। জামশেদজি টাটার হাত ধরে প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে টাটা গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়। তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের এক রপ্তানি ব্যবসায়ীর ছেলে। ১৮৫৮ সালে তিনি বাবার ব্যবসার প্রসারে হংকং চলে গেলেন। পরের দশকে তিনি ব্যবসাকে ছড়িয়ে দিতে ঘুরলেন জাপান, চীন এবং গ্রেট ব্রিটেন। ১৮৬৮ সালে গড়ে তোলেন নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ‘টাটা গ্রুপ’। গড়ে তোলেন টেক্সটাইল মিল, স্টিল প্রোডাকশন প্ল্যান্ট এবং আন্তর্জাতিক মানের ট্যুরিজম ব্যবসা (যার ফসল ‘তাজমহল প্যালেস হোটেল’)। জামশেদজি ব্যবসায়ী হলেও তার মূল উদ্দেশ্য সব সময়ই ছিল মানুষের উপকারে আসা। জামশেদজির দুই পুত্র তাদের বাবার এত দিনের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে পড়তে দেননি, বরং আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাদের হাত ধরে ভারতের প্রথম সিমেন্ট প্ল্যান্টের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১২ সালে, আর প্রথম ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ১৯১৯ সালে। টাটার নেতৃত্ব এরপর পরিবর্তন হয় ১৯৩৮ সালে, তত দিনে টাটা সন্স বিস্তৃত হয়েছে ১৪টি কোম্পানিতে। এবার টাটার নেতৃত্ব গেল জামশেদজির দূরসম্পর্কের ভাই জাহাঙ্গীর টাটার কাছে। জাহাঙ্গীর টাটা যিনি জেআরডি টাটা নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তিনি টাটা কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ১৯২৫ সাল থেকেই। টাটায় যুক্ত হওয়ার পর জেআরডি ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘টাটা এয়ার সার্ভিস।’ ৫২ বছরের নেতৃত্বে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘টাটা মোটরস’। সবশেষ টাটার নেতৃত্ব দেন রতন টাটা। তিনি টাটার রেডিওর পাশাপাশি প্রযুক্তিনির্ভর পণ্যও তৈরি করতে শুরু করেন। নেলকোর সাফল্যই ১৯৯১ সালে রতন টাটাকে এনে দিল টাটা গ্রুপের নেতৃত্ব। তিনি মূল প্রতিষ্ঠানের ২০ পার্সেন্ট শেয়ার বিক্রি করে সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে ফেললেন। পরবর্তীতে তিনি অন্যান্য প্রতিযোগীদের কিনে টাটার অংশ বানিয়ে ফেলেন। যেমন- ২০০০ সালে ‘টাটা টি’ কিনে নিল ব্রিটেনের টেটলি কোম্পানিকে। ইউরোপের স্টিল কোম্পানি কোরাস চলে এলো টাটা স্টিলের অধীনে। জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার হয়ে গেল টাটা মোটরস। এতে বিপুল অর্থ খরচ হলেও যে বিরাট মার্কেট পেয়েছে, তাতে এ অর্থ পুষে যায়। আবাসন খাত থেকে শুরু করে এয়ারকন্ডিশনিং, হোটেল শিল্প, গাড়ি শিল্প, ফোন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বীমা খুলে ব্যবসায় নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করেছেন ভারতীয় অন্যতম ধনী রতন টাটা।

 

রতন টাটার সম্পদ কম, দান করেন আয়ের বেশির ভাগই...

রতন টাটা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত তো বটেই, বিশ্বের শতাধিক দেশে টাটার ব্যবসা ছড়িয়েছেন। তার হাতেই ‘টাটা অ্যান্ড সন্স’ হয়ে ওঠে ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়িক গ্রুপ

টাটা সাম্রাজ্যের বাদশাহ

রতন টাটার বয়স এখন ৮৫ বছর। টাটা গ্রুপ অ্যান্ড চ্যারিটেবল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে রতন টাটা নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। ২০১৭ সালে তিনি টাটা অ্যান্ড সন্স থেকে অবসর নেন। টাটা গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন জামশেদজি টাটা। শুরুতে ছিল স্টিলের ব্যবসা। দ্বিতীয় প্রজন্মে টাটা গ্রুপ হয়ে ওঠে টাটা অ্যান্ড সন্স। জেআরডি টাটা ব্যবসা আরও বিস্তৃত করেন। টাটা মোটরসের যাত্রা হয়। তৃতীয় প্রজন্মে টাটার ব্যবসা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেন রতন টাটা।

ছিলেন দত্তক পুত্র

রতন টাটার বাবা নাভাল টাটা আসলে ছিলেন রতনজি টাটা এবং নভজবাই টাটার দত্তক পুত্র। দত্তক নেওয়ার আগে পর্যন্ত নাভাল টাটা জে.এন. পেটিট পারসি অরফানেজে বড় হন। তারপরেই নাভালকে রতনজি ও নভজবাই দত্তক নিয়েছিলেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহ-বিচ্ছেদ দেখেন রতন টাটা। তখন থেকেই ঠাকুরমা নভজবাইয়ের কাছে বড় হয়ে ওঠেন। তার স্কুলজীবন কাটে মুম্বাই এবং সিমলায়। আমেরিকার নিউইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুল, কর্নেল ইউনিভার্সি এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ব্যক্তিজীবনে বিয়ে করেননি রতন টাটা। ২০০৭ সালে এফ-১৬ ফ্যালকন ওড়ানো প্রথম ভারতীয় পাইলট ঘোষিত হন রতন টাটা।

যেভাবে উত্থান তার

মাত্র ২৫ বছর বয়সে টাটায় ক্যারিয়ার শুরু করেন রতন টাটা। ১৯৬২ সালে ভারতে ফিরে আসার আগে আমেরিকার জোন্স অ্যান্ড এমন্স প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ১৯৯১ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে দেশীয় প্রযুক্তিতে গাড়ি তৈরি করেন। অটো এক্সপো এবং জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল মোটের শোয় জায়গা পায় টাটার ইন্ডিকা গাড়ি। রতন টাটা গত ৬০ বছর ধরে ভারতে আলপিন থেকে এরোপ্লেন, সবকিছুতেই ব্যবসা ছড়িয়েছেন। টাটা গ্রুপ পরিচালনা করছে ৯৬টি কোম্পানি। সেখানে ৩০টি প্রতিষ্ঠান ‘পাবলিকলি লিস্টেড’ হিসেবে অবস্থান করছে। এ তালিকায় আছে টাটা স্টিল, টাটা মোটরস, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, টাটা পাওয়ারসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান।

যেভাবে ফিরলেন টাটায়

১৯৯১ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হন রতন টাটা। দীর্ঘ কর্মজীবন পেরিয়ে ২০১২ সালে অবসরও নিয়েছিলেন। রতন টাটার উত্তরাধিকার হিসেবে পরে চমক সৃষ্টি করেছিলেন সাইরাস মিস্ত্রি। টাটা সাম্রাজ্য সামলানোর দায়িত্ব হাতে নেন। সত্তর বছরে প্রথমবার টাটা পরিবারের বাইরে কেউ চেয়ারম্যানের পদে আসীন হন। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানেই চেয়ারম্যান পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রিকে অপসারণ করে আবার ফিরে আসেন ধনকুবের রতন টাটা।

ট্রাস্টের হাতে বেশি সম্পদ

ভারতের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় থাকা রতন টাটা ব্যক্তিগত সম্পদ হাতে রাখেন না। দান করে দেন আয়ের অন্তত ৬৬ শতাংশ। অথচ টাটা গ্রুপের বিশাল সাম্রাজ্যের অর্থমূল্য ২০২১-২২ সালে ছিল ১৭৬ বিলিয়ন ডলার। তার ৩৮০০ কোটি রুপির বেশির ভাগই আসে টাটা সন্স থেকে। আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্ট ২০২২ অনুসারে তিনি ৪২১তম ভারতীয় ধনী। টাটা অ্যান্ড সন্সের লভ্যাংশ সরাসরি ট্রাস্টে জমা হয়, আর সেখান থেকে কর্মচারীদের বেতন, বোনাসে খরচ হয়, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রিতে লেখাপড়া করানো থেকে বিনামূল্যে ক্যান্সারের চিকিৎসা। টাটা গোষ্ঠী কর্মীদের আধুনিক পেনশন সিস্টেম, চিকিৎসাসেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি আর আরও অনেক সুবিধা প্রদান করে বিনামূল্যে।

 

টাটা সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন পরের প্রজন্মের উত্তরাধিকাররা

টাটা গ্রুপের প্রারম্ভিক পথচলা জামশেদজি টাটার হাত ধরে হয়েছিল। তার ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য সব সময়ই ছিল মানুষের উপকারে আসা। তিনি শিক্ষাকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন যে, তিনি তার সম্পদ থেকে জমি এবং দালান দান করে দিতেন। একই পথে হেঁটেছেন জেআরডি টাটাও। টাটা গ্রুপের বেশির ভাগ লভ্যাংশ যায় ট্রাস্টে। আর আধুনিক যুগে টাটা গ্রুপকে অনন্য উচ্চতায় নেওয়া রতন টাটা কেমন দানশীল তা সবারই জানা। টাটা গ্রুপের পরের প্রজন্ম লিয়া টাটা, মায়া টাটা এবং নেভিল টাটাও হেঁটেছেন দানশীল ব্যক্তিদের পথেই। ভারত তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও টাটা ট্রাস্ট মানবতার প্রতীক এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি ভারতের প্রাচীনতম, অসাম্প্রদায়িক জনসেবামূলক সংস্থাগুলোর অন্যতম। ২০২১ সালে হুরুন রিপোর্টে যে ১০ জন সেরা দানশীল ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, তার মধ্যে প্রথম টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটা। সেবার টাটা ট্রাস্টের দানের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০২ বিলিয়ন ডলার। টাটাদের পূর্ব প্রজন্ম অর্থাৎ জামশেদজি টাটার মতো দানশীল ভূমিকা পালন করছেন রতন টাটা এবং পরবর্তী প্রজন্ম লিয়া টাটা, মায়া টাটা ও নেভিল টাটাও সে পথে হাঁটছেন।

 

শতাধিক দেশে টাটার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য

টাটা গ্রুপের যাত্রাকাল ১৮৬৮ সাল। জামশেদজি টাটা এবং পরবর্তী তার দূরসম্পর্কের ভাইয়ের ছেলে জেআরডি টাটার পর ১৯৯১ সালে সেই গ্রুপের চেয়ারম্যান হন রতন টাটা। মোটরগাড়ি নির্মাণ থেকে শুরু করে স্টিল, বেভারেজ, সফটওয়্যার, হোটেল শিল্প, ফোন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বীমা ইত্যাদি প্রথম সারির বহু ব্যবসায় বিনিয়োগের সঙ্গে যুক্ত ভারতীয় টাটা গ্রুপ। তাদের ব্যবসায়িক মূল্য ৩১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের গোটা শেয়ারবাজারের প্রায় ৭ শতাংশ টাটা শিল্প গোষ্ঠীর দখলে। ২০১৭ সালে ভারতের করপোরেট ট্যাক্সের ৩ শতাংশ আসে এই গ্রুপের কল্যাণে। টাটা ভারতের সর্ববৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের ১০০টিরও বেশি দেশে শতাধিক কোম্পানির মাধ্যমে টাটা গ্রুপের ব্যবসা রয়েছে।

 

টাটা গ্রুপের যত ব্যবসা

জামশেদজি টাটার হাত ধরেই ১৮৬৮ সালে টাটা গ্রুপের পথচলা। এরপর কেটে গেছে ১৫৫ বছর।  নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে টাটা গ্রুপ এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। টাটা গ্রুপের সদর দফতর ভারতে। প্রায় ৩০টি সংস্থার সমন্বয়ে শতাধিক দেশে এগিয়ে চলেছে টাটা। ভারতীয় এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিনিয়োগ হোল্ডিং কোম্পানিতে। এ ছাড়াও ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে টাটা গ্রুপের মোট মূলধনের প্রায় ৬৬ শতাংশ। আর ট্রাস্টের এসব অর্থ ব্যয় হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নির্মাণ এবং শিল্প-সংস্কৃতিতে। ২০২২-২৩ সালে টাটা গ্রুপের মোট রাজস্ব দাঁড়ায় প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। এই গ্রুপে সম্মিলিতভাবে ১০ লাখেরও বেশি লোক কাজ করে থাকেন। রতন টাটার আমলে টাটা গ্রুপের সাফল্যের তালিকা দীর্ঘ। আবাসন খাত থেকে শুরু করে এয়ারকন্ডিশনিং, হোটেল শিল্প, গাড়ি শিল্প, ফোন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বীমা, ঘড়ি, এমনকি জুতার কোম্পানি পর্যন্ত রয়েছে। টাটা গ্রুপের মধ্যে রয়েছে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস। এটি মূলত প্রযুক্তি ও ডিজিটাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। টাটা স্টিল হলো আরেক গ্লোবাল স্টিল ব্যবসার শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। আর টাটা মোটরসের কথা তো সবারই জানা। বিশ্বের গাড়ি ব্যবসায় শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম টাটা মোটরস। এ ছাড়া টাটা কেমিক্যাল, টাটা পাওয়ার ও টাটা ভারতীয় হোটেল তো বটে; বিশ্বের অসংখ্য দেশে ব্যবসায় রাজত্ব গড়ে তুলেছে টাটা গ্রুপ।

 

সবাইকে ছাড়িয়ে গাড়ি ব্যবসায় এগিয়ে টাটা

রতন টাটা বিশ্বের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তাদের কাছে এক প্রশংসিত নাম। বিভিন্ন কারণে তিনি এই অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন। টাটা গ্রুপের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিভিন্ন গাড়ির কথা। ট্রাক থেকে লরি, প্রাইভেট কার। টাটা নামটিকে গাড়ি প্রস্তুতকারক নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান বলেই চেনেন সবাই। ১৯৯৮ সালে বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি টাটা ইন্ডিকো নামে প্রথম প্যাসেঞ্জার কার আনে। অল্প খরচে বেশি মাইলেজ- এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেই এই প্যাসেঞ্জার কারগুলো মানুষের আস্থা লাভ করে। যে কারণে দুই বছরের মধ্যে গাড়িটি ভারতে এক নম্বর জায়গা দখল করে। নাম ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ভারতের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে টাটা। এই প্রতিষ্ঠানের অন্য একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য সবার নজর কাড়ে। টাটা গ্রুপ সম্পূর্ণ দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাড়ি তৈরি করে। আর পুরো প্রক্রিয়া হয় দেশেই। তার সময়েই টাটা মোটরস জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার বাজারে আনে। এটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় বিশ্বে। শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, অভিজাত গাড়ি হিসেবেও সবাইকে ছাড়িয়ে যায় জাগুয়ার। ক্রেতারা গাড়ি বাজারে আসার আগেই দীর্ঘ লাইন দেন গাড়িটির অগ্রিম বুকিং দেওয়ার জন্য। শুধু কি গাড়ি ব্যবসা? বেভারেজ কোম্পানি হিসেবে টাটা টি বিশ্বে জনপ্রিয়। অনেকে শুনেছেন টেটলি টির নাম। যুক্তরাজ্যের এক নম্বর চা কোম্পানি এটি। এটিও টাটা গ্রুপের বেভারেজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত। এ ছাড়া রয়েছে স্টিল ব্যবসা। দেশের সীমা ছাড়িয়ে টাটা স্টিল ইউরোপীয় লিমিটেড গঠন করে লন্ডনের বাজার দখল করে নেয়। নিউইয়র্কের পিয়েরে হোটেলও টাটার। ভারতের সবচেয়ে বড় স্টিল কোম্পানি ও বৃহত্তম আউটসোর্সিং ফার্মটিও টাটার। টেলিকম সেক্টরেও টাটা ভূমিকা রেখেছে। টাটা গ্রুপের ৬৫ ভাগ রাজস্বই আসে বিদেশ থেকে।

 

 

 

সর্বশেষ খবর